Friday, March 18, 2022

আবদ্ধ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

কোথাও আলো বাতাস নেই এমন একটা বদ্ধ ঘরে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় বসে আছে সুনয়না। বসে আছে বললে ভুল হবে জোড় করে তুলে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। শেষ বিকালে সুনয়না যখন বাড়ির পাশের সবুজ মাঠে একলা মনে পায়চারি করছিলো তখন পিছন থেকে কে যেন চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে এসেছে। এরপরে যখন চোখ খুলে দেয়া হলো তখন অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলো। কোথায় আছে, কয়টা বাজে কিছুই অনুমান করতে পারছেনা। এমন অবস্থায় ভয়ে কান্না শুরু করে দিলো, কিন্তু চোখের জল গড়িয়ে পড়লেও শব্দ কেউ শুনতে পাবার সুযোগ ছিলো না। আপ্রাণ চেষ্টা করতে ছিলো চিৎকার করতে কিন্তু এর মধ্যে নিয়নের আলো চোখে এসে পড়লো। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে সামনে রায়হান দাঁড়িয়ে। রায়হানকে দেখে মনে সাহস হলো কিন্তু তার কথা শুনে ভয়ে আবার কুকড়ে গেলো। রায়হান শুধু বলে চলছে ভয় পেয়েও না, তোমার কোন ক্ষতি করবো না। ভয় পেয়েও না সুনয়না। সুনয়না কান্না করে চলছে আর বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। রায়হান শুধু বলে যাচ্ছে, ভয় পেয়েও না তুমি। তোমার কোন ক্ষতি করবো না। শুধু নয়ন ভরে তোমাকে দেখার জন্য, তোমার সাথে সারাক্ষণ কথা বলার জন্য নিয়ে এসেছি। রায়হান কথা বলতে বলতে সুনয়নার মুখের বাঁধন খুলে দিলে সে জোড়ে চিৎকার করে। চিৎকারের শব্দে সুনয়নার ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে তখনও শরীর কাঁপছে, শীতের মধ্যেও কপালে ঘাম জমেছে।

অনেকক্ষণ বিছানায় বসে থেকে স্থির হয়ে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে কিচেনে চলে গেলো। প্রচন্ড চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে তার। সুনয়না সাধারণত আটটার আগে ঘুম থেকে উঠে না। আর চা নিজে বানিয়ে খাবে তাতো ভাবাই যায় না। কিন্তু আজ সে নিজ হাতে এক মগ চা বানিয়ে গায়ে চাঁদর জড়িয়ে বারান্দায় চলে যায়। গত রমজানের পরে এমন সকাল তার দেখা হয়নি। তাই শীতের হালকা কুয়াশাচ্ছান্ন সকালের প্রকৃতি দেখছে। কেমন করে কুয়াশা ভেদ করে প্রথম সূর্যটা তার রক্তিম আলোয় ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুকে মাটির বুকে ফেলে দিচ্ছে, নামাজ শেষে মুসুল্লিরা যে যার বাসায় ফিরছেন, কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলো কাজে বেড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের দেখে রাস্তায় হাঁটতে থাকা দুয়েকটি কুকুর ঘেঁঊ ঘেঁঊ করছে। সুনয়না চায়ে চুমুক দিতে দিতে এই সব দেখছে আর ভাবছে তার স্বপ্নের কথা। স্বপ্নের কথা ভাবতেই শরীর শিহরিয়ে উঠছে। কেন এমন স্বপ্ন দেখলো? রায়হানের সাথে তো তার ভালো একটা সম্পর্ক। রাগ তো দূরের কথা তার সাথে রায়হান তো কখনো কোন কথা নিয়েও বাড়াবাড়ি করেনা। কিন্তু এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম? এই কথা ভাবতে ভাবতে তার দাদীর কথা মনে পড়ে গেলো। দাদীর কাছে কোন স্বপ্নের কথা বলতে গেলেই বলে, স্বপ্ন তো স্বপ্নই । এ নিয়ে ভাবনার কিছুই নেই। সুনয়না এই সব ভাবছে আর সূর্যের সোনালী আলো গাছের ফাঁক দিয়ে কুয়াশা ভেদ করে তার চোখে এসে পড়তেই মোবাইলের ট্যুং ট্যুং শব্দ বেঁজে উঠলো। শব্দ শুনে সুনয়না বারান্দা থেকে রুমে চলে আসলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে রায়হানের টেক্সট, গুড মর্নিং। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে গুড মর্নিং রিপ্লাই দিতে দিতে বিছানায় শুয়ে পরলো। অন্যদিন হলে সুনয়না আর কোন রিপ্লাই দিতো না, কিন্তু আজ আবার রিপ্লাই দিলো, ঘুম কি শেষ?

রায়হানঃ হুম। তোমার?

সুনয়নাঃ আমার অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গেছে, আর ঘুম হয়নি।

রায়হানঃ কেন? কি হয়েছে।

সুনয়নাঃ অনেক ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, আর ঘুমাতে পারিনি।

রায়হানঃ কি এমন স্বপ্ন? বলো।

সুনয়নাঃ থাক, পরে বলি।

রায়হানঃ আচ্ছা। ঘুমানোর চেষ্টা করো।

রায়হান কখনোই জোড় করেনা। সুনয়না যা বলে তাই মেনে নেয়। আজও তাই করলো। কিন্তু সুনয়নার ঘুম আর আসছে না। সে ভাবছে কেন এমন স্বপ্ন দেখলাম। রায়হানকে তো অনেক দিন থেকেই চিনি, অনেক দিন থেকেই কথা হয় নিয়মিত, কিন্তু কখনো তো কোন খারাপ আচরণ করেনি, এমন কি একটা খারাপ কথাও বলেনি। আমিও তো কখনো ওর সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করিনি। তাহলে এমন স্বপ্ন কেন? তাহলে কি রায়হান তাকে অনেক বেশি কাছে চায়? তাই এতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। আর ভাবতে পারছে না। রায়হান যে সুনয়নাকে পছন্দ করে, অনেক ভালোবাসে তা সে বুঝতে পারে। আল্লাহ মেয়েদের এই একটা অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন। মেয়েরা যে কোন ছেলের চোখের ভাষা খুব সহজেই বুঝতে পারে। সুনয়নাও বুঝতে পারে, কিন্তু রায়হান তো কখনো বলেনি যে, সুনয়না আমি তোমাকে ভালোবাসি কিংবা তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? তবে রায়হানের এই কথা বলার আকুলতা, দেখা করার ব্যাকুলতা, দেখা হলে চোখের পানে অপলক তাকিয়ে থাকা বেশ ভালোই লাগে সুনয়নার। আসলে প্রত্যেকটা মেয়েই চায় কেউ তার জন্য অপেক্ষা করুক, তার চোখে তাকিয়ে রুপের-গুণের প্রশংসা করুক। সুনয়না অন্য সকলের চেয়ে আলাদা হলেও রায়হানের বিষয়টা তার কাছে ভালো লাগে। রায়হানের সাথে দেখা হলেই সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা, আবার তাকাতে না করলে রাগে মুখ গোমড়া করে থাকা, অন্য দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া, দেখো আমি তোমার চোখের মাঝে ভরসা খুঁজে পাই। তোমার কথা আমাকে পথ চলতে সাহায্য করে, আমাকে স্বপ্ন দেখায়। তুমি পাশে থাকলে আমি সফল হতে পারবো। এই সব ভাবতে ভাবতে সুনয়না ঘুমিয়ে পড়ে।

মায়ের ডাকে যখন ঘুম ভাংগে তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর। মা একটু রাগ করেই বলে এতো ঘুমালে হবে? গোসল, খাওয়া লাগবে না? সুনয়না মাকে ঝড়িয়ে ধরে। মা বাবার বড়ই আদরের মেয়ে সুনয়না। সবাই যখন অফিস নিয়ে ব্যস্ত তখন সুনয়নাই মায়ের সব সময়ের সঙ্গী। কলেজে আসা যাওয়া আর ক্লাসের সময়টুকু বাদে সব সময়ই মা বাবার সাথে কাটে সুনয়নার।

শীতের দুপুর তবে আকাশে ঝলমলে রোদ ছিলো। তাড়াতাড়ি গোসল করে সুনয়না মোবাইলটা হাতে নিয়ে বারান্দার রোদে বসে। ডাটা অন করতেই রায়হানের অনেকগুলো টেক্সট আসে। টেক্সটগুলো দেখলো কিন্তু রিপ্লাই দিলো না। পেটে ক্ষুধারা তাড়া দিচ্ছে। সেই সকালে এক মগ চা ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। ঐদিকে আবার খাবার টেবিল থেকে সুনয়নার প্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানীর ঘ্রাণে আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছিলো না, তাই দ্রুত খাবার টেবিলে চলে যায়। আজ বন্ধের দিন, সবাই বাসায়। তাই মায়ের এই আয়োজন। টমেটো, গাঁজর, শশার সালাদের সাথে সুনয়নার নিজ হাতে তৈরী করে রাখা জলপাইয়ের আচারে মন ভরে খেয়ে নিলো দুপুরের খাবার। অনেক দিন পরে সবাই খাবার টেবিলে এক সাথে অনেক্ষণ আড্ডা শেষে সুনয়না রুমে চলে যায়।

সারাদিনে রায়হান আর কোন টেক্সট করেনি। রাতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সুনয়না ইউটিউবে মুভি দেখতেছে এরমধ্যে রায়হানের টেক্সট, রাতে বাড়িতে যাচ্ছি। অনেক দিন তোমার সাথে কথা হবে না, দেখা হবে না। খুব মিস করবো। সুনয়না রিপ্লাই দিলো, সমস্যা নেই। আসলে তো কথা হবে, দেখা হবে। মাঝে মাঝেই রায়হান দশ পনের দিনের জন্য এমন করে চলে যায়। সুযোগ হলে টেক্সট করে, তবে বেশি কথা হয় না। রায়হানের সবাই গ্রামে থাকে। গ্রামটা এমন যে, বিদ্যুত ঠিক মতো থাকে না, মোবাইলে ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। রায়হান সবাইকে ছেড়ে শহরে আছে উচ্চ শিক্ষা আর ভালো একটা ক্যারিয়ারের জন্য। তা-না হলে সেও শহরে থাকতো না। শহরের এই যান্ত্রিক জীবন, অপরিচিত মানুষ, চারিদিকে হর্ণ তার ভালো লাগে না। তবে সুনয়না জানে যেখানে থাকুক একটু সময়ের জন্য হলেও রায়হান তার সাথে কথা বলবে। তাই তারা এই প্রসংগ বাদ দিয়ে নিত্য দিনের মতো তাদের অন্যান্য কথাবার্তা বলে মোবাইল রেখে দিলো।

প্রায় পনের দিন পরে রায়হানের টেক্সট, কেমন আছো? সুনয়না রিপ্লাই দিলো, ভালো। তুমি?

          রায়হানঃ ভালো। চলে আসলাম। অনেক দিন কথা হয় না, দেখা হয় না কতো দিন।

          সুনয়নাঃ হুম, অনেক দিন।

          রায়হানঃ চলো, কালকে দেখা করি।

দেখা করার কথা বলতেই সুনয়নার সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো। দেখা করতে গেলে যদি এমন কিছু হয়? না থাক। দেখা করার দরকার নেই। কথায় আছেনা যে, বনের বাঘে খায় না, খায় মনের বাঘে। সুনয়নারও সেই অবস্থা হয়েছে। দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি কথাটা না বললেও কেউ কাউকে ছাড়া বেশি দিন দূরে থাকতে পারেনা। দু’জনের প্রতি দু’জনের অগাধ বিশ্বাস আছে। সুনয়নার ইচ্ছে করে দেখা করতে কিন্তু স্বপ্নের ভয়ে সে চুপ করে থাকে। কোন রিপ্লাই দেয় না। অনেকক্ষণ পরে রায়হানের টেক্সট, কেন?

          সুনয়নাঃ সেদিন বলেছিলাম না যে একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি, তাই।

          রায়হানঃ আচ্ছা মনে পড়েছে। কিন্তু স্বপ্নটা কি? বলা যাবে।

          সুনয়নাঃ বলা যাবে। কিন্তু মনে করলেই তো ভয় লাগে।

          রায়হানঃ এতো ভয়ংকর?

          সুনয়নাঃ হুম। অনেক ভয় পেয়েছি সেই দিন। এমন সবপ্ন কখনো ভুলতে পারবো না।

          রায়হানঃ আচ্ছা, শুনি। স্বপ্নটা কি?

          সুনয়নাঃ আচ্ছা বলছি। স্বপ্নে দেখলাম তুমি আমাকে হাত-মুখ বেঁধে জোড় করে তুলে নিয়ে একটা ঘরে আটকে রেখেছো। আমি ভয়ে কাঁপছি, কান্না করছি আর তুমি শুধু বলে যাচ্ছো ভয় পেয়ও না সুনয়না। আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না। আমি শুধু তোমার চোখের পানে তাকিয়ে থাকবো। নয়ন ভরে তোমাকে দেখবো, মনের যতো কথা বলবো। তুমি কান্না করো না সুনয়না, তোমার কোন ভয় নেই। কিন্তু আমি কান্না করেই যাচ্ছি। কান্না করতে করতেই আমার ঘুম ভেংগে গেলো।

          রায়হানঃ ভয়ের কি আসে সুনয়না? সুন্দর স্বপ্ন দেখেছো। সত্যিই তো তোমাকে যদি এমন করে হলেও নিয়ে আসতে পারতাম কতো ভালো হতো। সারাক্ষণ তোমাকে দেখতে পারতাম। তোমার নয়ন পানে তাকিয়ে মনের সকল কথা বলতে পারতাম। সব সময়ের জন্য তোমাকে কাছে পেতাম।

টেক্সটা দেখে সুনয়না আর কোন রিপ্লাই দিতে পারলো না। ভয়ে হাত পা কাঁপছে। তাই কোন রিপ্লাই না দিয়ে মোবাইলটা রেখেই সুনয়না চোখ বুঝলো।

 

    আবদ্ধ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

1 comment:

  1. ভালোবাসা মুক্ত করে দিতে হয়। পরের পর্ব কবে পড়তে পারবো?

    ReplyDelete