Friday, August 12, 2022

জহির রায়হান এর 'হাজার বছর ধরে' পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

“জীবনের হাটে সকল বেচাকেনা শেষ করে দিয়ে একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ওরা। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো।

রাত বাড়ছে।

হাজার বছরের পুরানো সেই রাত।”

সেই রাত বাড়ার মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে হাজার বছরের ইতিহাস। এই ইতিহাস গ্রাম-বাংলার সামাজিক ইতিহাস। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার সামাজিক প্রথা, কুসংস্কার, সাংসারিক টানা পোড়ন, নারী নির্যাতন, রোগ-শোক, সামাজিক বন্ধনের মতো বিষয়গুলো। উপন্যাসটি ১৯৬৪ সালে লিখেছিলেন এবং এই বছরই আদমজি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলো উপন্যাসটি। উপন্যাসটি লেখা নিয়ে একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটি হলো, জহির রায়হানের বন্ধু ‘সচিত্র সন্ধানী’-র সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য অনেক দিন ধরে একটা উপন্যাস লিখতে বলতে ছিলো কিন্তু জহির রায়হান সিনেমা তৈরী নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে কোন সময়ই দিতে পারছিল না। তাই গাজী শাহাবুদ্দিন বাধ্য হয়ে শুটিং স্পটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকতো, শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে উপন্যাস লিখতেন। শুটিং এর মধ্যেই উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন। তবে কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে, গাজী শাহাবুদ্দিন তাকে এক সপ্তাহের জন্য জোর করে ধরে নিয়ে এসে একটা রুমে বসে উপন্যাসটি লিখতে বাধ্য করেন এবং বলেন তার যা যা দরকার সব রুমে দেয়া হবে কিন্তু বাইরে যেতে দেয়া হবে না। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন, জহির রায়হান উপন্যাসটি কোন গ্রামে না গিয়ে শহরে বসে অল্প সময়ে লিখে দেন। উল্লেখ্য যে, গাজী শাহাবুদ্দিন এবং জহির রায়হান বন্ধু ছিলেন এবং উপন্যাস লেখার সময় জহির রায়হানের বয়স ছিলো ২৯ বছর।

‘পরীর দীঘি’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। এই পরীর দীঘি হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামস্থ ‘জগন্নাথ দীঘি’। সেই জগন্নাথ দীঘি ও তার পাশের কয়েকটি গ্রাম নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনী। উপন্যাসের চরিত্রগুলো হলো-

  • বুড়ো মকবুল – শিকদার বাড়ির প্রধান ও মুরব্বি
  • আমেনা – বুড়ো মকবুলের প্রথম স্ত্রী
  • ফাতেমা – বুড়ো মকবুলের দ্বিতীয় স্ত্রী
  • টুনি – বুড়ো মকবুলের তৃতীয়া স্ত্রী ও উপন্যাসের নায়িকা
  • মন্তু – উপন্যাসের মূলচরিত্র
  • আম্বিয়া – করিমের বোন, উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে মন্তুর স্ত্রী
  • ফকিরের মা – প্রতিবেশী
  • আবুল – প্রতিবেশী
  • হালিমা – আবুলের স্ত্রী
  • গনু মোল্লা – ধর্মীয় ব্যক্তি (প্রতিবেশী)

উপন্যাসটি প্রধানত তিনটি চরিত্র কেন্দ্রিক হলেও, প্রত্যেকটা চরিত্রের আছে বিশেষ গুরুত্ব । আবুলের কথাই ধরা যাক, যার কাজই ছিলো বউ পেটানো। আবুলের পিটুনি খেয়ে তিনটি বউ আয়েশা, জমিলা আর হালিমা মারা গেলো। যা ততকালীন বাঙ্গালী সমাজেরই চিত্র নয়, নারী নির্যাতনের এমন চিত্র এখনো এই সমাজেও বিদ্যমান, ধরন পাল্টেছে শুধু। গ্রামের ধার্মিক ব্যক্তি ছিলো গনু মোল্লা। মানুষের বিপদে আপদে, ঝাড়-ফুঁকে যাকে সব সময় পাওয়া যেতো। বুড়ো মকবুল তার নারিকেল, সুপারি আর কৃষি জমি নিয়ে জানান দিচ্ছে যে গ্রামীণ জীবন কৃষি নির্ভর এবং সংসার, গৃহস্থী কাজ করেই জীবন চলে। আমেনা, ফাতেমা আর টুনি ছিলো তার হাতিয়ার। আয়ের মাধ্যম ছিলো কৃষি তাই কৃষি কাজেও তিন বউয়ের ডাক পড়ত। তিন বউ, কৃষি আর এক মেয়ে নিয়েই ছিলো মকবুলের সংসার। তবে বুড়ো মকবুলের বউদের দিয়ে কাজ করানোর মধ্য মাঝে মাঝে বাঁধ পরতো ফকিরের মায়ের। কিন্তু বুড়ো মকবুল তা কেয়ার করত না।

মকবুলের ছোট বউ টুনি। উপন্যাসের একটি মূল চরিত্র। যার সাথে ছিলো মন্তুর একটা ভাব। পরকীয়া প্রেমও বলা যেতে পারে একে। টুনি আর মন্তু মকবুলের চোখের আড়ালে দীঘির পাড়ে বসে গল্প করা, রাতের আধাঁরে মাছ ধরতে যাওয়া, শেষ রাতে খেজুর রস চুরি করার সাহস, শাপলার বিলে নৌকায় চড়ে শাপলা তোলা এমন মধুর সময় পাড় করার বর্ণনা এক সুন্দর প্রেমের কাহিনী। আবার আম্বিয়া মন্তুর দিকে চেয়ে তার অপ্রকাশ্য প্রেমের এক প্রকাশ্য রুপ দেখায়, যা ত্রিভূজ প্রেমের দিকে নিয়ে যায় উপন্যাসটিকে।

টুনি, মন্তু আর আম্বিয়ার এই চিত্র দেখে মনে হয়, মন্তুর আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করবে টুনির সনে আর আম্বিয়াকে নিয়ে ঘর বাধবে গহীন বালু চড়ে যা উপন্যাসের শেষে দেখা যায়। বুড়ো মকবুল মারা যাবার পর টুনি এই অনুশোচনায় ভুগতে থাকে যে, বুড়োর মৃত্যুর জন্য টুনিই দায়ী। তাইতো মন্তু তাকে বিয়ে করতে চাইলেও ফিরিয়ে দেয়। মন্তুকে ফিরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আরো একটি বিষয় সামনে আসে যে, ঐ সময়ে বিধবা বিয়ে হলে যে সমাজ এ নিয়ে কটু কথা বলবে, এমন কি তাদের সমাজচ্যুতিও হতে পারে। তাইতো বুড়ো মকবুলের স্মৃতি বুকে নিয়ে টুনি চলে গেলে মন্তু বিয়ে করে আম্বিয়াকে। এভাবেই শেষ হতে থাকে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের কাহিনী।

উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে একান্নবর্তী পরিবার, সমাজের বাস্তব চিত্র। ফুটে উঠেছে গ্রামীণ লোকাচার, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, নানান ধরনের কুসংস্কার, বিশেষ করে ওলা বিবির হাত থেকে বাঁচার জন্য, মনের মানুষকে পাবার জন্য ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজের মতো কর্মকান্ড, নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইত্যাদি।

 হাজার বছর ধরে -- জহির রায়হান 
(পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন)

Wednesday, August 10, 2022

একটি গবেষণা প্রস্তাব লেখার পদ্ধতি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

একটি গবেষণা প্রস্তাব লেখার পদ্ধতি

গবেষণা প্রস্তাব হলো একজন গবেষক যে বিষয়ে গবেষণা করতে চায় তার একটি পরিকল্পিত লিখিত রুপ। যেখানে গবেষণার বিষয়, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, অনুমিত সিদ্ধান্ত, কর্ম পরিকল্পনা ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়ে থাকে। একজন গবেষককে তার গবেষণাকর্ম শুরুর পূর্বে গবেষণা প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হয়। একজন নতুন গবেষকের গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকলেও প্রথম বাধার সম্মুখীন হতে হয় এই গবেষণা প্রস্তাব লেখা নিয়ে। কেননা, গবেষণা প্রস্তাব লেখার বিশেষ কিছু নিয়ম ও ধাপ অনুসরণ করতে হয়। গবেষণা প্রস্তাব লেখার এই পদ্ধতি নিয়েই আজকের আলোচনা।

১। শিরোনাম (Title):

শিরোনাম দ্বারা আপনার কাজ কোন বিষয়ে এবং আপনি আপনার কাজে কি কি বিষয়ে তুলে ধরতে চান তার একটি সামগ্রিক ধারনা পাওয়া যাবে। আরো সহজ করে বললে বলা যায় যে, আপনার গবেষনার ঊদ্দেশ্য সমূহের স্পষ্ট প্রতিফলন হবে শিরোনামে। গবেষণার শিরোনাম এমন হতে হবে যাতে শিরনামকে ভাঙ্গলে গবেষণার উদ্দেশ্য পাওয়া যায় আবার গবেষণার উদ্দেশ্য সমূহকে জোড়া দিলে শিরোনাম পাওয়া যায়। তাই শিরোনাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে দুইটি পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। প্রথমত, সাহিত্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে ঊদ্দেশ্য নির্ধারন করে গবেষণার একটি প্রাথমিক শিরোনাম দেয়া যেতে পারে । যা পরবর্তী  কাজের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে। আর দ্বিতীয়ত হল সব কাজ শেষ করার পর কাজের সাথে সংশ্লিষ্টতা রেখে একটি শিরোনাম দেয়া। তবে শিরোনাম হতে হবে সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থবহ। শিরোনাম মূলত ১৪ -১৮ শব্দের মধ্যে হতে হয়। শিরোনাম দুইভাবে লেখা যেতে পারে। প্রথমটি হল, এক লাইনে পুরো শিরোনাম দিয়ে দেয়া। আর অন্যটি হল কোলন ( : ) ব্যবহারের মাধ্যমে শিরোনামকে দুইভাগে ভাগ করে লেখা। একটি বিষয় লক্ষনীয় কোলন ( : ) ব্যবহারের পর কখনো প্রেক্ষিত শব্দটি ব্যবহার না করাই উচিত। কারন কোলন ( : ) এবং প্রেক্ষিতএর অর্থ একই। সবশেষ কথা, শিরোনাম হবে মূলত আপনার গবেষণার মূলবিষয় সূচক শব্দের (Keyword) সংমিশ্রণ।

২। ভূমিকা (Introduction):

গবেষণা প্রস্তাবনার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ন ধাপ হলো ভূমিকা। এই ভূমিকার মাধ্যমে একজন পাঠক আপনার গবেষণা সম্পর্কে স্পস্ট ধারনা লাভ করতে পারবেন। তাই এই ভূমিকা অংশটি অত্যন্ত যত্নের সাথে লেখা উচিত এবং সবার শেষে লেখা উচিত। ভূমিকা অংশটি যতটুকু পারা যায় সহজ ও সরল রাখতে হবে যাতে কেউ তা পড়া মাত্র বুঝে যেতে পারে। তাই ভূমিকা লিখতে যে যে বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলোঃ প্রথমত, শুরুতেই আপনার গবেষণার জন্য নির্বাচিত বিষয়ের একটি সার্বজনীন ধারনা দিতে হবে। ধরুন, কেউ উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চায় , তাহলে তাকে দেখাতে হবে বিশ্বব্যাপি উচ্চ শিক্ষাকে কিভাবে দেখা হচ্ছে এবং ইহার বর্তমান অবস্থা কি তা তুলে ধরতে হবে। ঠিক এরপরেই চলে আসতে হবে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার বর্তমান অবস্থা কিরূপ তার একটি সার্বিক ধারনা দিতে হবে। ঠিক এরপরেই গবেষণার জন্য যে যে উদ্দেশ্য নির্ধারন করা হয়েছে তার সাথে বর্তমান অবস্থার কি কি ধরনের সামঞ্জস্যতা এবং ার্থক্য রয়েছে তা দেখাতে হবে এবং একই সাথে যে বিষয়ে জোড় (Focus) দেয়া হয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে। উদ্দেশ্যর সাথে সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের সম্পর্ক আলোচনা করতে হবে। আর এই সার্বিক ধারনা, সামঞ্জস্যতা ও পার্থক্য - এইসব কিছু সাহিত্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে দিতে হবে। তথ্যসূত্র উল্লেখপূর্বক আপনাকে আপনার যুক্তি প্রদর্শন করতে হবে। মোটকথা, ভূমিকা হবে গবেষণা প্রস্তাবটির সারসংক্ষেপ।

৩। বিষয় বিবৃতিকরন বা সমস্যা নির্ধারণ (Statement of the Problem / Issue):

একজন গবেষক যে বিষয়ে গবেষণা করবেন তার সামাজিক প্রেক্ষাপট কিরূপ এবং বর্তমানে তার অবস্থা কি, এই সংক্রান্ত কি কি তথ্য/ উপাত্ত রয়েছে এসব যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে এই অংশে। গবেষণার বিষয়টি কি সামাজিক সমস্যা নাকি এমন এক সামাজিক বিষয় যা কিনা সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দিক এবং যে বিষয়ের দিকে নজর দেয়া উচিত এবং যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সে বিষয়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরাটা জরুরি। এই সকল আলোচনা থাকবে এই অংশে।

গবেষণার উদ্দেশ্য (Research Objectives):

গবেষণার উদ্দেশ্য হল গবেষণার প্রাণ। গবেষণার উদ্দেশ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুইটি পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমত, গবেষণার যে বিষয় নির্বাচন করা হবে সে বিষয়ের ক্ষেত্রে কি কি বিষয় দেখতে চাওয়া হবে তা উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহন করাদ্বিতীয়ত, সাহিত্য পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যে সব রিসার্চ গ্যাপ পাওয়া গিয়েছে সেগুলোকে গবেষণার উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারন করা যেতে পারে। তবে যে পদ্ধতিতেই গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারন করা হোক না কেন, উদ্দেশ্য দ্বারা যাতে গবেষণার নির্ধারিত বিষয়ের উপর নতুন নতুন দিক উঠে আসে সেদিকে নজর দিতে হবে। গবেষণার উদ্দেশ্য হতে হবে খুব স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট। গবেষণার উদ্দেশ্য নির্বাচনের দুইটি পন্থা আছে। প্রথম পন্থা হল একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য ( Broad Objective) এবং দ্বিতীয়টি হল, ৩-৫ টি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য (Specific Objective) নিয়ে কাজ করা। 

৫। সাহিত্য পর্যালোচনা (Literature Review):

একটি গবেষণা শুরু করার জন্য সাহিত্য পর্যালোচনা অতীব জরুরি। গবেষণা শুরু পূর্বে গবেষককে বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে আর এই কার্যটি সর্বপ্রথমে করতে হয়। সাহিত্য পর্যালচনার জন্য একজন গবেষককে যা করতে হবে-

(I)     গবেষককে গবেষণার বিষয় সংশ্লিষ্ট সাহিত্য খুঁজে বের করতে হবে। সেটি হতে পারে বই, জার্নাল, আর্টিকেল, পত্রিকার লেখনী, ওয়েবসাইট, তথ্যচিত্র ইত্যাদি।

(II)     যে কোন সাহিত্য পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যে সব বিষয় লক্ষ্য করতে হবে তা হল - সাহিত্যটির উদ্দেশ্যসমূহ কি কি, কোন গবেষনা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, কোন তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কি ধরনের ফলাফল এসেছে, কোন রিসার্চ গ্যাপ আছে কি না। এই সব বিষয়কে গবেষককে গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত করে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হবে।

(III)   সাহিত্য পর্যালোচনার মূল উদ্দেশ্য হল আপনার গবেষনার বিষয় সম্পর্কে খুব ভালভাবে জানা। তাই যত বেশি সাহিত্য পর্যালোচনা করা যায় তত ভাল। সাধারণত গবেষনা প্রস্তাবনায় সাহিত্য পর্যালোচনা ৫-৬ টি দিলেই যথেষ্ট।

৬। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট (Theoretical Framework):

তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট মূলত গবেষকের গবেষণা ও গবেষণা প্রস্তাবনাকে একটি বৈধতা (Valid Platform) প্রদান করে। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট প্রদানের পূর্বে যে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল, গবেষক যে তত্ত্ব ব্যবহার করবেন তা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা থাকতে হবে এবং তত্ত্বটি গবেষণা বিষয়ের সাথে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত তাও জানতে হবে। গবেষক যে ধরনের তত্ত্বই ব্যবহার করুক না কেন যখনই তিনি তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট লিখবেন তখন তাকে তিনটি ধাপ মেনে চলতে হবে।

(I)      গবেষক যে তত্ত্ব ব্যবহার করবেন সে তত্ত্বটি তিনি তাত্ত্বিকের ভাষায় বয়ান করবেন

(II)     এই তত্ত্বের ক্ষেত্রে গবেষকের যে বোধগম্যতা (Understanding) তা বয়ান করবেন এবং

(III)   এই তত্ত্বটি গবেষকের বিষয়ের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত এবং কিভাবে এই তত্ত্ব দিয়ে গবেষকের গবেষণার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাবে তা তুলে ধরতে হবে।

তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে কয়টি তত্ত্ব দেয়া যাবে এরকম প্রশ্ন প্রায় সবার মনে আসে। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে গবেষক একটি থেকে সর্বোচ্চ তিনটি তত্ত্ব দিতে পারবেন। যত তত্ত্ব ব্যবহার কম হবে গবেষকের জন্য তত সুবিধা, কারন যত বেশি তত্ত্ব দিবেন গবেষকের বিষয়টি ব্যাখা করার ক্ষেত্রে তত বেশি অসুবিধা । 

৭। গবেষনা পদ্ধতি (Research Methodology):

গবেষণা পদ্ধতির ক্ষেত্রে গবেষককে যে সব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে তা হলো সঠিক গবেষণা যন্ত্র ও কৌশল (Research Tool & Techniques)। গবেষণার দুইটি ধারা আছে। যথাঃ গুনগত (Qualitative Approach) ও পরিমাণগত (Quantitative Approach)এখন গবেষক যদি গবেষণার জন্য গুনগত ধারা নির্ধারিত করলেন কিন্তু নির্বাচন করলেন পরিমানগত ধারার গবেষণা যন্ত্র ও কৌশল তবে তা বড় ভুল হিসেবে হবে এবং গবেষণা প্রস্তাবনাটি বাতিল হয়ে যাবে। একটি গুনগত ধারার গবেষণা পদ্ধতিতে যে সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে তা হলো-

গবেষনা প্রস্তাবনার গবেষনা পদ্ধতি অংশে যা যা বিষয় থাকবে

·   গবেষণার এলাকা নির্বাচন (Research Area)

·   নমুনা নির্বাচন (Sampling) 

গুনগত ধারায় গবেষণায় নমুনার আকার (Sample Size) ১ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০ জন পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে ৩০-৩৫ জন হল আদর্শ নমুনার আকার (Sample size)

·   তথ্য উৎ (Sources of Data) 

                               I. মুখ্য উপাত্ত (Primary Data)

                              II. গৌন উপাত্ত (Secondary Data)

মুখ্য উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষন (Observation), নিবিড় সাক্ষাৎকার (In-depth Interview), মূল তথ্যদাতা সাক্ষাৎকার (Key Informant Interview), ফোকাস বা দলগত আলোচনা (Focus/Group discussion), কেস স্টাডি (Case Study) এই ৫ টি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

গৌণ উপাত্তের ক্ষেত্রে আসবে বিভিন্ন বই, জার্নাল, আর্টিকেল, পত্রিকার লেখনী, ওয়েবসাইট, তথ্যচিত্র ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

·   ব্যবহৃত পরিসংখ্যানগত কৌশল (Used statistical strategies) 

৮। গবেষনার যৌক্তিকতা (Research Rationality):

এই অংশে মূলত গবেষক যেই বিষয়ে গবেষণা করতে চায় কেন সে এই বিষয়ে আগ্রহী, কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতার কারনে গবেষক এই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন এবং এই বিষয়ে কাজ করার ফলে গবেষক নিজে ও অন্যান্যরা কিভাবে লাভবান হবে তা লিখতে হবে। এই যৌক্তিকতা লিখতে হলে গবেষককে কিছু যুক্তি প্রদর্শন, যেমনঃ গবেষণার বিষয় সম্পর্কিত সাম্প্রতিক কিছু তথ্য/ উপাত্ত দেখাতে হবে যা গবেষককে আগ্রহী করে তুলেছে উক্ত গবেষণা কাজটি করার জন্য।

৯। কর্মপরিকল্পনা (Work Plan):

কর্মপরিকল্পনায় মুলত সাহিত্য পর্যালোচনা, মাঠকর্ম, তথ্য বিশ্লেষন, খসড়া গবেষণাপত্র তৈরি, মূল গবেষণাপত্র তৈরি এই ৫ টি কার্য সম্পদান করতে কতো সময় লাগবে তার একটি বর্ণনা দিতে হয়। এই পাঁচটি কার্য সম্পন্ন করতে মোট ৫-৬ মাস সময়ের উল্লেখ থাকে। প্রত্যেকটি কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে কতটুকু সময় লাগবে তাও কর্মপরিকল্পনায় নির্ধারন করে দিতে হবে।

১০। অধ্যায় বিভাজন (Chapter Division):

গবেষক তার গবেষণাকর্মটি কয়টি অধ্যায়ে সম্পন্ন করবেন তা এখানে উল্লেখ করবেন। অধ্যায় বিভাজন লেখার ক্ষেত্রে প্রথম অধ্যায় থেকে শুরু করে শেষ অধ্যায় পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম উল্লেখ করতে হবে।

১১। তথ্যসূত্র (Reference):

তথ্যসূত্র বর্ণনায় একজন গবেষক AAA (American Anthropological Association) এবং APA (American Psychological Association)এই দুইটি ধারায় তথ্যসূত্র প্রদান করতে পারেন।

 

একজন গবেষককে তার গবেষণাকর্মের প্রথম ধাপ হিসাবে গবেষণা প্রস্তাব লিখতে হয়। এই গবেষণা প্রস্তাবই বলে দিতে পারে মূল গবেষণার বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, ফলাফল, গবেষণার সময়কাল ইত্যাদি। তাই গবেষণা প্রস্তাবটি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে উল্লেখিত ধাপগুলো অনুসরণ করলে কাংখিত ফলাফল পাওয়া যাবে।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

Crane, J. G. and Michael V. A. (1992). Field Projects in Anthropology: A Student Handbook. Prospect Heights, IL: Waveland Press.

Kumar, R. (2011). Research Methodology: A step-by-step guide for beginners. London: SAGE publications

মাসুম, সেখ গোলাম। কামারান এম কে মন্ডল (২০২১)। সামাজিক গবেষণা পদ্ধতির ভূমিকা। ঢাকাঃ অনিন্দ্য প্রকাশ।

 

 একটি গবেষণা প্রস্তাব লেখার পদ্ধতি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন



সামাজিক গবেষণা পদ্ধতির সহজপাঠ বই থেকে নেয়া।