Monday, September 4, 2023

বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটঃ ১৯৩৭-৪৭ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটঃ ১৯৩৭-৪৭

ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের শেষের দিকে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে তাদের শাসন গুটিয়ে নেয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। এই সময়ের গুরুত্ব আরো যে কারনে বেশি তা হলো- মুসলিম কৃষক শ্রমিকের জাগরণ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বাঙালি মুসলমানের ভিন্ন আত্মপরিচয়ের ব্যবহার, যা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে কাজ করেছিলো।

এই সময়ে বাঙালি মুসলিম আত্মপরিচয়ের বিষয়টা সামনে উঠে আসার পিছনে আরো কতিপয় ঘটনা প্রবাহ রয়েছ। ১৯০৬ সালে পত্তন হওয়া মুসলিম লীগ, ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি, ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট, ১৯২৭ সালের সাইমন কমিশনের রিপোর্ট, তৎপর নেহেরু রিপোর্ট, জিন্নাহর ১৪ দফা প্রস্তাব, ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস থেকে ওয়ার্কআউট, ১৯২৯ সর্বভারতীয় মুসলিম কনফারেন্সে প্রথম নির্বাচন বলবৎ, ১৯৩০-৩৩ এ রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান, মুসলিম মানসিকতা ও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার গতি ও পথ পরিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে একটা আভাস পাওয়া যায়।(১)

১৯৩৭-৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলো অবাঙালি মুসলমানদের হাতে। যার কারনে এই সময়ের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিম পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় থাকা, কিংবা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা থাকার পরেও বাঙালি মুসলমানরা এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটের মধ্যে পরে। এই মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট এবং আত্মপরিচয় সম্পর্কে আজকের আলোচনা।

প্রথমে বাঙালির একটা পরিচয় জানার চেষ্টা করি। বাঙালি জাতি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর নাম। যারা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মনিপুরের কিছু অংশ জুড়ে রয়েছে। এরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চাও বাংলা ভাষাতেই করে থাকে। ধর্মীয় অনুষঙ্গ এবং অনুশীলনের দিক থেকে বাঙালিদের প্রায় ৬৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে বাঙালিদের ধর্মীয় বৈচিত্র্য অনেক বেশি। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অনেক ধর্মের লোকের অবস্থান রয়েছে। তবে তারা হলো সংখ্যালঘু। বঙ্গ সভ্যতার ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো এবং ভারতবর্ষে বাঙালিদের শাসনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছরের, যার মধ্যে বাঙালি হিন্দু শাসন এবং অবাঙালি মুসলিম শাসন উভয়ই রয়েছে। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচার, জীবন প্রণালী, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালির একটা ভিন্ন পরিচয় স্বমহিমায় দীর্ঘ সময় ধরে রয়েছে।

মুসলিম আত্মপরিচয়ের কথা তুললে বলা যায় ইসলাম হলো মুসলমানের মূল পরিচয়। তবে আত্মপরিচয় হলো ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়। ব্যক্তির একাধিক আত্মপরিচয় থাকতে পারে। প্রথমে সে মানুষ, এরপরে আসে ধর্মীয় পরিচয়-হিন্দু, মুসলমান বা অন্য ধর্মাবলম্বী, এর সাথে যোগ হয় জাতিগত পরিচয়- বাঙালি, অবাঙালি ইত্যাদি পরিচয়। ভারতবর্ষের বিশেষ করে এই উত্তর অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমান, কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ইসলাম এই অঞ্চলে এসেছিল অবাঙালি মুসলমানদের হাত ধরেই। আর এ কারনেই মুসলমানদের মধ্যে তাদের আত্মপরিচয়ের একটা সংকট দেখা দিয়েছিলো। কেননা বাঙালি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করতেছিলো অবাঙালি মুসলমানরা। যখন বাঙালি মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে পৌছে যায় তখন বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের বিষয়টা সবার সামনে চলে আসে। যা ব্রিটিশ শাসনের আগে তেমন ছিলো না, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষ দিকে এসে তা প্রবল রুপ ধারণ করে।

আলোচনার মূল সময়কাল ১৯৩৭-৪৭ সাল হলেও একটু পিছনে ফিরলে দেখতে পাই ১৮৭২ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষে প্রথম আদমশুমারি বা জনগণনা শুরু করে তখন ভারতবাসীর যে দীর্ঘ দিনের ধারনা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাতে অবাক করার মতো ভিন্ন তথ্য দেখা যায়। তৎকালীন বাংলার রাজনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিলো কলকাতা কেন্দ্রিক এবং এখানে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিলো। মুসলমানরা ইংরেজপূর্ব শাসনকেন্দ্র মুর্শিদাবাদ ও উত্তরবঙ্গে কিছুটা প্রভাবশালী ছিলো। কিন্তু জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের অবাক করা তথ্য বের হলে ইংরেজ কর্মকর্তা জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, "১৮৭২ সালের সেনশাসে সবথেকে বেশি ইন্টেরেস্টিং আবিস্কার ছিলো মুসলমানদের পুরানো রাজধানীর বদলে নিম্ন বঙ্গের পাললিক ভূমিতে বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা।" এই তথ্য মুসলমানদের আত্মপরিচয় ও তাদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে নতুন করে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবায়।

দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে এতো মুসলমান কোথা থেকে আসলো এই নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হয়। বাংলায় মুসলমানদের শাসনকেন্দ্রের বাইরে কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলো তা ব্যাখ্যা করতে বিভারলি (সেনশাসের মূল গণনাকারী) বলেন, "মুঘল রক্ত নয়, বরং নিম্নবর্ণের অধিবাসীরা হিন্দু ধর্মের কঠোর বর্ণপ্রথা থেকে ইসলাম ধর্মে কনভার্ট করেছে।"(২) অর্থাৎ তিনি মুসলমানদের মাইগ্রেশন তত্ত্বকে বাদ দিয়ে সামাজিক মুক্তি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। কিন্তু মুসলমানরা এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, মুসলমানরা নিম্নজাত থেকে ধর্মান্তরিত হয়নি বরং তারা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছে এবং তাদের বহুবিবাহ, উচ্চ জন্মহার প্রভৃতির কারনে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমানদের এই আত্মপরিচয়ের বির্তককে ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থে এবং তাদের 'ভাগ কর, শাসন কর' নীতিতে আরো চাঙ্গা করে রেখেছিল।

এদিকে উনিশ শতকে যখন বাঙালিদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু হয় তখন বাঙালি মুসলমানরা তাদের আত্মপরিচয় দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিকূল অবস্থার কারনে। এ সময়ে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানদের এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তৈরি হয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব। এই সমস্যার মূলে ছিলো ধর্ম, যা আবার ভাষাকেও প্রভাবিত করেছিলো। এই ভাষা ভিত্তিক আত্মপরিচয় শুধু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যেই সংকট তৈরি করেনি, বরং তা মুসলমানদের মধ্যেও সংকটের সৃষ্টি করে। কেননা, "ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, ঐতিহ্য এক ও অভিন্ন ছিলো না। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের সাথে অবাঙালি মুসলমানদের এসব বিষয়ে ভিন্নতা সুস্পষ্ট।"(৩) তাই বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্রতার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলো।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৯০৬ সালে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। সেই সময়ের কনফারেন্সে বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম কি হওয়া উচিত? উর্দু, ফার্সী না বাংলা এমন বির্তক দেখা দিলে পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রতিনিধি মৌলভী আব্দুল করিম বাংলার সমার্থনে যুক্তি দেন এই ভাবে, "পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া আদৌ নিজেদের ভাবতে পারেনা। উর্দু ও ফারসি ভাষা ছাড়াও তারা চলতে পারে। আমি মনে করি, তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব সংরক্ষণের প্রয়োজনেই এ নীতি অবলম্বন আবশ্যক।"(৪) ১৯১১ সালে হিন্দুদের তথা অখন্ড বাংলা দাবীকারীদের আন্দোলনের মূল কারণ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যকার ভয় যে, ক্ষমতা মুসলমানদের হস্তগত হয়ে যাবে। যদি হিন্দু নেতারা এই সময়ে একটু বাস্তববাদী চিন্তা করতো তাহলে হয়তো পরবর্তী ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য রকম হতে পারতো।

বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলার মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সময়ে মুসলমানরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরিতে সক্ষম হয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের একটা প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে এতোদিনকার অবাঙালিদের মুসলিম রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও কৃষক শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ কে ফজলুল হক এই শ্রেণির নেতৃত্বে আসেন। বলা হয়ে থাকে, "বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে ফজলুল হক ছিলেন অর্ধ শতাব্দীর সূর্য ও বহু উত্থান-পতনের মহানায়ক।"(৫)

১৯৩৪ সালের শেষের দিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লন্ডন থেকে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে এসে মুসলিম লীগের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সফরের মাধ্যমে দল গঠনে মনযোগী হয়ে পরেন। তবে ১৯৩৭ সালে দলের কাউন্সিলে জিন্নাহ দলীয় যোগাযোগের জন্য উর্দু ভাষা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিলে ফজলুল হক তার একশত ডেলিগেট নিয়ে এর বিরোধিতা করলে ঐ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এভাবেও বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অবাঙালি মুসলমানদের কারনে সংকটের মুখে পরে যায়।

মুসলিম লীগ রাজনীতিতে জিন্নাহর সাথে শেরে বাংলার নানান ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে মত বিরোধ তৈরি হতো। এ সময়ে দলের অন্য নেতারা তাকে সমার্থন না করার কারনে এবং জিন্নাহর কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য দলের জেনারেল সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খানকে চিঠি লিখে ফজলুল হক বলেন, "ভারতের মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের অধিক। অথচ সেই অনুযায়ী বাংলার প্রতি বাইরের নেতৃত্ব গুরুত্বারোপ করেনা,,,,। আমি বাংলার ৩৩ মিলিয়ন মুসলমানের ভাগ্যের ওপর বাইরের কোন নেতৃত্বকে কর্তৃত্ব করতে দেবনা।"(৬)

১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাঙালি মুসলমান এবং বাংলার রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা সরকার গঠন করে। যদিও এই নির্বাচনে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে কংগ্রেস ৬০ টি আসন, মুসলিম লীগ ৩৮ টি, প্রজা পার্টি ৩৯ টি এবং স্বতন্ত্র ৩৭ টি আসন থেকে ২১ টি মুসলিম লীগে ও ১৬ টি প্রজা পার্টিতে অংশ নেয়। সর্বাধিক আসন পাওয়া কংগ্রেসকে মন্ত্রীসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানালে শরৎ বসু সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। তাই প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা গঠনের চেষ্টাও ব্যর্থ হলে শেরে বাংলা সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করে। এতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আবার মন্ত্রীসভা গঠনের অল্পদিনের মধ্যেই ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করে তার সভাপতি নির্বাচিত হন। সোহরাওয়ার্দী নির্বাচিত হয় দলের সাধারণ সম্পাদক। দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের দুই নেতার সমন্বয়ে মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা দিতে সক্ষম হয়। এছাড়াও মন্ত্রীসভা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যার মধ্যে রয়েছে- ১৯৩৮ সালের 'ঋন সালিশি বোর্ড' স্থাপন, ১৯৩৯ সালের 'প্রজাস্বত্ব আইন', 'কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন' সংশোধন, ১৯৪০ সালের 'মহাজনি আইন' পাশ হয়। প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে স্কুল বোর্ড গঠন ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন বিল আনায়ন করা হয়।

নির্বাচনের আগের ও পরের আচরণ জিন্নাহর কাছে বিশ্বাস ভঙ্গ মনে হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী জিন্নাহ আস্থা হারায় এবং ১৯৪০ সালে তার 'দ্বি-জাতি' তত্ত্ব ঘোষণা করেন। ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যকার দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। আবার বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্কও সংকটে পরে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় বেশি সংকটে পরে যায়। কেননা বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে অবাঙালিরা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো এবং তাদের আত্মপরিচয় বাঙালি মুসলমান নয়, শুধু মুসলমান এটা দেয়ার চেষ্টা করতো। উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থে জিন্নাহ 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' ঘোষণা করলে বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা করে এবং এই চিন্তার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিলে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। যা মুসলমানদের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে, স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। ফলে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়।(৭) তবে বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের রাষ্ট্রচিন্তা থেকে ভিন্ন ছিলো। বাঙালি মুসলমানরা শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্র নয়, তাদের জন্য অখন্ড বাংলা রাষ্ট্রের চিন্তা করতেন।

১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাঙালি মুসলমান এবং বাংলার রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা সরকার গঠন করে। যদিও এই নির্বাচনে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে কংগ্রেস ৬০ টি আসন, মুসলিম লীগ ৩৮ টি, প্রজা পার্টি ৩৯ টি এবং স্বতন্ত্র ৩৭ টি আসন থেকে ২১ টি মুসলিম লীগে ও ১৬ টি প্রজা পার্টিতে অংশ নেয়। সর্বাধিক আসন পাওয়া কংগ্রেসকে মন্ত্রীসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানালে শরৎ বসু সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। তাই প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা গঠনের চেষ্টাও ব্যর্থ হলে শেরে বাংলা সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করে। এতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আবার মন্ত্রীসভা গঠনের অল্পদিনের মধ্যেই ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করে তার সভাপতি নির্বাচিত হন। সোহরাওয়ার্দী নির্বাচিত হয় দলের সাধারণ সম্পাদক। দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের দুই নেতার সমন্বয়ে মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা দিতে সক্ষম হয়। এছাড়াও মন্ত্রীসভা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যার মধ্যে রয়েছে- ১৯৩৮ সালের 'ঋন সালিশি বোর্ড' স্থাপন, ১৯৩৯ সালের 'প্রজাস্বত্ব আইন', 'কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন' সংশোধন, ১৯৪০ সালের 'মহাজনি আইন' পাশ হয়। প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে স্কুল বোর্ড গঠন ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন বিল আনায়ন করা হয়।

নির্বাচনের আগের ও পরের আচরণ জিন্নাহর কাছে বিশ্বাস ভঙ্গ মনে হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী জিন্নাহ আস্থা হারায় এবং ১৯৪০ সালে তার 'দ্বি-জাতি' তত্ত্ব ঘোষণা করেন। ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যকার দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। আবার বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্কও সংকটে পরে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় বেশি সংকটে পরে যায়। কেননা বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে অবাঙালিরা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো এবং তাদের আত্মপরিচয় বাঙালি মুসলমান নয়, শুধু মুসলমান এটা দেয়ার চেষ্টা করতো। উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থে জিন্নাহ 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' ঘোষণা করলে বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা করে এবং এই চিন্তার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিলে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। যা মুসলমানদের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে, স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। ফলে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়।(৮) তবে বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের রাষ্ট্রচিন্তা থেকে ভিন্ন ছিলো। বাঙালি মুসলমানরা শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্র নয়, তাদের জন্য অখন্ড বাংলা রাষ্ট্রের চিন্তা করতেন।

 

তথ্যসূত্রঃ

১। বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ প্রকাশ, পৃষ্ঠা- ৪২৫

২। শেকড়ের সন্ধানেঃ বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়, মাহমুদ

৩। দ্বিজাতিতত্ত্ব, লাহোর প্রস্তাব ও বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা, হারুন-অর-রশিদ

৪। বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, হারুন-অর-রশিদ

৫। বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ প্রকাশ, পৃষ্ঠা- ৪২৭

৬। মুসলিম লীগ/পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি অবাঙালি দ্বন্দ্ব, হারুন-অর-রশিদ

৭। বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন, হারুন-অর-রশিদ

৮। স্বাধীন অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ১৯৪৭ ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, হারুন-অর-রশিদ

 

বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটঃ ১৯৩৭-৪৭ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন




লেখাটি দ্বিমাসিক ইতিহাসের খসড়া পত্রিকায় প্রকাশিত।

ইতিহাসের খসড়া
বর্ষ- ৯ম, সংখ্যা- ৫
মার্চ-এপ্রিল ২০২৩
বৈশাখ ১৪৩০ বাংলা

No comments:

Post a Comment