Friday, August 19, 2022

১৫ আগস্টের শোকাবহ রাত -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

কেঁদেছিল আকাশ, ফুঁপিয়ে ছিল বাতাস। বৃষ্টিতে নয়, ঝড়ে নয়- এ অনুভূতি ছিল পিতা হারানো শোকের। প্রকৃতি কেঁদেছিলো, কারন মানুষ কাঁদতে পারেনি। ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন তাদের কাঁদতে দেয়নি। তবে ভয়াতর বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে এসেছিল চাপা দীর্ঘশ্বাস। কি নিষ্ঠুর, কি ভয়াল, কি ভয়ঙ্কর সেই রাত।
 
১৫ আগস্ট, জাতীয় শোকের দিন। উনিশশত পঁচাত্তরের এই দিনে আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। রাতের শেষে সুবহে সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল তা যেন প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ঘাতকের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোক আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কাল থেকে কালান্তর জ্বলবে এ শোকের আগুন। ১৫ আগস্ট তাই শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন। স্বাধীন বাংলার স্থাপতি ও অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী।
 
১৫ আগস্টের সেই ভয়াল কাল রাতে ঘাতকের বুলেটে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ছোট ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক। একই সময়ে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, তার বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে। বাঙালি জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে সেই রাতের সকল শহীদকে।
 
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারি (রেসিডেন্ট পি.এ) মোহিতুল ইসলাম এর বর্ণনানুসারে, প্রতিদিনের মতো ১৪ আগষ্ট রাত আটটা থেকে ১৫ আগষ্ট সকাল আটটা পর্যন্ত তিনি ডিউটিতে ছিলেন ওই বাড়িতে। ১৪ আগষ্ট রাত বারোটার পর ১৫ আগষ্ট রাত একটায় তিনি তাঁর নির্ধারিত বিছানায় শুতে যান। ভোর সাড়ে চারটা কী পাঁচটার সময় বঙ্গবন্ধু ফোনে আমাকে বললেন, সেরনিয়াতের বাসায় দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করেছে। আমি জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরও পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করলাম। এসময় দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি এসে ওই কক্ষের দেয়ালে লাগল। তখন অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি মহিউদ্দিন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। গুলির তান্ডবে কাঁচের আঘাতে আমার ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এসময় জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়েন। আমিও শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর সাময়িকভাবে গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু বললেন আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি চলছে তোমরা কি কর? এসময় শেখ কামাল বলল আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কালো পোশাক পরা একদল লোক এসে শেখ কামালের সামনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনলাম। এসময় শেখ কামাল গুলি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লেন। আক্রমণকারীদের মধ্যে কালো পোশাকধারী ও খাকি পোশাকধারী ছিল। এসময় আবার আমরা গুলির শব্দ শোনার পর দেখি ডিএসপি নূরুল ইসলাম খানের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আক্রমণকারীরা আর্মির লোক। হত্যাকান্ডের জন্যই তারা এসেছে। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। বিকট শব্দে গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। শুনতে পেলাম মেয়েদের আত্মচিৎকার, আহাজারি। এরইমধ্যে শেখ রাসেল ও কাজের মেয়ে রুমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে মারবেনাতো। আমি বললাম না তোমাকে কিছু বলবে না। কিছুক্ষণ পর রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুমের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলে, অল আর ফিনিশড।’
 
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।
 
পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা অবিস্মরণীয়। সেদিন তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই অমর আহ্বানেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিপীড়িত কোটি বাঙালি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি শুনেছিল মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষণা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।
 
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা একের পর এক চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কয়েকজন সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছে ওই চক্রান্তেরই বাস্তব রূপ দিতে। হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও ভয়ঙ্কর ওই হত্যাকাণ্ডে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা হয়েছে।হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়েছিল।
 
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করে এবং নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ২০০৯ সালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের পাঁচজনের রায় কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। তবে দণ্ড প্রাপ্ত কয়েক খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছেন।
 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মরেও অমর হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন, যতোদিন থাকবে এই ধরনী। তাই অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার ভাষায় বলতে পারি, "যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা গৌরি বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।"
 
১৫ আগস্টের শোকাবহ রাত 
 
 
পত্রিকায় প্রকাশিত লিঙ্কঃ 
 

Monday, August 15, 2022

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন যেভাবে তরুণ মুজিবকে প্রভাবিত করেছিলো -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

     ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন যেভাবে তরুণ মুজিবকে প্রভাবিত করেছিলো
 
প্রাচীন ভারতের পূর্বাংশ জুড়ে যে বাঙালি জন বসতি ছিলো তাই বর্তমানের বাংলাদেশ। পূর্বের এই অংশের ভৌগলিক একাত্মতার কারনে একই সূত্রে আবদ্ধ হয়ে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালা, পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান, সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশ। দীর্ঘ এই কাল পরিক্রমায় এখানে নানান ধরনের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীতে পাল বংশের দ্বারা একটা স্বতন্ত্র বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সত্ত্বা জেগে উঠলেও পরবর্তিতে ঔপনিবেশিক শক্তির আগমন এবং তাদের হস্তক্ষেপের কারনে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যার কারনে শত শত বছর ধরে এই বাংলা বহিরাগতদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে পাল বংশ, সেন বংশ, তুর্কি ও আফগান সুলতানি শাসন, মুঘল সুবাদারি-নবাবী শাসন, ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন, ব্রিটিশ রাজ শাসন, সর্বশেষ পাকিস্তানি শাসন।
 
মধ্যযুগে বহিরাগত মুসলমারা শাসন করলেও এদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা ভালো ও অটুট ছিলো। তাদের সাথে শুধু রাজস্ব দেয়া-নেয়া ছাড়া, শাসক-শাসিতের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্ক ছিলো না। মধ্যযুগের শেষের দিকে এবং আধুনিক যুগের সূচনা লগ্নে পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজ কোম্পানি শাসন ও ব্রিটিশ রাজ শাসনে ভারতবর্ষের বিশেষত বাংলার এই অংশের জন্য ছিল অত্যন্ত ঘটনা বহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ।
 
বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে নীল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিলো বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। এসময়ে ব্রিটিশ শাসনে লুন্ঠন, নির্যাতন থাকলেও ইতিবাচক পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে অনেক। যার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রসার, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার, পাশ্চত্য শিক্ষার প্রসার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছিল অন্যতম। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সচেতনতা ছিলো অত্যন্ত প্রখর। যা সৃষ্টি করেছে নিখিল ভারত কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, দ্বি-জাতি তত্ত্ব, লাহোর প্রস্তাব, লক্ষৌ চুক্তি, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, বেঙ্গল প্যাক্ট, কৃষক-প্রজা আন্দোলন, অখন্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলন এবং সর্বশেষ ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়।
 
এই ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, নেহেরু, জিন্নাহ, সুভাষ বসু, ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর মতো অনেক নেতৃত্বের জন্ম হয়েছে। যাদের হাতেই অখন্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা না পেলেও ভারত বিভক্তি, পাকিস্তানের ভাঙ্গন এবং সর্বশেষ স্বাধনী বাংলাদেশের জন্ম। এই নেতৃবৃন্দের মধ্যে তরুণ নেতৃত্ব শেখ মুজিবুরের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এবং উপমহাদেশে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তখন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম। জন্মের পর থেকেই তিনি ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব দেখেন, জানেন এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবে অধিকার সচেতন হয়ে উঠেন। যা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন চিন্তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকেন।
 
এই আলোচনায় দেখানোর চেষ্টা করা হবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কিভাবে তরুণ মুজিবকে প্রভাবিত করেছে এবং এর মাধ্যমে তার প্রথমদিকের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা কেমন ছিল তা তুলে ধরা। মূলত ঔপনিবেশিক শাসন, বাংলায় এর প্রভাব এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বঙ্গবন্ধুকে কি ভাবে প্রভাবিত করেছে তা জানার চেষ্টা করবো।
 

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রভাব

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের শুরু হলেও ইংরেজদের আগমন হয় ১৬০০ সালের শুরুর দিকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের মধ্য দিয়ে। ইংরেজদের আগে পর্তুগীজ ও ফরাসীরা এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে ছিলো। ইংরেজদের আগমনের ফলে এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয় এবং কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
 
১৬১৩ সালে কোম্পানি প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন সুরাতে। মুসলিম পট্রমে দ্বিতীয় বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয় ১৬১৬ সালে এবং ১৬৩৯ সালে মাদ্রাজে প্রথম দূর্গ স্থাপন করেন। এরপর একে একে হরিপুর, হুগলী, পাটনা, কাশিমবাজার, কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুরে জমিদারি স্বত্ব লাভ করেন ১৬৯০ সালে এবং এ সময়ে মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিনা শুল্কে ব্যবসা করার অনুমতি নেয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে। ১৭১৭ সালে সম্রাট ফররুখ শিয়ার এ টাকা তুলে দিয়ে বিনা শুল্কে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়।
 
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সাথে ইংরেজদের বাণিজ্য নিয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে এবং সিরাজের কাছের লোকদের ষড়যন্ত্রের ফলে পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন হয়, যদিও পুরোপুরি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে আরো সময় লেগেছিল।
 
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভাষা-সাহিত্য, প্রকাশনা, কর্ম-পেশা ও বৃত্তি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা, আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্ক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাবের ফলে সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও রাজনীতি এবং অধিকার সচেতন হয়ে উঠা ভারতবাসীর আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এবং ভারত ও পাকিস্তান নামের দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ দুইশত বছরে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার কারনে ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তি হয় তার কতিপয় হলো-
 
  • ১৭৭৩ সালের ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রণীত 'রেগুলেটিং এ্যাক্ট' এর মাধ্যমে ভারতে ওয়ারেন হেস্টিংসকে গর্ভনর জেনারেল নিয়োগ এবং চার সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টামন্ডলীর বিধান করে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। 

  • ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো বিস্তৃতি লাভ করে এবং এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অনুগত একটা শ্রেণি তৈরি হয়।

  • ১৮৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবে বিবেচিত হয় যার মাধ্যমে ভারতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অবসান হয় এবং ব্রিটিশ মহারানীর সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

  • বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী অনেকগুলো কৃষক বিদ্রোহ এবং সংস্কার আন্দোলন হয়েছে। কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে রয়েছে- ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, রংপুর কৃষক বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন। সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে- বাল্য বিবাহ বন্ধ, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ বিরোধীতা, নারী শিক্ষার প্রচলন।

  • রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গড়ে উঠে কতিপয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে অন্যতম হলো- ১৮৮৫ সালে গঠিত 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস' এবং ১৯০৬ সালে গঠিত 'নিখিল ভারত মুসলিম লীগ'। এই দলগুলোর মাধ্যমেই ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।

 
ব্রিটিশ শাসনের দুইশত বছরে তারা ভারতে বর্ষের সম্পদ লুটপাট, নির্যাতন-নিপীড়ন করলেও ভারতবাসীর জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তা তাদেরকে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেছে। যার ফলেই ১৯৪৭ সালে ভারত, পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।
  

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন বঙ্গবন্ধুর চিন্তাকে যেভাবে প্রভাবিত করে

ব্রিটিশ শাসনের শেষ প্রান্তে বঙ্গবন্ধুর জন্ম। যেই সময়ে উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে এবং তৎকালীন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, যা বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চোতনাকে প্রভাবিত করেছিল তার অল্প বয়সেই। যার কারনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাধারণের জন্য কাজ করে গেছেন এবং ১৯৪৭ সালের ভারত, পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরেও তৎকালিক নেতৃবৃন্দ ও তার ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত ভাগ না হবার কারনে ১৯৭১ সালে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ উপহার দেন। 
 
এই ব্রিটিশ শাসন বঙ্গবন্ধুর সাতাশ বছর বয়সের চিন্তা-চোতনার উপর যেসব প্রভাব বিস্তার করে তার কতিয়প দিক তারই লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র আলোকে আলোচনা করা হলো-
 
১। রাজনৈতিক সচেতনতাঃ বঙ্গবন্ধু যখন ছাত্র ছিলেন সেই সময়ে উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার কারনে ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িয়ে পড়েন। ছাত্র রাজনীতির শুরুতেই সোহরাওয়ার্দীর মতো বড় মাপের রাজনীতিবিদের সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ঘটে এবং সুন্দর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এবং সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসলে সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুল পরিদর্শনে যান এবং বঙ্গবন্ধু তাকে স্বাগত জানায়, সেই সময়ে তার সাথে পরিচয় হয় এবং পরবর্তীতে তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে চিঠি আদান-প্রদান হতো।
 
পাকিস্তান বিভক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ও তার পিতার সাথে মাঝে মধ্যে আলোচনা হতো, যা থেকেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, "অনেক সময় আব্বা আমার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন পাকিস্তান চাই?" এছাড়াও তার বর্ণনায় ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক সচেতনতার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা পাই। বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক কার্যক্রমে তার পিতার সমার্থনের কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাই, "তিনি বলেছেন, দেশের জন্য কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না।"
 
২। অসাম্প্রদায়িকতাঃ ব্রিটিশদের 'ভাগ কর, শাসন কর' নীতি এবং এর ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বঙ্গবন্ধুকে ব্যথিত করে। তাই তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ, দেশ ও রাজনীতির স্বপ্ন তার জীবনের শুরু থেকেই দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, "আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিলনা। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান সবই চলতো।" তার এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেই 'অখন্ড স্বাধীন বাংলা' সমার্থন এবং পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পায়।
 
৩। জনদরদী রাজনীতি ও জনসেবাঃ সমাজসেবা, জনসেবা ছিল বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ঐতিহ্য। ছোটবেলা থেকেই তিনি সমাজের অসহায় সেবা করতেন। যার যেই সমস্যা দেখতেন তিনি সাধ্যমতো তার উপকার করার চেষ্টা করতেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু তার লজিং মাস্টার আব্দুল হামিদের সাথে 'মুসলিম সেবা সমিতি' গঠন করেন এবং পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সাহায্য সংগ্রহ করে অসহায়, যারা স্কুলের খরচ যোগাতে পারতেন না তাদের বইপত্র কিনে দেয়া, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি দিয়ে দিতেন।
 
১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। এ সময়ে সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে লেখাপড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। লঙ্গরখানা খুলে খাবার দিতেন। যার বর্ণনা তার লেখায় পাওয়া যায়।
 
৪। আত্মবিশ্বাস, সততা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতাঃ বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই সাহসী ছিলেন। তার মধ্যে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস, ছিল সততা এবং দূর্রদর্শি চিন্তা-চোতনা। বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় পাওয়া যায়, ছাত্রজীবনে যখন তার সহপাঠী মালেক কে হিন্দু মহাসভার সভাপতির বাড়ি নিয়ে মারধর করে তখন বঙ্গবন্ধু সেখানে গিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলেন কিন্তু না ছেড়ে দিয়ে গালি দেন এবং থানায় গিয়ে পুলিশ নিয়ে এসে হাজির হন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেব এবং শেষ পর্যন্ত তাই করেছিলেন। এখানে যেমন তার সাহসিকতার পরিচয় পাই, তেমনি তার সততার পরিচয় পাই যখন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে আসে তখন বঙ্গবন্ধু কোথাও পালায়নি বরং সততার সাথে বলেছেন, আমার কোন দোষ নেই, আমি কেন পালাবো।
 
তার সাহসিকতার একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৪ সালের ছাত্রলীগের বাৎসরিক সম্মেলনে, যেখানে দেখা পায় পদ বন্টন নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিতর্ক করেছেন। কেননা তার সৎ সাহস ছিলো। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, "শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, "Who are you? you are nobody." আমি বললাম, "If I'm nobody, then why you have invite me? You have no right to insult me. I will prove that I am some body. Thank you Sir. I will never come to you again." এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম।" বঙ্গবন্ধুর এ লেখা থেকে সহজেই অনুমেয় তিনি কতোটা সাহসী এবং দূর্রদর্শি চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তিনি একটা দলের প্রধান হয়ে, একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দিয়েছেন তার সততা, সাহসিকতা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা।
 
৫। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবঃ বঙ্গবন্ধু সব সময়েই সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ বিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি এটা বংশানুক্রমিক পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে রাজনীতি সচেতনতার কারনে বঙ্গবন্ধুর মননে ও চিন্তায় ব্রিটিশ বিরোধী, আধিপত্যবাদ বিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চিন্তা-চোতনা গড়ে উঠেছিলো।
 
৬। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার প্রভাবঃ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট জিন্নাহ 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' পালনের ঘোষণা দিলে শুরু হয় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। এ দাঙ্গায় প্রায় চার হাজার মানুষ মারা যায়। এই দাঙ্গা বঙ্গবন্ধুর মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, "হাসিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায় তোমরা যাবে। তোমরা বলবে আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। আসুন আমরা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে দিনটি পালন করি। ,,,,, কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রোপাগান্ডার কাছে তারা টিকতে পারলো না। হিন্দু সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিল এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।"
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ১৯৪৬ সালের এই দাঙ্গা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্ত এনেছিলো। সে জন্য পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িকতা তার রাজনীতির মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছিল।
 
৭। অসম্পূর্ণ দেশ ভাগ ও বঙ্গবন্ধুর অসন্তুষ্টিঃ ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হয় যে ভারতবর্ষ ভাগ হবে। এর আগে ১৯৪৬ সালেই ইঙ্গিত দেয় যে, ব্রিটিশ সরকার যেকোন ভাবে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কংগ্রেস ভারত ভাগে রাজি হয়েছিল এই কারনে যে বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। এদিকে মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল যে কলকাতা ছাড়া যাবে না। তাই সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে অখন্ড রেখে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বীষবাষ্পে তা-না হয়ে শুধু ধর্মীয় বিবেচনায় বাংলা দুইটি অংশে বিভক্ত হয়। এই সাম্প্রদায়িক বিষয়টা বঙ্গবন্ধুকে মর্মাহত করে। তাই তিনি পরবর্তীতে যে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি করেন তার মূল চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
 
পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাব ছিলো ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই। এই প্রভাবের নেতিবাচক দিক শুরুতে বেশি থাকলেও শেষের দিকে এসে এই অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিকে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ব্রিটিশ শাসন এখানকার নানা ধরনের কুসংস্কার দূর করে সামাজিক সংস্কার সাধন করেছে। রাজনীতি সচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির তৈরি হয়, যারা পরবর্তিতে এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন, দিয়েছেন ভারত বিভক্তির মতো বড় সফলতা।
 
এই ব্রিটিশ শাসন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এসময়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলো বিশেষ প্রভাব ফেলে। তিনি দেখলেন মানুষে মানুষে এতো বিভেদ, এতো হিংসা, এতো রক্তপাত, যার অবসানের স্বপ্ন তিনি সব সময়ে দেখেছেন। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় তার ভূমিকা দেখলে আমরা তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রমাণ পাই।
 
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনদরদী রাজনীতিবিদ। তিনি সর্বদা জনমানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। এই জনদরদী রাজনীতির শিক্ষাও ব্রিটিশ শাসনেরই প্রভাব। ব্রিটিশদের 'ভাগ কর, শাসন কর' নীতি, বিশেষ সুবিধা নেয়ার বিপক্ষে তার অবস্থান ছিল। যার প্রমাণ অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের মধ্যে পাই। এভাবেই ব্রিটিশ শাসনের নানা দিক এবং এই সময়ের রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করেছিলো, যার ফলাফল স্বরুপ এই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
 
তথ্যসূত্রঃ
১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী- শেখ মুজিবুর রহমান।
২। বাংলাদেশের রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন (১৭৫৭-২০০০)- ড. হারুন-অর-রশিদ।
৩। বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ জীবন- শেখ সাদী।
 
 
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন যেভাবে তরুণ মুজিবকে প্রভাবিত করেছিলো 
 
 



 ইতিহাসের খসড়া
মে-জুন, ২০২৩
বর্ষ- ৯ম, সংখা- ৪০
আষাঢ়, ১৪৩০ বাংলা

Friday, August 12, 2022

জহির রায়হান এর 'হাজার বছর ধরে' পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

“জীবনের হাটে সকল বেচাকেনা শেষ করে দিয়ে একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ওরা। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো।

রাত বাড়ছে।

হাজার বছরের পুরানো সেই রাত।”

সেই রাত বাড়ার মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে হাজার বছরের ইতিহাস। এই ইতিহাস গ্রাম-বাংলার সামাজিক ইতিহাস। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার সামাজিক প্রথা, কুসংস্কার, সাংসারিক টানা পোড়ন, নারী নির্যাতন, রোগ-শোক, সামাজিক বন্ধনের মতো বিষয়গুলো। উপন্যাসটি ১৯৬৪ সালে লিখেছিলেন এবং এই বছরই আদমজি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলো উপন্যাসটি। উপন্যাসটি লেখা নিয়ে একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটি হলো, জহির রায়হানের বন্ধু ‘সচিত্র সন্ধানী’-র সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য অনেক দিন ধরে একটা উপন্যাস লিখতে বলতে ছিলো কিন্তু জহির রায়হান সিনেমা তৈরী নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে কোন সময়ই দিতে পারছিল না। তাই গাজী শাহাবুদ্দিন বাধ্য হয়ে শুটিং স্পটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকতো, শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে উপন্যাস লিখতেন। শুটিং এর মধ্যেই উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন। তবে কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে, গাজী শাহাবুদ্দিন তাকে এক সপ্তাহের জন্য জোর করে ধরে নিয়ে এসে একটা রুমে বসে উপন্যাসটি লিখতে বাধ্য করেন এবং বলেন তার যা যা দরকার সব রুমে দেয়া হবে কিন্তু বাইরে যেতে দেয়া হবে না। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন, জহির রায়হান উপন্যাসটি কোন গ্রামে না গিয়ে শহরে বসে অল্প সময়ে লিখে দেন। উল্লেখ্য যে, গাজী শাহাবুদ্দিন এবং জহির রায়হান বন্ধু ছিলেন এবং উপন্যাস লেখার সময় জহির রায়হানের বয়স ছিলো ২৯ বছর।

‘পরীর দীঘি’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। এই পরীর দীঘি হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামস্থ ‘জগন্নাথ দীঘি’। সেই জগন্নাথ দীঘি ও তার পাশের কয়েকটি গ্রাম নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনী। উপন্যাসের চরিত্রগুলো হলো-

  • বুড়ো মকবুল – শিকদার বাড়ির প্রধান ও মুরব্বি
  • আমেনা – বুড়ো মকবুলের প্রথম স্ত্রী
  • ফাতেমা – বুড়ো মকবুলের দ্বিতীয় স্ত্রী
  • টুনি – বুড়ো মকবুলের তৃতীয়া স্ত্রী ও উপন্যাসের নায়িকা
  • মন্তু – উপন্যাসের মূলচরিত্র
  • আম্বিয়া – করিমের বোন, উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে মন্তুর স্ত্রী
  • ফকিরের মা – প্রতিবেশী
  • আবুল – প্রতিবেশী
  • হালিমা – আবুলের স্ত্রী
  • গনু মোল্লা – ধর্মীয় ব্যক্তি (প্রতিবেশী)

উপন্যাসটি প্রধানত তিনটি চরিত্র কেন্দ্রিক হলেও, প্রত্যেকটা চরিত্রের আছে বিশেষ গুরুত্ব । আবুলের কথাই ধরা যাক, যার কাজই ছিলো বউ পেটানো। আবুলের পিটুনি খেয়ে তিনটি বউ আয়েশা, জমিলা আর হালিমা মারা গেলো। যা ততকালীন বাঙ্গালী সমাজেরই চিত্র নয়, নারী নির্যাতনের এমন চিত্র এখনো এই সমাজেও বিদ্যমান, ধরন পাল্টেছে শুধু। গ্রামের ধার্মিক ব্যক্তি ছিলো গনু মোল্লা। মানুষের বিপদে আপদে, ঝাড়-ফুঁকে যাকে সব সময় পাওয়া যেতো। বুড়ো মকবুল তার নারিকেল, সুপারি আর কৃষি জমি নিয়ে জানান দিচ্ছে যে গ্রামীণ জীবন কৃষি নির্ভর এবং সংসার, গৃহস্থী কাজ করেই জীবন চলে। আমেনা, ফাতেমা আর টুনি ছিলো তার হাতিয়ার। আয়ের মাধ্যম ছিলো কৃষি তাই কৃষি কাজেও তিন বউয়ের ডাক পড়ত। তিন বউ, কৃষি আর এক মেয়ে নিয়েই ছিলো মকবুলের সংসার। তবে বুড়ো মকবুলের বউদের দিয়ে কাজ করানোর মধ্য মাঝে মাঝে বাঁধ পরতো ফকিরের মায়ের। কিন্তু বুড়ো মকবুল তা কেয়ার করত না।

মকবুলের ছোট বউ টুনি। উপন্যাসের একটি মূল চরিত্র। যার সাথে ছিলো মন্তুর একটা ভাব। পরকীয়া প্রেমও বলা যেতে পারে একে। টুনি আর মন্তু মকবুলের চোখের আড়ালে দীঘির পাড়ে বসে গল্প করা, রাতের আধাঁরে মাছ ধরতে যাওয়া, শেষ রাতে খেজুর রস চুরি করার সাহস, শাপলার বিলে নৌকায় চড়ে শাপলা তোলা এমন মধুর সময় পাড় করার বর্ণনা এক সুন্দর প্রেমের কাহিনী। আবার আম্বিয়া মন্তুর দিকে চেয়ে তার অপ্রকাশ্য প্রেমের এক প্রকাশ্য রুপ দেখায়, যা ত্রিভূজ প্রেমের দিকে নিয়ে যায় উপন্যাসটিকে।

টুনি, মন্তু আর আম্বিয়ার এই চিত্র দেখে মনে হয়, মন্তুর আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করবে টুনির সনে আর আম্বিয়াকে নিয়ে ঘর বাধবে গহীন বালু চড়ে যা উপন্যাসের শেষে দেখা যায়। বুড়ো মকবুল মারা যাবার পর টুনি এই অনুশোচনায় ভুগতে থাকে যে, বুড়োর মৃত্যুর জন্য টুনিই দায়ী। তাইতো মন্তু তাকে বিয়ে করতে চাইলেও ফিরিয়ে দেয়। মন্তুকে ফিরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আরো একটি বিষয় সামনে আসে যে, ঐ সময়ে বিধবা বিয়ে হলে যে সমাজ এ নিয়ে কটু কথা বলবে, এমন কি তাদের সমাজচ্যুতিও হতে পারে। তাইতো বুড়ো মকবুলের স্মৃতি বুকে নিয়ে টুনি চলে গেলে মন্তু বিয়ে করে আম্বিয়াকে। এভাবেই শেষ হতে থাকে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের কাহিনী।

উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে একান্নবর্তী পরিবার, সমাজের বাস্তব চিত্র। ফুটে উঠেছে গ্রামীণ লোকাচার, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, নানান ধরনের কুসংস্কার, বিশেষ করে ওলা বিবির হাত থেকে বাঁচার জন্য, মনের মানুষকে পাবার জন্য ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজের মতো কর্মকান্ড, নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইত্যাদি।

 হাজার বছর ধরে -- জহির রায়হান 
(পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন)

Wednesday, August 10, 2022

একটি গবেষণা প্রস্তাব লেখার পদ্ধতি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

একটি গবেষণা প্রস্তাব লেখার পদ্ধতি

গবেষণা প্রস্তাব হলো একজন গবেষক যে বিষয়ে গবেষণা করতে চায় তার একটি পরিকল্পিত লিখিত রুপ। যেখানে গবেষণার বিষয়, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, অনুমিত সিদ্ধান্ত, কর্ম পরিকল্পনা ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়ে থাকে। একজন গবেষককে তার গবেষণাকর্ম শুরুর পূর্বে গবেষণা প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হয়। একজন নতুন গবেষকের গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকলেও প্রথম বাধার সম্মুখীন হতে হয় এই গবেষণা প্রস্তাব লেখা নিয়ে। কেননা, গবেষণা প্রস্তাব লেখার বিশেষ কিছু নিয়ম ও ধাপ অনুসরণ করতে হয়। গবেষণা প্রস্তাব লেখার এই পদ্ধতি নিয়েই আজকের আলোচনা।

১। শিরোনাম (Title):

শিরোনাম দ্বারা আপনার কাজ কোন বিষয়ে এবং আপনি আপনার কাজে কি কি বিষয়ে তুলে ধরতে চান তার একটি সামগ্রিক ধারনা পাওয়া যাবে। আরো সহজ করে বললে বলা যায় যে, আপনার গবেষনার ঊদ্দেশ্য সমূহের স্পষ্ট প্রতিফলন হবে শিরোনামে। গবেষণার শিরোনাম এমন হতে হবে যাতে শিরনামকে ভাঙ্গলে গবেষণার উদ্দেশ্য পাওয়া যায় আবার গবেষণার উদ্দেশ্য সমূহকে জোড়া দিলে শিরোনাম পাওয়া যায়। তাই শিরোনাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে দুইটি পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। প্রথমত, সাহিত্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে ঊদ্দেশ্য নির্ধারন করে গবেষণার একটি প্রাথমিক শিরোনাম দেয়া যেতে পারে । যা পরবর্তী  কাজের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে। আর দ্বিতীয়ত হল সব কাজ শেষ করার পর কাজের সাথে সংশ্লিষ্টতা রেখে একটি শিরোনাম দেয়া। তবে শিরোনাম হতে হবে সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থবহ। শিরোনাম মূলত ১৪ -১৮ শব্দের মধ্যে হতে হয়। শিরোনাম দুইভাবে লেখা যেতে পারে। প্রথমটি হল, এক লাইনে পুরো শিরোনাম দিয়ে দেয়া। আর অন্যটি হল কোলন ( : ) ব্যবহারের মাধ্যমে শিরোনামকে দুইভাগে ভাগ করে লেখা। একটি বিষয় লক্ষনীয় কোলন ( : ) ব্যবহারের পর কখনো প্রেক্ষিত শব্দটি ব্যবহার না করাই উচিত। কারন কোলন ( : ) এবং প্রেক্ষিতএর অর্থ একই। সবশেষ কথা, শিরোনাম হবে মূলত আপনার গবেষণার মূলবিষয় সূচক শব্দের (Keyword) সংমিশ্রণ।

২। ভূমিকা (Introduction):

গবেষণা প্রস্তাবনার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ন ধাপ হলো ভূমিকা। এই ভূমিকার মাধ্যমে একজন পাঠক আপনার গবেষণা সম্পর্কে স্পস্ট ধারনা লাভ করতে পারবেন। তাই এই ভূমিকা অংশটি অত্যন্ত যত্নের সাথে লেখা উচিত এবং সবার শেষে লেখা উচিত। ভূমিকা অংশটি যতটুকু পারা যায় সহজ ও সরল রাখতে হবে যাতে কেউ তা পড়া মাত্র বুঝে যেতে পারে। তাই ভূমিকা লিখতে যে যে বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলোঃ প্রথমত, শুরুতেই আপনার গবেষণার জন্য নির্বাচিত বিষয়ের একটি সার্বজনীন ধারনা দিতে হবে। ধরুন, কেউ উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চায় , তাহলে তাকে দেখাতে হবে বিশ্বব্যাপি উচ্চ শিক্ষাকে কিভাবে দেখা হচ্ছে এবং ইহার বর্তমান অবস্থা কি তা তুলে ধরতে হবে। ঠিক এরপরেই চলে আসতে হবে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার বর্তমান অবস্থা কিরূপ তার একটি সার্বিক ধারনা দিতে হবে। ঠিক এরপরেই গবেষণার জন্য যে যে উদ্দেশ্য নির্ধারন করা হয়েছে তার সাথে বর্তমান অবস্থার কি কি ধরনের সামঞ্জস্যতা এবং ার্থক্য রয়েছে তা দেখাতে হবে এবং একই সাথে যে বিষয়ে জোড় (Focus) দেয়া হয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে। উদ্দেশ্যর সাথে সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের সম্পর্ক আলোচনা করতে হবে। আর এই সার্বিক ধারনা, সামঞ্জস্যতা ও পার্থক্য - এইসব কিছু সাহিত্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে দিতে হবে। তথ্যসূত্র উল্লেখপূর্বক আপনাকে আপনার যুক্তি প্রদর্শন করতে হবে। মোটকথা, ভূমিকা হবে গবেষণা প্রস্তাবটির সারসংক্ষেপ।

৩। বিষয় বিবৃতিকরন বা সমস্যা নির্ধারণ (Statement of the Problem / Issue):

একজন গবেষক যে বিষয়ে গবেষণা করবেন তার সামাজিক প্রেক্ষাপট কিরূপ এবং বর্তমানে তার অবস্থা কি, এই সংক্রান্ত কি কি তথ্য/ উপাত্ত রয়েছে এসব যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে এই অংশে। গবেষণার বিষয়টি কি সামাজিক সমস্যা নাকি এমন এক সামাজিক বিষয় যা কিনা সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দিক এবং যে বিষয়ের দিকে নজর দেয়া উচিত এবং যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সে বিষয়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরাটা জরুরি। এই সকল আলোচনা থাকবে এই অংশে।

গবেষণার উদ্দেশ্য (Research Objectives):

গবেষণার উদ্দেশ্য হল গবেষণার প্রাণ। গবেষণার উদ্দেশ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুইটি পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমত, গবেষণার যে বিষয় নির্বাচন করা হবে সে বিষয়ের ক্ষেত্রে কি কি বিষয় দেখতে চাওয়া হবে তা উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহন করাদ্বিতীয়ত, সাহিত্য পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যে সব রিসার্চ গ্যাপ পাওয়া গিয়েছে সেগুলোকে গবেষণার উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারন করা যেতে পারে। তবে যে পদ্ধতিতেই গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারন করা হোক না কেন, উদ্দেশ্য দ্বারা যাতে গবেষণার নির্ধারিত বিষয়ের উপর নতুন নতুন দিক উঠে আসে সেদিকে নজর দিতে হবে। গবেষণার উদ্দেশ্য হতে হবে খুব স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট। গবেষণার উদ্দেশ্য নির্বাচনের দুইটি পন্থা আছে। প্রথম পন্থা হল একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য ( Broad Objective) এবং দ্বিতীয়টি হল, ৩-৫ টি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য (Specific Objective) নিয়ে কাজ করা। 

৫। সাহিত্য পর্যালোচনা (Literature Review):

একটি গবেষণা শুরু করার জন্য সাহিত্য পর্যালোচনা অতীব জরুরি। গবেষণা শুরু পূর্বে গবেষককে বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে আর এই কার্যটি সর্বপ্রথমে করতে হয়। সাহিত্য পর্যালচনার জন্য একজন গবেষককে যা করতে হবে-

(I)     গবেষককে গবেষণার বিষয় সংশ্লিষ্ট সাহিত্য খুঁজে বের করতে হবে। সেটি হতে পারে বই, জার্নাল, আর্টিকেল, পত্রিকার লেখনী, ওয়েবসাইট, তথ্যচিত্র ইত্যাদি।

(II)     যে কোন সাহিত্য পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যে সব বিষয় লক্ষ্য করতে হবে তা হল - সাহিত্যটির উদ্দেশ্যসমূহ কি কি, কোন গবেষনা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, কোন তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কি ধরনের ফলাফল এসেছে, কোন রিসার্চ গ্যাপ আছে কি না। এই সব বিষয়কে গবেষককে গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত করে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হবে।

(III)   সাহিত্য পর্যালোচনার মূল উদ্দেশ্য হল আপনার গবেষনার বিষয় সম্পর্কে খুব ভালভাবে জানা। তাই যত বেশি সাহিত্য পর্যালোচনা করা যায় তত ভাল। সাধারণত গবেষনা প্রস্তাবনায় সাহিত্য পর্যালোচনা ৫-৬ টি দিলেই যথেষ্ট।

৬। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট (Theoretical Framework):

তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট মূলত গবেষকের গবেষণা ও গবেষণা প্রস্তাবনাকে একটি বৈধতা (Valid Platform) প্রদান করে। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট প্রদানের পূর্বে যে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল, গবেষক যে তত্ত্ব ব্যবহার করবেন তা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা থাকতে হবে এবং তত্ত্বটি গবেষণা বিষয়ের সাথে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত তাও জানতে হবে। গবেষক যে ধরনের তত্ত্বই ব্যবহার করুক না কেন যখনই তিনি তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট লিখবেন তখন তাকে তিনটি ধাপ মেনে চলতে হবে।

(I)      গবেষক যে তত্ত্ব ব্যবহার করবেন সে তত্ত্বটি তিনি তাত্ত্বিকের ভাষায় বয়ান করবেন

(II)     এই তত্ত্বের ক্ষেত্রে গবেষকের যে বোধগম্যতা (Understanding) তা বয়ান করবেন এবং

(III)   এই তত্ত্বটি গবেষকের বিষয়ের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত এবং কিভাবে এই তত্ত্ব দিয়ে গবেষকের গবেষণার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাবে তা তুলে ধরতে হবে।

তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে কয়টি তত্ত্ব দেয়া যাবে এরকম প্রশ্ন প্রায় সবার মনে আসে। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে গবেষক একটি থেকে সর্বোচ্চ তিনটি তত্ত্ব দিতে পারবেন। যত তত্ত্ব ব্যবহার কম হবে গবেষকের জন্য তত সুবিধা, কারন যত বেশি তত্ত্ব দিবেন গবেষকের বিষয়টি ব্যাখা করার ক্ষেত্রে তত বেশি অসুবিধা । 

৭। গবেষনা পদ্ধতি (Research Methodology):

গবেষণা পদ্ধতির ক্ষেত্রে গবেষককে যে সব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে তা হলো সঠিক গবেষণা যন্ত্র ও কৌশল (Research Tool & Techniques)। গবেষণার দুইটি ধারা আছে। যথাঃ গুনগত (Qualitative Approach) ও পরিমাণগত (Quantitative Approach)এখন গবেষক যদি গবেষণার জন্য গুনগত ধারা নির্ধারিত করলেন কিন্তু নির্বাচন করলেন পরিমানগত ধারার গবেষণা যন্ত্র ও কৌশল তবে তা বড় ভুল হিসেবে হবে এবং গবেষণা প্রস্তাবনাটি বাতিল হয়ে যাবে। একটি গুনগত ধারার গবেষণা পদ্ধতিতে যে সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে তা হলো-

গবেষনা প্রস্তাবনার গবেষনা পদ্ধতি অংশে যা যা বিষয় থাকবে

·   গবেষণার এলাকা নির্বাচন (Research Area)

·   নমুনা নির্বাচন (Sampling) 

গুনগত ধারায় গবেষণায় নমুনার আকার (Sample Size) ১ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০ জন পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে ৩০-৩৫ জন হল আদর্শ নমুনার আকার (Sample size)

·   তথ্য উৎ (Sources of Data) 

                               I. মুখ্য উপাত্ত (Primary Data)

                              II. গৌন উপাত্ত (Secondary Data)

মুখ্য উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষন (Observation), নিবিড় সাক্ষাৎকার (In-depth Interview), মূল তথ্যদাতা সাক্ষাৎকার (Key Informant Interview), ফোকাস বা দলগত আলোচনা (Focus/Group discussion), কেস স্টাডি (Case Study) এই ৫ টি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

গৌণ উপাত্তের ক্ষেত্রে আসবে বিভিন্ন বই, জার্নাল, আর্টিকেল, পত্রিকার লেখনী, ওয়েবসাইট, তথ্যচিত্র ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

·   ব্যবহৃত পরিসংখ্যানগত কৌশল (Used statistical strategies) 

৮। গবেষনার যৌক্তিকতা (Research Rationality):

এই অংশে মূলত গবেষক যেই বিষয়ে গবেষণা করতে চায় কেন সে এই বিষয়ে আগ্রহী, কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতার কারনে গবেষক এই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন এবং এই বিষয়ে কাজ করার ফলে গবেষক নিজে ও অন্যান্যরা কিভাবে লাভবান হবে তা লিখতে হবে। এই যৌক্তিকতা লিখতে হলে গবেষককে কিছু যুক্তি প্রদর্শন, যেমনঃ গবেষণার বিষয় সম্পর্কিত সাম্প্রতিক কিছু তথ্য/ উপাত্ত দেখাতে হবে যা গবেষককে আগ্রহী করে তুলেছে উক্ত গবেষণা কাজটি করার জন্য।

৯। কর্মপরিকল্পনা (Work Plan):

কর্মপরিকল্পনায় মুলত সাহিত্য পর্যালোচনা, মাঠকর্ম, তথ্য বিশ্লেষন, খসড়া গবেষণাপত্র তৈরি, মূল গবেষণাপত্র তৈরি এই ৫ টি কার্য সম্পদান করতে কতো সময় লাগবে তার একটি বর্ণনা দিতে হয়। এই পাঁচটি কার্য সম্পন্ন করতে মোট ৫-৬ মাস সময়ের উল্লেখ থাকে। প্রত্যেকটি কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে কতটুকু সময় লাগবে তাও কর্মপরিকল্পনায় নির্ধারন করে দিতে হবে।

১০। অধ্যায় বিভাজন (Chapter Division):

গবেষক তার গবেষণাকর্মটি কয়টি অধ্যায়ে সম্পন্ন করবেন তা এখানে উল্লেখ করবেন। অধ্যায় বিভাজন লেখার ক্ষেত্রে প্রথম অধ্যায় থেকে শুরু করে শেষ অধ্যায় পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম উল্লেখ করতে হবে।

১১। তথ্যসূত্র (Reference):

তথ্যসূত্র বর্ণনায় একজন গবেষক AAA (American Anthropological Association) এবং APA (American Psychological Association)এই দুইটি ধারায় তথ্যসূত্র প্রদান করতে পারেন।

 

একজন গবেষককে তার গবেষণাকর্মের প্রথম ধাপ হিসাবে গবেষণা প্রস্তাব লিখতে হয়। এই গবেষণা প্রস্তাবই বলে দিতে পারে মূল গবেষণার বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, ফলাফল, গবেষণার সময়কাল ইত্যাদি। তাই গবেষণা প্রস্তাবটি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে উল্লেখিত ধাপগুলো অনুসরণ করলে কাংখিত ফলাফল পাওয়া যাবে।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

Crane, J. G. and Michael V. A. (1992). Field Projects in Anthropology: A Student Handbook. Prospect Heights, IL: Waveland Press.

Kumar, R. (2011). Research Methodology: A step-by-step guide for beginners. London: SAGE publications

মাসুম, সেখ গোলাম। কামারান এম কে মন্ডল (২০২১)। সামাজিক গবেষণা পদ্ধতির ভূমিকা। ঢাকাঃ অনিন্দ্য প্রকাশ।

 

 একটি গবেষণা প্রস্তাব লেখার পদ্ধতি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন



সামাজিক গবেষণা পদ্ধতির সহজপাঠ বই থেকে নেয়া।