Sunday, March 30, 2025
ঈদ মাসের বেতন বোনাস এবং গার্মেন্টস মালিক -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
মালিকানা বৃদ্ধি পাবে তাই তো মালিক টাকা বিনিয়োগ করে এ কথা সত্য, তবে মনে রাখতে হবে বিনিয়োগের টাকার সাথে শ্রমিক তার শ্রম বিনিয়োগ করে তাই মুনাফার অংশ তাদেরও প্রাপ্য। মুনাফার অংশ না দিক শ্রমের বিনিময় মূল্য তো সঠিকভাবে সঠিক সময়ে দিয়ে দিবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ভাতা সঠিক সময়ে দিতে সমস্যা কোথায়? অন্যান্য সময় এ নিয়ে তেমন কোন কথা না শুনলেও প্রতি ঈদের সময় এই সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করে। কিন্তু কেন?
প্রতি ঈদের সময়ই শ্রমিকদের বেতন দেয়া, বোনাস দেয়া নিয়ে প্রকট সমস্যা দেখা দেয়। যেটাকে আমার কাছে মনে হয় অনেকটা ইচ্ছাকৃত। কেননা বছরের দুই ঈদ বাদে তো এমন সমস্যার খবর দেখতে পাইনা। তাহলে কি মালিকপক্ষ এটা ইচ্ছাকৃত করেন? আমার কাছে তো তাই মনে হয়। আমার ধারণা সরকার থেকে বিশেষ প্রণোদনা কিন্তু অন্য কোন উপায়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য এমন নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। কেননা, প্রতি বছরই দেখা যায় গার্মেন্টস মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে পারবে না কিংবা আংশিক দিবে বলে তারা ঠিকই আনন্দ ভ্রমণে, ওমরাহ্ পালন করতে কিংবা ঈদ শপিং করতে বিদেশ চলে যায়। তাদের এই টাকা আসে কোথা থেকে? কেউ কি জানতে চেয়েছেন।
যাইহোক, সামনে আসছে ঈদ। এই ঈদেও শ্রমিকদের চোখের জল দেখতে হচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয়। আশাকরি সরকার এই বিষয়ে কঠোর হবেন এবং ঈদের আগেই শ্রমিকদের বেতন বোনাস পাবার ব্যবস্থা করে সাধারণ শ্রমিকের মুখে হাসি ফুটাবেন।
Sunday, March 23, 2025
রমাযানের শেষ দশকের আমলঃ লাইলাতুল কদর -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘নিশ্চয়ই আমি নাযিল করেছি এ কুরআন মহিমান্বিত রাত্রিতে। আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত্রি কী? মহিমান্বিত রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাত্রে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ এবং রূহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাত্রি শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত।’’ (আল-কদরঃ ১-৫)
এখানে মহিমান্বিত রাত্রি বলতে লাইলাতুল কদরের কথা বলা হয়েছে, যা পবিত্র রমাযানের শেষ দশক তথা নাজাতের দশ রাতের কোন এক রাত্রিতে রয়েছে। তাই রমাযানের শেষ দশকের আমলে একটা অন্যতম আমল হলো লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে বেশি বেশি ইবাদাত করা। লাইলাতুল কদরের রাত্রি রমযানের কোন তারিখে এবং এই রাত্রিতে ইবাদাতের ফযিলত কি এই সম্পর্কে সহহী বুখারী শরীফের কতিপয় হাদিস নিয়ে আলোচনা করা হলো।
উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লাইলাতুল কদরের (নির্দিষ্ট তারিখ) অবহিত করার জন্য বের হয়েছিলেন। তখন দু’জন মুসলিম ঝগড়া করছিল। তা দেখে তিনি বললেনঃ আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সংবাদ দিবার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন অমুক অমুক ঝগড়া করছিল, ফলে তার (নির্দিষ্ট তারিখের) পরিচয় হারিয়ে যায়। সম্ভবতঃ এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তা তালাশ কর। (৪৯) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৯৩)
‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রমাযানের শেষ দশক আসত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (মুসলিম ১৪/৩, হাঃ ১১৭৪) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৯৪)
ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নের মাধ্যমে রমাযানের শেষের সাত রাত্রে লাইলাতুল ক্বদর দেখানো হয়। (এ শুনে) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে। (১১৫৮, মুসলিম ১৩/৪০, হাঃ ১১৬৫, আহমাদ ৪৫৪৭) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৫)
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তা শেষ দশকে, তা অতিবাহিত নবম রাতে অথবা অবশিষ্ট সপ্তম রাতে অর্থাৎ লাইলাতুল কদর [ক্বদর]। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে অন্য সূত্রে বর্ণিত যে, তোমরা ২৪তম রাতে তালাশ কর। (২০২১) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৯২)
‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা রমাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর। (২০১৭) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৯০)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রমাযানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় সওম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। সুলায়মান ইবনু কাসীর (রহ.) যুহরী (রহ.) হতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। (৩৫) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৪)
পরিশেষে বলা যায়, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের সূরা ক্বদরে ঘোষণা করেছেন- লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের (ইবাদাতের) চেয়েও উত্তম। সহীহ শুদ্ধ হাদীস থেকে জানা যায় যে, লাইলাতুল ক্বদর রমাযানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে লাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদীসে এ কথাও উল্লেখিত আছে, যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিজোড় রাত্রিতেই তা হয় না। (অর্থাৎ কোন বছর ২৫ তারিখে হল, আবার কোন বছর ২১ তারিখে হল এভাবে। আমাদের দেশে সরকারী আর বেসরকারীভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এভাবে মাত্র একটি রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদর সাব্যস্ত করার কোনই হাদীস নাই। লাইলাতুল ক্বদরের সওয়াব পেতে চাইলে ৫টি বিজোড় রাত্রেই তালাশ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে লাইলাতুল ক্বদরের সওয়াব পেতে সঠিক রাত্রিতে ইবাদাত করার সুযোগ দান করুন এবং আমাদের রমযান ও রমযান মাসের সকল ইবাদাত কবুল করুন। আমীন।
Monday, January 13, 2025
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটঃ ১৯৩৭-৪৭ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটঃ ১৯৩৭-৪৭
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের শেষের দিকে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে তাদের শাসন গুটিয়ে নেয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। এই সময়ের গুরুত্ব আরো যে কারনে বেশি তা হলো- মুসলিম কৃষক শ্রমিকের জাগরণ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বাঙালি মুসলমানের ভিন্ন আত্মপরিচয়ের ব্যবহার, যা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে কাজ করেছিলো।
এই সময়ে বাঙালি মুসলিম আত্মপরিচয়ের বিষয়টা সামনে উঠে আসার পিছনে আরো কতিপয় ঘটনা প্রবাহ রয়েছ। ১৯০৬ সালে পত্তন হওয়া মুসলিম লীগ, ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি, ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট, ১৯২৭ সালের সাইমন কমিশনের রিপোর্ট, তৎপর নেহেরু রিপোর্ট, জিন্নাহর ১৪ দফা প্রস্তাব, ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস থেকে ওয়ার্কআউট, ১৯২৯ সর্বভারতীয় মুসলিম কনফারেন্সে প্রথম নির্বাচন বলবৎ, ১৯৩০-৩৩ এ রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান, মুসলিম মানসিকতা ও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার গতি ও পথ পরিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে একটা আভাস পাওয়া যায়।(১)
১৯৩৭-৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলো অবাঙালি মুসলমানদের হাতে। যার কারনে এই সময়ের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিম পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় থাকা, কিংবা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা থাকার পরেও বাঙালি মুসলমানরা এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটের মধ্যে পরে। এই মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট এবং আত্মপরিচয় সম্পর্কে আজকের আলোচনা।
প্রথমে বাঙালির একটা পরিচয় জানার চেষ্টা করি। বাঙালি জাতি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর নাম। যারা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মনিপুরের কিছু অংশ জুড়ে রয়েছে। এরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চাও বাংলা ভাষাতেই করে থাকে। ধর্মীয় অনুষঙ্গ এবং অনুশীলনের দিক থেকে বাঙালিদের প্রায় ৬৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে বাঙালিদের ধর্মীয় বৈচিত্র্য অনেক বেশি। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অনেক ধর্মের লোকের অবস্থান রয়েছে। তবে তারা হলো সংখ্যালঘু। বঙ্গ সভ্যতার ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো এবং ভারতবর্ষে বাঙালিদের শাসনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছরের, যার মধ্যে বাঙালি হিন্দু শাসন এবং অবাঙালি মুসলিম শাসন উভয়ই রয়েছে। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচার, জীবন প্রণালী, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালির একটা ভিন্ন পরিচয় স্বমহিমায় দীর্ঘ সময় ধরে রয়েছে।
মুসলিম আত্মপরিচয়ের কথা তুললে বলা যায় ইসলাম হলো মুসলমানের মূল পরিচয়। তবে আত্মপরিচয় হলো ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়। ব্যক্তির একাধিক আত্মপরিচয় থাকতে পারে। প্রথমে সে মানুষ, এরপরে আসে ধর্মীয় পরিচয়-হিন্দু, মুসলমান বা অন্য ধর্মাবলম্বী, এর সাথে যোগ হয় জাতিগত পরিচয়- বাঙালি, অবাঙালি ইত্যাদি পরিচয়। ভারতবর্ষের বিশেষ করে এই উত্তর অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমান, কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ইসলাম এই অঞ্চলে এসেছিল অবাঙালি মুসলমানদের হাত ধরেই। আর এ কারনেই মুসলমানদের মধ্যে তাদের আত্মপরিচয়ের একটা সংকট দেখা দিয়েছিলো। কেননা বাঙালি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করতেছিলো অবাঙালি মুসলমানরা। যখন বাঙালি মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে পৌছে যায় তখন বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের বিষয়টা সবার সামনে চলে আসে। যা ব্রিটিশ শাসনের আগে তেমন ছিলো না, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষ দিকে এসে তা প্রবল রুপ ধারণ করে।
আলোচনার মূল সময়কাল ১৯৩৭-৪৭ সাল হলেও একটু পিছনে ফিরলে দেখতে পাই ১৮৭২ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষে প্রথম আদমশুমারি বা জনগণনা শুরু করে তখন ভারতবাসীর যে দীর্ঘ দিনের ধারনা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাতে অবাক করার মতো ভিন্ন তথ্য দেখা যায়। তৎকালীন বাংলার রাজনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিলো কলকাতা কেন্দ্রিক এবং এখানে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিলো। মুসলমানরা ইংরেজপূর্ব শাসনকেন্দ্র মুর্শিদাবাদ ও উত্তরবঙ্গে কিছুটা প্রভাবশালী ছিলো। কিন্তু জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের অবাক করা তথ্য বের হলে ইংরেজ কর্মকর্তা জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, "১৮৭২ সালের সেনশাসে সবথেকে বেশি ইন্টেরেস্টিং আবিস্কার ছিলো মুসলমানদের পুরানো রাজধানীর বদলে নিম্ন বঙ্গের পাললিক ভূমিতে বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা।" এই তথ্য মুসলমানদের আত্মপরিচয় ও তাদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে নতুন করে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবায়।
দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে এতো মুসলমান কোথা থেকে আসলো এই নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হয়। বাংলায় মুসলমানদের শাসনকেন্দ্রের বাইরে কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলো তা ব্যাখ্যা করতে বিভারলি (সেনশাসের মূল গণনাকারী) বলেন, "মুঘল রক্ত নয়, বরং নিম্নবর্ণের অধিবাসীরা হিন্দু ধর্মের কঠোর বর্ণপ্রথা থেকে ইসলাম ধর্মে কনভার্ট করেছে।"(২) অর্থাৎ তিনি মুসলমানদের মাইগ্রেশন তত্ত্বকে বাদ দিয়ে সামাজিক মুক্তি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। কিন্তু মুসলমানরা এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, মুসলমানরা নিম্নজাত থেকে ধর্মান্তরিত হয়নি বরং তারা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছে এবং তাদের বহুবিবাহ, উচ্চ জন্মহার প্রভৃতির কারনে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমানদের এই আত্মপরিচয়ের বির্তককে ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থে এবং তাদের 'ভাগ কর, শাসন কর' নীতিতে আরো চাঙ্গা করে রেখেছিল।
এদিকে উনিশ শতকে যখন বাঙালিদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু হয় তখন বাঙালি মুসলমানরা তাদের আত্মপরিচয় দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিকূল অবস্থার কারনে। এ সময়ে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানদের এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তৈরি হয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব। এই সমস্যার মূলে ছিলো ধর্ম, যা আবার ভাষাকেও প্রভাবিত করেছিলো। এই ভাষা ভিত্তিক আত্মপরিচয় শুধু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যেই সংকট তৈরি করেনি, বরং তা মুসলমানদের মধ্যেও সংকটের সৃষ্টি করে। কেননা, "ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, ঐতিহ্য এক ও অভিন্ন ছিলো না। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের সাথে অবাঙালি মুসলমানদের এসব বিষয়ে ভিন্নতা সুস্পষ্ট।"(৩) তাই বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্রতার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলো।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৯০৬ সালে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। সেই সময়ের কনফারেন্সে বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম কি হওয়া উচিত? উর্দু, ফার্সী না বাংলা এমন বির্তক দেখা দিলে পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রতিনিধি মৌলভী আব্দুল করিম বাংলার সমার্থনে যুক্তি দেন এই ভাবে, "পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া আদৌ নিজেদের ভাবতে পারেনা। উর্দু ও ফারসি ভাষা ছাড়াও তারা চলতে পারে। আমি মনে করি, তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব সংরক্ষণের প্রয়োজনেই এ নীতি অবলম্বন আবশ্যক।"(৪) ১৯১১ সালে হিন্দুদের তথা অখন্ড বাংলা দাবীকারীদের আন্দোলনের মূল কারণ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যকার ভয় যে, ক্ষমতা মুসলমানদের হস্তগত হয়ে যাবে। যদি হিন্দু নেতারা এই সময়ে একটু বাস্তববাদী চিন্তা করতো তাহলে হয়তো পরবর্তী ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য রকম হতে পারতো।
বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলার মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সময়ে মুসলমানরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরিতে সক্ষম হয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের একটা প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে এতোদিনকার অবাঙালিদের মুসলিম রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও কৃষক শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ কে ফজলুল হক এই শ্রেণির নেতৃত্বে আসেন। বলা হয়ে থাকে, "বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে ফজলুল হক ছিলেন অর্ধ শতাব্দীর সূর্য ও বহু উত্থান-পতনের মহানায়ক।"(৫)
১৯৩৪ সালের শেষের দিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লন্ডন থেকে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে এসে মুসলিম লীগের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সফরের মাধ্যমে দল গঠনে মনযোগী হয়ে পরেন। তবে ১৯৩৭ সালে দলের কাউন্সিলে জিন্নাহ দলীয় যোগাযোগের জন্য উর্দু ভাষা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিলে ফজলুল হক তার একশত ডেলিগেট নিয়ে এর বিরোধিতা করলে ঐ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এভাবেও বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অবাঙালি মুসলমানদের কারনে সংকটের মুখে পরে যায়।
মুসলিম লীগ রাজনীতিতে জিন্নাহর সাথে শেরে বাংলার নানান ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে মত বিরোধ তৈরি হতো। এ সময়ে দলের অন্য নেতারা তাকে সমার্থন না করার কারনে এবং জিন্নাহর কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য দলের জেনারেল সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খানকে চিঠি লিখে ফজলুল হক বলেন, "ভারতের মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের অধিক। অথচ সেই অনুযায়ী বাংলার প্রতি বাইরের নেতৃত্ব গুরুত্বারোপ করেনা,,,,। আমি বাংলার ৩৩ মিলিয়ন মুসলমানের ভাগ্যের ওপর বাইরের কোন নেতৃত্বকে কর্তৃত্ব করতে দেবনা।"(৬)
১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাঙালি মুসলমান এবং বাংলার রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা সরকার গঠন করে। যদিও এই নির্বাচনে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে কংগ্রেস ৬০ টি আসন, মুসলিম লীগ ৩৮ টি, প্রজা পার্টি ৩৯ টি এবং স্বতন্ত্র ৩৭ টি আসন থেকে ২১ টি মুসলিম লীগে ও ১৬ টি প্রজা পার্টিতে অংশ নেয়। সর্বাধিক আসন পাওয়া কংগ্রেসকে মন্ত্রীসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানালে শরৎ বসু সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। তাই প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা গঠনের চেষ্টাও ব্যর্থ হলে শেরে বাংলা সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করে। এতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আবার মন্ত্রীসভা গঠনের অল্পদিনের মধ্যেই ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করে তার সভাপতি নির্বাচিত হন। সোহরাওয়ার্দী নির্বাচিত হয় দলের সাধারণ সম্পাদক। দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের দুই নেতার সমন্বয়ে মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা দিতে সক্ষম হয়। এছাড়াও মন্ত্রীসভা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যার মধ্যে রয়েছে- ১৯৩৮ সালের 'ঋন সালিশি বোর্ড' স্থাপন, ১৯৩৯ সালের 'প্রজাস্বত্ব আইন', 'কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন' সংশোধন, ১৯৪০ সালের 'মহাজনি আইন' পাশ হয়। প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে স্কুল বোর্ড গঠন ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন বিল আনায়ন করা হয়।
নির্বাচনের আগের ও পরের আচরণ জিন্নাহর কাছে বিশ্বাস ভঙ্গ মনে হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী জিন্নাহ আস্থা হারায় এবং ১৯৪০ সালে তার 'দ্বি-জাতি' তত্ত্ব ঘোষণা করেন। ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যকার দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। আবার বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্কও সংকটে পরে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় বেশি সংকটে পরে যায়। কেননা বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে অবাঙালিরা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো এবং তাদের আত্মপরিচয় বাঙালি মুসলমান নয়, শুধু মুসলমান এটা দেয়ার চেষ্টা করতো। উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থে জিন্নাহ 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' ঘোষণা করলে বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা করে এবং এই চিন্তার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিলে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। যা মুসলমানদের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে, স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। ফলে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়।(৭) তবে বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের রাষ্ট্রচিন্তা থেকে ভিন্ন ছিলো। বাঙালি মুসলমানরা শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্র নয়, তাদের জন্য অখন্ড বাংলা রাষ্ট্রের চিন্তা করতেন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাঙালি মুসলমান এবং বাংলার রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা সরকার গঠন করে। যদিও এই নির্বাচনে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে কংগ্রেস ৬০ টি আসন, মুসলিম লীগ ৩৮ টি, প্রজা পার্টি ৩৯ টি এবং স্বতন্ত্র ৩৭ টি আসন থেকে ২১ টি মুসলিম লীগে ও ১৬ টি প্রজা পার্টিতে অংশ নেয়। সর্বাধিক আসন পাওয়া কংগ্রেসকে মন্ত্রীসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানালে শরৎ বসু সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। তাই প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা গঠনের চেষ্টাও ব্যর্থ হলে শেরে বাংলা সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করে। এতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আবার মন্ত্রীসভা গঠনের অল্পদিনের মধ্যেই ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করে তার সভাপতি নির্বাচিত হন। সোহরাওয়ার্দী নির্বাচিত হয় দলের সাধারণ সম্পাদক। দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের দুই নেতার সমন্বয়ে মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা দিতে সক্ষম হয়। এছাড়াও মন্ত্রীসভা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যার মধ্যে রয়েছে- ১৯৩৮ সালের 'ঋন সালিশি বোর্ড' স্থাপন, ১৯৩৯ সালের 'প্রজাস্বত্ব আইন', 'কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন' সংশোধন, ১৯৪০ সালের 'মহাজনি আইন' পাশ হয়। প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে স্কুল বোর্ড গঠন ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন বিল আনায়ন করা হয়।
নির্বাচনের আগের ও পরের আচরণ জিন্নাহর কাছে বিশ্বাস ভঙ্গ মনে হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী জিন্নাহ আস্থা হারায় এবং ১৯৪০ সালে তার 'দ্বি-জাতি' তত্ত্ব ঘোষণা করেন। ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যকার দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। আবার বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্কও সংকটে পরে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় বেশি সংকটে পরে যায়। কেননা বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে অবাঙালিরা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো এবং তাদের আত্মপরিচয় বাঙালি মুসলমান নয়, শুধু মুসলমান এটা দেয়ার চেষ্টা করতো। উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থে জিন্নাহ 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' ঘোষণা করলে বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা করে এবং এই চিন্তার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিলে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। যা মুসলমানদের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে, স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। ফলে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়।(৮) তবে বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের রাষ্ট্রচিন্তা থেকে ভিন্ন ছিলো। বাঙালি মুসলমানরা শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্র নয়, তাদের জন্য অখন্ড বাংলা রাষ্ট্রের চিন্তা করতেন।
তথ্যসূত্রঃ
১। বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ প্রকাশ, পৃষ্ঠা- ৪২৫
২। শেকড়ের সন্ধানেঃ বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়, মাহমুদ
৩। দ্বিজাতিতত্ত্ব, লাহোর প্রস্তাব ও বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা, হারুন-অর-রশিদ
৪। বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, হারুন-অর-রশিদ
৫। বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ প্রকাশ, পৃষ্ঠা- ৪২৭
৬। মুসলিম লীগ/পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি অবাঙালি দ্বন্দ্ব, হারুন-অর-রশিদ
৭। বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন, হারুন-অর-রশিদ
৮। স্বাধীন অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ১৯৪৭ ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, হারুন-অর-রশিদ
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটঃ ১৯৩৭-৪৭
Friday, December 6, 2024
বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং একজন শিক্ষকের পেশাগত নীতি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্টিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় শিক্ষক কনফারেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় এবয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা গৃহীত হয়। সেই সুপারিশসমূহের একটি হলো বিভিন্ন দেশে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করা। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ^ব্যাপী ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশও দিবসটি উপলক্ষ্যে সেমিনার, আলোচনা সভা, বিশিষ্ট ও কৃতী শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করে থাকে। বিষয়টি সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু দায়িত্ব সচেতন এবং নিবেদিত শিক্ষক তৈরির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আরো উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, পদোন্নতি, পদ-মর্যাদা, শিক্ষাদানের পরিবেশ, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ে অধিকতর চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ইউনেস্কো/আইএলও- এ শিক্ষাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে ব্যক্ত করে শিক্ষার অগ্রগতি, দেশ, জাতি ও আধুনিক সমাজ গঠনে শিক্ষকের অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সুপারিশপত্রের Guiding Principles - এ বলা আছে,‘ ‘Teaching should be regarded as a profession: it is a form of public service which requires teachers expert knowledge and specialized skills, acquired and maintained through rigorous and continuing study; it also calls for a sense of personal and corporate responsibility for the education and welfare of the pupils in their change. (Guiding Principles- Section II, Article-6).’ শিক্ষকের এই ভূমিকা পালন করতে তাঁর পেশাগত কিছু নীতি মেনে চলতে হয়, যা পেশাজীবী শিক্ষক হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘নীতি’ শব্দটি নৈতিকতার সাথে যুক্ত, যার সাথে আদর্শের বিষয়টিও জড়িত। নীতি বলতে এমন মানদন্ডকে বুঝায় যার দ্বারা আমরা একজন মানুষকে চরিত্রবান, আদর্শ মানুষ বলে থাকি। আমেরিকান শিক্ষাবিদ Ralph E. Himslead বলেন, ‘Ethics is concerned with morality, with ideal human character.’পেশা বলতে বুঝায় একজন মানুষ যে কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে পেশার সাথে শুধু আয় রোজগারের বিষয়টিই সম্পৃক্ত নয়, সমাজ এবং মানবতার সেবা বা কল্যাণও সম্পৃক্ত। শিক্ষকতা একটি পেশা আর যিনি শিক্ষকতা করেন তিনি একজন শিক্ষক। কাজেই শিক্ষক হলেন পেশাজীবী আর পেশাজীবী হিসাবে পেশাগত নীতির প্রতি আস্থা ও অনুসরণ করার মাধ্যমে পেশার মর্যাদা নিশ্চিত হয়। একজন শিক্ষককেও তাই কতিপয় পেশাগত নীতি পালন করতে হয়।
এই পেশাগত নীতিসমূহের মধ্যে রয়েছে- ১. পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষকতা এমা একটি পেশা যার দ্বারা অন্য সকল পেশাজীবীর শিক্ষার হাড়েখড়িসহ সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তাই মানবকল্যাণই এখানে মূখ্য, লাভ-ক্ষতির হিসাব গৌণ। ২. পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষককে গুরু দায়িত্বের কথা মনে রাখতে হয়। কেননা পরবর্তী রাষ্ট্রনায়ক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক, প্রকৌশলীসহ সবার শিক্ষার দায়িত্ব তাঁর হাতে বরতায়। ৩. বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আরো বেশি শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক, তাই শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে পরিচালনার যোগ্যতা শিক্ষককে রাখতে হবে। ৪. শিক্ষককে অবশ্যই শেখার এবং শেখাবার ইচ্ছা থাকতে হবে। শেখাবার ইচ্ছা শিক্ষকে যোগ্যতম করে তোলে। আর পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সাথে মিল রেখে শিক্ষকে তার জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। তাই শিক্ষককে সারাজীবন ধরে শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে নিজেকে শিক্ষা নিতে হবে। ৫. প্রতিটি পেশার জন্য কিছু নীতিমালা থাকে। পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষকদেরও কিছু নীতিমালা মানতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে- পেশার প্রতি একাগ্রতা, দায়িত্ব পালনে সচেতনতা, কর্মে দক্ষতা, শিক্ষার্থীদের মন-মানসকে জানা, জানার আগ্রহ ও নিত্য নতুন জ্ঞান আহরণের বাসনা, নিরলস জ্ঞান চর্চা, সমাজ সচেতনতা এবং সামাজিক কর্মকান্ডে অবদানের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা প্রভৃতি। উল্লেখিত নীতিমালার প্রথম তিনটি সকল পেশার জন্য হলেও পরবর্তীগুলো বিশেষভাবে শিক্ষকদের জন্য। ৬. প্রতিটি পেশাতেই পেশাজীবী সংগঠন থাকে। শিক্ষকতা পেশাতেও সংগঠন থাকা বাঞ্ছনীয়, যার মাধ্যমে তাদের দাবী-দাওয়া তুলে ধরা যায় এবং নিজেদের অধিকার রক্ষা করা সহজ হয়। ইউনেস্কো/আইএলও- এর সুপারিশপত্রের Guiding Principles- এ বলা আছে, ‘‘Teachers’ Organizations should be recognised as a force which can contribute greatly to educational advance and which therefore should be associated with the determination of education policy.’’ ৭. সবাই ভালোবেসে শিক্ষকতা পেশায় আসে না। বিভিন্ন কারণে এই কাজের সাথে সঙ্গতি বিধান না করতে পেরেও শিক্ষকতা পেশায় রয়েছেন। তাদের এই অসঙ্গতি দূর করতে আত্মবিশ্লেষণ অপরিহার্য। আর আত্মবিশ্লেষণের জন্য নিজেকে কতিপয় প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন- ক. আমি কি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি? খ. শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পূর্বে আমি কি প্রস্তুতি নিচ্ছি? গ. আমি কি শিক্ষার্থীদের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন? ঘ. আমি কি সব শিক্ষার্থীদের প্রতি সমান আচরণ করছি? ঙ. আমি কি শিক্ষার্থীকে তার ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করছি? চ. আমি কি পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্য সম্পর্কে সচেতন আছি? ছ. পেশাগত উন্নয়নের জন্য আমি কি নিজ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি? জ. আমি কি আমার পেশা সংক্রান্ত বই-পুস্তক পাঠ করছি? ঝ. আমি কি আমার সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছি? ইত্যাদি প্রশ্নগওলোর উত্তর বের করে নিজেই নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে উন্নয়ন বা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করা প্রয়োজন।
শিক্ষকতায় সাফল্যের জন্য মর্যাদা বৃদ্ধি প্রয়োজন আর এই মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আত্মোন্নয়ন জরুরি। আত্মোন্নয়ন শিক্ষকের তরফ থেকে আসতে হয়। তাই পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষকতাকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে অবশ্যই শিক্ষকদের নিজেদের নৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। নিত্য নতুন তথ্য জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সময়ে সাথে, প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত করে আপডেট থাকতে হবে। ব্যক্তিগত এবং পেশাগতভাবে নিজেকে উন্নত করতে পারলেই শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা নিশ্চিত উন্নত হবে। তাই শিক্ষকতা পেশাজীবী হিসাবে একজন শিক্ষককে পেশাগত নীতিসমূহ মেনে চলতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা।
লেখক: মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা এবং ফেলো, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল: helaluddin565@gmail.com
পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার লিঙ্কঃ
বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং একজন শিক্ষকের পেশাগত নীতি
Saturday, October 12, 2024
শিক্ষক দিবসের অজানা তথ্য -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
১৯৪৪ সালে আমেরিকার মৈটে ওয়ারেটে উডব্রিজ সর্বপ্রথম শিক্ষক দিবসের পক্ষে কথা বলেছিলেন। ১৯৫৩ সালে এই প্রসঙ্গে কথা বলেন মার্কিন কংগ্রেস। ১৯৮০ সাল থেকে ৭ মার্চ সারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালন করা শুরু হয়। পরবর্তীকালে মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার শিক্ষক দিবস পালন করা শুরু হয়। সিঙ্গাপুরে সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার পালন হয় শিক্ষক দিবস। পরবর্তীকাল ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালন করা শুরু করে ইউনেস্কো।
১৯৪৬ সালে ইউনেস্কো শিক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতা,অধিকার এবং আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক সনদ নামক একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে। বিশ^ শিক্ষক দিবস পালনের যৌতিকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে-১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্ত : সরকার সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত বিশেষ সুপারিশ মালা গ্রহণ করা হয়।
১৯৯৩ সালে বিশ্বের ১৬৭ টি দেশের ২১০ টি জাতীয় সংগঠনের ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যদের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন“ এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল” গঠিত হয় এ আন্তর্জাতিক সংগঠন । জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো কর্তৃক প্রণীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর মহা-পরিচালক ড.ফ্রেডারিক এম মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর “ বিশ্ব শিক্ষক দিবস” পালনের শুভ সূচনা করা হয়।
Monday, September 16, 2024
মুসলিম উম্মাহর অনুকরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মুহাম্মাদ (স) -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
‘অ্যাইয়ামে জাহিলি’ যুগ হিসাবে পরিচিত সময়ে সবাই ধর্মহীন জীবনে নিমজ্জিত ছিলো। যেখানে কোথাও শান্তি ছিলো না। সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করত। মানুষ ছিল হতাশাগ্রস্থ। তখন এই অন্ধকারাচ্ছন্ন, হতাশাগ্রস্থ মানুষ জাতির মুক্তির জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একজন আর্দশবান মানুষের। মহান আল্লাহ তাআলা আর্দশ মানুষ হিসাবে হযরত রাসুল (স) কে নির্বাচন করেন এবং কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭) এবং ‘তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে; যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে।' (সুরা আহজাব : আয়াত ২১) এই আর্দশ মানুষটির মাঝে অনেক গুনের সমাবেশ রয়েছে। চারিত্রিক বৈশিষ্টে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ মহামানব। আর্দশের দিক দিয়ে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায়, দেশ, কাল সর্বক্ষেত্রে ছিলেন আর্দশের প্রতীক। মোটকথা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব কথা ও কাজ ছিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। দুনিয়ার জীবনের উন্নত দিকনির্দেশনা। তাঁর অসংখ্য আদর্শের মধ্যে জীবনঘনিষ্ঠ কিছু আদর্শ তথা উপদেশের মধ্যে রয়েছে-
* সালাম দেয়া
প্রিয় নবী (স) সবাইকে আগে আগে সালাম দিতেন। সাধারণ কেউ তাকে আগে সালাম দিতে পারতেন
না। এটি ছিল বিশ্বনবীর অন্যতম শিক্ষা। এ কারণেই তিনি বলেছেন- ‘কথা বলার আগে সালাম
দাও।’
* আল্লাহকে বেশি স্মরণ করা
* নামাজ পড়া
নামাজ ছিল প্রিয় নবীর জীবনের শ্রেষ্ঠ ইবাদাত ও আদর্শ। এমনকি তিনি যখন কোনো বিপদে
পড়তেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আবার কোনো কারণে কষ্ট বা হতাশা বা
চিন্তাগ্রস্ত হলেও তিনি তাৎক্ষণিক নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামকে বিশেষভাবে (রাতে) তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নির্দেশ
দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘হে চাদর আবৃত, রাতের সালাতে দাঁড়াও; কিছু অংশ
ছাড়া।’ (সুরা মুজাম্মিল : আয়াত ১-২)
* মুচকি হাসি
রাসুলুল্লাহ (স) কম হাসতেন এবং মুচকি হাসি হাসতেন। এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। হাদিসে
এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, সৎ আমলের কোনো
কিছুকেই তুচ্ছ মনে করো না, যদি তা (সৎ আমলটি) তোমার নিজের ভাইয়ের সঙ্গে মুচকি হাসি
দিয়ে মিলিত হওয়ার দ্বারাও হয়। (মুসলিম শরীফ)
* প্রতিশোধ পরায়ন না হওয়া
কারো প্রতি প্রতিশোধ না নেয়া ছিল বিশ্বনবীর অন্যতম আদর্শ। কেউ অপরাধ করে থাকলে
ধৈর্যধারণ করাও শ্রেয়। রাসুলুল্লাহ (স) নিজের জন্য কখনোই প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না।
এমন কি রাসুলুল্লাহ (স) কখনো কাউকে আঘাত করতেন না। শারীরিক আঘাত তো দূরের কথা তিনি
কথা বা আচরণ দিয়েও কাউকে কষ্ট দিতেন না।
* শিশুদের স্নেহ করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমলমতি শিশুদের বেশি স্নেহ করতেন
এবং ভালোবাসতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, এক ব্যক্তি একটি শিশু নিয়ে বিশ্বনবীর খিদমতে এসে
শিশুটিকে চুমু দিতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (স) এ দৃশ্য দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
শিশুটির প্রতি কি তোমার দয়া জেগে উঠেছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ’, হে আল্লাহর রাসুল! তারপর
রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়া করেন। কেননা
তিনি দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (বুখারি)
* পরিবারের সঙ্গে কোমল আচরণ
রাসুলুল্লাহ (স) নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোমল আচরণ করতেন। এবং অন্যদেরকে পরিবারের
সদস্যদের সঙ্গে কোমল ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। খাবার-দাওয়া, কেনা-কাটা,
সাংসারিক কাজে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ও উত্তম জিনিস দেয়াকে উত্তম ইবাদত ও খরচ
বলে উল্লেখ করেছেন।
* মিথ্যা পরিহার করা
মিথ্যা সব পাপের মূল। রাসুলুল্লাহ (স) সব সময় মিথ্যা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন।
তিনি মিথ্যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন।
* সাদকা বা দান করা
রাসুলুল্লাহ (স) বেশি বেশি সাদকা করতেন। ইসলামের জন্য সাদকা করতে হজরত খাদিজা (রা)
তার সমূদয় সম্পদ প্রিয় নবীকে দিয়েছিলেন। আর তিনি তা দ্বীনের পথে ব্যয় করেছেন। বেশি
বেশি সাদকা বা দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (স) এর কাছে যখন কোনো সাদকা
আসতো তিনি তা সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কেননা তিনি সাদকা খেতেন না।
* ক্ষমা করা
ক্ষমা মহান আল্লাহ তাআলার অন্যতম গুণ। রাসুলুল্লাহও (স) ক্ষমা করতে ভালোবাসতেন। হাদিসে
প্রিয় নবী (স) ক্ষমার ব্যাপারে এভাবে দোয়া করতেন এবং তাঁর উম্মতেকে দোয়া করতে
বলতেন- অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা
করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)
* কাউকে অবহেলা না করা
রাসুলুল্লাহ (স) কখনো কাউকে অবহেলা করতেন না। কারো মর্যাদা বিনষ্ট হোক এটা তিনি
কামনা করতেন না। সবার প্রতি তিনি উদার ছিলেন। বিশেষ করে তার কাছে আসা সব
ব্যক্তিকেই তিনি সমাদর করতেন, গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের কথা শুনতেন।
* সুস্পষ্ট কথা বলা
রাসুলুল্লাহ (স) ছিলেন সুস্পষ্টভাষী। তিনি ছিলেন সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।
সত্যের মানদণ্ডে তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী। কথা বলার সময় তিনি সুস্পষ্টভাষায় কথা
বলতেন। এমন কেউ ছিলেন না যিনি প্রিয় নবীর কথা বুঝতেন না।
* অনাড়ম্বরতা
সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়েও তিনি বিলাশসতামুক্ত অত্যন্ত সাদা-মাটা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে
অভ্যস্ত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স) গাছের লতা-পাতা দিয়ে তৈরি করা বিছানায় ঘুমাতেন। এতে
তার শরীর মুবারকে দাগ হয়ে যেত। সাহাবারা ভালো কোনো বিছানার ব্যবস্থা করার আবদার জানালে
তার প্রতিউত্তরে তিনি বলতেন, ‘আমার দুনিয়ার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। আমি দুনিয়াতে একজন
পথচারী ছাড়া আর কিছুই নই। যে পথচারী একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে একটু পরে সেটা ছেড়ে
চলে যায়।’ (তিরমিজি)
সুতরাং বিশ্ববাসীর উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাঁর রেখে যাওয়া জীবনাচারে সবার জীবন সাজানো। আর তাতেই মিলবে মহান আল্লাহর ভালোবাসা, সন্তুষ্টি। থাকবে গোনাহ মাফের হাতছানি।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবীর এ গুণগুলো যথাযথভাবে মেনে চলার তাওফিক দান করুন। বিশ্বনবীর আদর্শে নিজেকে রাঙিয়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মুসলিম উম্মাহর অনুকরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মুহাম্মাদ (স)
(মোঃ হেলাল উদ্দিন– শিক্ষক, লেখক ও গবেষক)
Tuesday, August 27, 2024
বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ – মোঃ হেলাল উদ্দিন
বিশ্ব ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন সব সময় সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে। বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তাদের সংগ্রাম এবং ত্যাগের মাধ্যমে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাঠামতে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে এবং এর প্রভাব বর্তমান সময়েও বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসের এবং বাংলাদেশে পরিবর্তন নিয়ে আসা সেই সকল আন্দোলনের কথা নিয়েই আজকের এই লেখা।
প্রথম ছাত্র আন্দোলন
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয় চীনে। ১৬০ খ্রিস্টাব্দে চীনের ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এমন কয়েকজন ছাত্রনেতা, যারা মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং ইমপেরিয়ালে পড়তে এসেছেন তুলনামূলক গরিব পরিবার থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেই আন্দোলন সেদিন ছুঁয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষকেও। ছাত্রদের দেখাদেখি সেদিন সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে স্লোগান দেয় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। সরকার এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে এবং ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সরকারি কারাগারে তাদের ভোগ করতে হয় অমানুষিক নির্যাতন আর নিগ্রহ।
ফরাসি বিপ্লব ও বোহেমিয়ান বিদ্রোহ
ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা রাজা ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং তারা নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। এছাড়া তারা তাদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে।
হোয়াইট রোজ আন্দোলন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ গ্রুপ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন, যার নাম রাখা হয়েছিল হোয়াইট রোজ বা শ্বেত গোলাপ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় হিটলার ও নাৎসি বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে হোয়াইট রোজ আন্দোলন ৬টি লিফলেট প্রকাশ করে। এর মধ্যে চতুর্থ লিফলেটটিতে লেখা হয়েছিল- ‘আমরা চুপ করে বসে থাকব না। আমরা তোমার মন্দ বিবেক। হোয়াইট রোজ তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।’ এই লিফলেটগুলো তারা অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক এবং ফোনবুকের ঠিকানা ধরে ধরে ডাকে পাঠাতেন। এছাড়া ফোনের বুথে বুথে রেখে আসতেন, যেন এগুলো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়। ১৯৪৩ সালে এই গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচার শেষে ছয়জন প্রধান সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নাৎসি শাসনে এই আন্দোলন বড় কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও ছাত্রদের এই সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিনে কিছুটা হলেও ফাটল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
গ্রিনসবোরোর অবস্থান ধর্মঘট
১৯৬০ সালে ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার উলওর্থ লাঞ্চ কাউন্টারে সাদা-কালো ভেদাভেদের প্রতিবাদে নর্থ ক্যারোলিনার এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্টে ইউনিভার্সিটির চারজন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। অবস্থান ধর্মঘটে অংশ নেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ ওই চার হলেন- ১৮ বছর বয়সী ইজেল ব্লেয়ার জুনিয়র, ১৯ বছরের ফ্রাঙ্কলিন ম্যাককেইন, ১৭ বছরের জোসেফ ম্যাকনেইল এবং ১৮ বছরের ডেভিড রিচমন্ড। ধর্মঘট শুরু করার মাত্র তিন দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে আরও অন্তত ৩০০ শিক্ষার্থী এসে যোগ দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরও ৫০-এর অধিক শহরে এ ধরনের অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয় । যার ফলস্বরূপ খুব শিগগিরই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাঞ্চ কাউন্টারগুলোতে বর্ণপ্রথা রহিত করা হয়। এক পর্যায়ে ওই চার শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে আন্দোলনের এক অহিংস ছাত্র সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয় এবং এই কমিটি পরবর্তী সময়ে যানবাহনে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণসহ এবং দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত করায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন পাস হয়, যা মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একটি মাইলফলক ছিল। ২০০৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করা চার শিক্ষার্থীর একজন ম্যাককেইন বলেন, “অনিবার্যভাবেই লোকজন প্রায়ই আমাকে বলে- ‘আমি এখন কী করব’?’’- আমি বলে উঠি, ‘এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তোমার চারপাশে তাকাও। একসময় তুমিই দেখতে পাবে- তুমি কী করতে চাও। সাধারণ মানুষের কাছে কখনো প্রত্যাশা কোরো না। কারণ, তারা আসবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় জাগরণ
১৯৬৮ সালে একাধিক মহাদেশে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার সবগুলো সফল না হলেও এসব আন্দোলন পরবর্তী অনেক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। এ বছরের মার্চ মাসে ওয়াশিংটনের কৃষ্ণাঙ্গ হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। তাদের প্রথম দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ারম্যানের পদত্যাগ, দ্বিতীয়ত- পাঠ্যক্রমে আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসে জোর দেওয়া, তৃতীয়ত- ছাত্রদের অংশগ্রহণে একটি বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা তৈরি এবং চতুর্থত- ইতিপূর্বের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ তৃতীয় এবং চতুর্থ দাবিটি মেনে নেয়। এর এক মাস পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও হারলেমের মর্নিংসাইড পার্কে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমে স্থানীয় বাসিন্দাদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অস্ত্র গবেষণা থিংকট্যাংকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিয়েতনাম যুগের একটি চুক্তি বাতিল করতে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ভবন দখলে নেয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রায় হাজার খানেক পুলিশ তাদের উচ্ছেদ করার জন্য নির্মম হামলা চালালেও শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সেমিস্টারজুড়েই তাদের আন্দোলন চালিয়ে যান এবং বিভিন্ন ভবন দখলমুক্ত করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডে ছাত্র অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৩০০ শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করেন। মার্চ মাস নাগাদ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার। তবে, দেশটির সরকার এই আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত দমন করতে সক্ষম হয় । একই বছরের মে মাসে ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সরবোনে এই দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। ফ্রান্সের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোসহ শিক্ষকরাও ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন করে ২৪ ঘণ্টার এক ধর্মঘট আহ্বান করেন। টানা কয়েকদিনের আন্দোলনে দেশবাসী নাকাল হলেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের গদি টলাতে ব্যর্থ হন আন্দোলনকারীরা। তবে এই আন্দোলন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন
১৯৭০ এবং ১৯৮০’র দশক জুড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েতোর পাবলিক স্কুলগুলোতে বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন জোহানেসবার্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দেশটির তৎকালীন সরকারের একটি শিক্ষানীতির পরিবর্তন। যে শিক্ষানীতিতে বলা হয়, শুধু শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি শিখতে পারবে। আর কালোদের পড়ানো হবে আফ্রিকান ভাষায়। এই বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরা উন্নততর শিক্ষা পাবে, পৃথিবী তাদের সামনে খুলে যাবে, আর কালো শিক্ষার্থীরা বন্দি থাকবে আফ্রিকান ভাষার শেকলে, তা হতে পারে না। ঠিক করা হলো- এক মৌন মিছিল হবে সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকবে– ‘অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’, ‘আমরাও ইংরেজি পড়তে চাই’ ইত্যাদি স্লোগান। মিছিল চলাকালে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়। কিন্তু শিক্ষর্থীরা নির্ভয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এ অবস্থায় গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলি খেয়ে প্রথমেই লুটিয়ে পড়েন হেক্টর পিটারসন নামে ১১ বছরের এক কিশোর। শোভাযাত্রা সেদিনের মতো পন্ড হয়ে গেলেও এটি এক দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে রূপ নেয়। আফ্রিকায় শুরু হয়ে যায় ভাষা বিপ্লব। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ১৯৯৪ পর্যন্ত চলেছিল। দীর্ঘ ১৮ বছরের এই আন্দোলনই দেশটির বর্ণবিদ্বেষী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সুদীর্ঘ এই আন্দোলনে দেশটির অন্তত ৫৭৫ জন নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর প্রাণ দিয়েছিল।
তিয়েন আনমেন স্কোয়ার আন্দোলন
১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল চীনের সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শোভাযাত্রা নিয়ে তিয়েন আনমেন স্কয়ারে একত্রিত হয়ে সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের অধিকারের বিষয়ে দাবি তোলেন। পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে প্রায় ১০ লাখ লোক সমবেত হন। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন, চীনা সেনাবাহিনী তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে সমবেত মানুষের ওপর গুলি চালায় এবং এতে কয়েকশো মানুষ নিহত হন। ঠিক কতজন সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তার সংখ্যা কখনও প্রকাশিত হয়নি। এই আন্দোলনের পর চীনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না এলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় কিছুটা উদারনীতি গ্রহণ করা হয়।
ভেলভেট রিভল্যুশন
১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়ার ৮ দিন পর, চেকোস্লোভাকিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রাগ শহরে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী দিয়ে প্রাগ শহরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ৫ লাখ মানুষের বিশাল এক গণসমুদ্রে পরিণত হয়। দাঙ্গা পুলিশ বারবার আক্রমণ চালাতে উদ্যত হলেও আন্দোলনকারীরা তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এই আন্দোলনের ফলে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল ইতিহাসের এক ব্যতিক্রম আন্দোলন। লেখক টিমোথি গার্টেন অ্যাশ-এর ভাষ্যে আন্দোলনটি ছিল ‘দ্রুততম, কোনো মারামারি কাটাকাটি ছাড়া, আনন্দময় এবং হাস্যরসপূর্ণ।’ আধুনিক সময়ের কোনো ছাত্র আন্দোলনই এমন সফল এবং সুকোমল হতে পারেনি।
ইরানের ছাত্র বিক্ষোভ
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর ৮ জুলাই মাঝ রাতের পর ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে পুলিশের অভিযান এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলার পর ইরানের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভে অংশ নেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়া ১২৫ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে সরকারি বাহিনী। কিন্তু তারপরও অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী ইরানের রাজপথে নেমে আসেন। এই আন্দোলনে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পুলিশি অভিযানের সমালোচনা করে এবং সংযমের আহ্বান জানান। ইরানের রাজনীতিতে এই আন্দোলনের ফলে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসে। ইরানের সাধারণ মানুষ সরকারি নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে নীরবে জীবন অতিবাহিত করলেও দেশটির শিক্ষার্থীরা এখনো যে কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদী অবস্থান নেন।
যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে ছাত্ররাই অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নানান গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসহ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বাংলাদেশের ছাত্ররা। যার মধ্যে অন্যতম আন্দোলনগুলো হলো-
ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ এর দেশভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে আন্দোলনের শুরু হলেও চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নামলে ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে শাসকরা। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
শিক্ষা আন্দোলন
আইয়ুব খান সরকারের গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকট হয়। এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ১৯৬২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে ফেব্রুয়ারি জুড়ে আন্দোলন চাঙা হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আগস্টে ছাত্র ধর্মঘট ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সেপ্টেম্বর আন্দোলন পরিণতির দিকে যায়। এতে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। হরতালের মিছিলে পেছন থেকে পুলিশ ও ইপিআর আক্রমণ করে এতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত, অনেক আহত এবং শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়।
গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন
স্বাধীন দেশের ছাত্ররা ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ঘটান। নূর হোসেন শহীদ হলে এই আন্দোলন চূড়ান্তরুপ পায়। যার বুকে-পিঠে লেখা ছিলো ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এই আন্দোলনে ছাত্ররা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন নিশ্চিত করে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন
সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ২০১৮-এর এপ্রিলের পূর্বে এবং বিগত কয়েক বছর বিচ্ছিন্নভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন চললেও, তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে এসে সারা দেশব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে। ৮ই এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে কোটা সংস্কারের পক্ষে বিক্ষোভ শুরু হয়ে আস্তে আস্তে সেটি বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই ২০১৮ রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় এবং ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চলে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের দমনপীড়নমূলক ব্যবস্থা দেশে ও বহির্বিশ্বে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়। পরবর্তীতে ৬ আগস্ট শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়; যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদন্ড দাবি করেছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয় যা "বাংলা ব্লকেড" কর্মসূচি নামে পরিচিত। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দেয়। ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। আন্দোলনকারীরা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে। ২১ জুলাই ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি পালন করে। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে ঘিরে ৪ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ৯৮ জনের বেশি সাধারন মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন এবং এরই সাথে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময় শাসনের অবসান হয়।
(মোঃহেলাল উদ্দিন – শিক্ষক, লেখক ও গবেষক)
পত্রিকার লিঙ্কঃ বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ (ভোলার খবর)
পত্রিকার লিঙ্কঃ বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ (বাহান্ন নিউজ)