Tuesday, August 27, 2024

বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ – মোঃ হেলাল উদ্দিন

বিশ্ব ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন সব সময় সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে। বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তাদের সংগ্রাম এবং ত্যাগের মাধ্যমে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাঠামতে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে এবং এর প্রভাব বর্তমান সময়েও বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসের এবং বাংলাদেশে পরিবর্তন নিয়ে আসা সেই সকল আন্দোলনের কথা নিয়েই আজকের এই লেখা।

প্রথম ছাত্র আন্দোলন

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয় চীনে। ১৬০ খ্রিস্টাব্দে চীনের ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এমন কয়েকজন ছাত্রনেতা, যারা মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং ইমপেরিয়ালে পড়তে এসেছেন তুলনামূলক গরিব পরিবার থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেই আন্দোলন সেদিন ছুঁয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষকেও। ছাত্রদের দেখাদেখি সেদিন সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে স্লোগান দেয় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। সরকার এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে এবং ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সরকারি কারাগারে তাদের ভোগ করতে হয় অমানুষিক নির্যাতন আর নিগ্রহ।

ফরাসি বিপ্লব ও বোহেমিয়ান বিদ্রোহ

ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা রাজা ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং তারা নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। এছাড়া তারা তাদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে।

হোয়াইট রোজ আন্দোলন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ গ্রুপ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন, যার নাম রাখা হয়েছিল হোয়াইট রোজ বা শ্বেত গোলাপ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় হিটলার ও নাৎসি বিরোধী বিভিন্ন  স্লোগান। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে হোয়াইট রোজ আন্দোলন ৬টি লিফলেট প্রকাশ করে। এর মধ্যে চতুর্থ লিফলেটটিতে লেখা হয়েছিল- ‘আমরা চুপ করে বসে থাকব না। আমরা তোমার মন্দ বিবেক। হোয়াইট রোজ তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।’ এই লিফলেটগুলো তারা অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক এবং ফোনবুকের ঠিকানা ধরে ধরে ডাকে পাঠাতেন। এছাড়া ফোনের বুথে বুথে রেখে আসতেন, যেন এগুলো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়। ১৯৪৩ সালে এই গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচার শেষে ছয়জন প্রধান সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নাৎসি শাসনে এই আন্দোলন বড় কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও ছাত্রদের এই সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিনে কিছুটা হলেও ফাটল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

গ্রিনসবোরোর অবস্থান ধর্মঘট

১৯৬০ সালে ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার উলওর্থ লাঞ্চ কাউন্টারে সাদা-কালো ভেদাভেদের প্রতিবাদে নর্থ ক্যারোলিনার এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্টে ইউনিভার্সিটির চারজন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। অবস্থান ধর্মঘটে অংশ নেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ ওই চার হলেন- ১৮ বছর বয়সী ইজেল ব্লেয়ার জুনিয়র, ১৯ বছরের ফ্রাঙ্কলিন ম্যাককেইন, ১৭ বছরের জোসেফ ম্যাকনেইল এবং ১৮ বছরের ডেভিড রিচমন্ড। ধর্মঘট শুরু করার মাত্র তিন দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে আরও অন্তত ৩০০ শিক্ষার্থী এসে যোগ দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরও ৫০-এর অধিক শহরে এ ধরনের অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয় । যার ফলস্বরূপ খুব শিগগিরই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাঞ্চ কাউন্টারগুলোতে বর্ণপ্রথা রহিত করা হয়। এক পর্যায়ে ওই চার শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে আন্দোলনের এক অহিংস ছাত্র সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয় এবং এই কমিটি পরবর্তী সময়ে যানবাহনে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণসহ এবং দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত করায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন পাস হয়, যা মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একটি মাইলফলক ছিল। ২০০৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করা চার শিক্ষার্থীর একজন ম্যাককেইন বলেন, “অনিবার্যভাবেই লোকজন প্রায়ই আমাকে বলে- ‘আমি এখন কী করব’?’’- আমি বলে উঠি, ‘এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তোমার চারপাশে তাকাও। একসময় তুমিই দেখতে পাবে- তুমি কী করতে চাও। সাধারণ মানুষের কাছে কখনো প্রত্যাশা কোরো না। কারণ, তারা আসবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয় জাগরণ

১৯৬৮ সালে একাধিক মহাদেশে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার সবগুলো সফল না হলেও এসব আন্দোলন পরবর্তী অনেক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। এ বছরের মার্চ মাসে ওয়াশিংটনের কৃষ্ণাঙ্গ হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। তাদের প্রথম দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ারম্যানের পদত্যাগ, দ্বিতীয়ত- পাঠ্যক্রমে আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসে জোর দেওয়া, তৃতীয়ত- ছাত্রদের অংশগ্রহণে একটি বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা তৈরি এবং চতুর্থত- ইতিপূর্বের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ তৃতীয় এবং চতুর্থ দাবিটি মেনে নেয়। এর এক মাস পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও হারলেমের মর্নিংসাইড পার্কে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমে স্থানীয় বাসিন্দাদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অস্ত্র গবেষণা থিংকট্যাংকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিয়েতনাম যুগের একটি চুক্তি বাতিল করতে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ভবন দখলে নেয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রায় হাজার খানেক পুলিশ তাদের উচ্ছেদ করার জন্য নির্মম হামলা চালালেও শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সেমিস্টারজুড়েই তাদের আন্দোলন চালিয়ে যান এবং বিভিন্ন ভবন দখলমুক্ত করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডে ছাত্র অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৩০০ শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করেন। মার্চ মাস নাগাদ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার। তবে, দেশটির সরকার এই আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত দমন করতে সক্ষম হয় । একই বছরের মে মাসে ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সরবোনে এই দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। ফ্রান্সের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোসহ শিক্ষকরাও ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন করে ২৪ ঘণ্টার এক ধর্মঘট আহ্বান করেন। টানা কয়েকদিনের আন্দোলনে দেশবাসী নাকাল হলেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের গদি টলাতে ব্যর্থ হন আন্দোলনকারীরা। তবে এই আন্দোলন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন

১৯৭০ এবং ১৯৮০’র দশক জুড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েতোর পাবলিক স্কুলগুলোতে বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন জোহানেসবার্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দেশটির তৎকালীন সরকারের একটি শিক্ষানীতির পরিবর্তন। যে শিক্ষানীতিতে বলা হয়, শুধু শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি শিখতে পারবে। আর কালোদের পড়ানো হবে আফ্রিকান ভাষায়। এই বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরা উন্নততর শিক্ষা পাবে, পৃথিবী তাদের সামনে খুলে  যাবে, আর কালো শিক্ষার্থীরা বন্দি থাকবে আফ্রিকান ভাষার শেকলে, তা হতে পারে না। ঠিক করা হলো- এক মৌন মিছিল হবে সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকবে– ‘অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’, ‘আমরাও ইংরেজি পড়তে চাই’ ইত্যাদি  স্লোগান। মিছিল চলাকালে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়। কিন্তু শিক্ষর্থীরা নির্ভয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এ অবস্থায় গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলি খেয়ে প্রথমেই লুটিয়ে পড়েন হেক্টর পিটারসন নামে ১১ বছরের এক কিশোর। শোভাযাত্রা সেদিনের মতো পন্ড হয়ে গেলেও এটি এক দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে রূপ নেয়। আফ্রিকায় শুরু হয়ে যায় ভাষা বিপ্লব। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ১৯৯৪ পর্যন্ত চলেছিল। দীর্ঘ ১৮ বছরের এই আন্দোলনই দেশটির বর্ণবিদ্বেষী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সুদীর্ঘ এই আন্দোলনে দেশটির অন্তত ৫৭৫ জন নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর প্রাণ দিয়েছিল।

তিয়েন আনমেন স্কোয়ার আন্দোলন

১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল চীনের সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শোভাযাত্রা নিয়ে তিয়েন আনমেন স্কয়ারে একত্রিত হয়ে সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের অধিকারের বিষয়ে দাবি তোলেন। পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে প্রায় ১০ লাখ লোক সমবেত হন। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন, চীনা সেনাবাহিনী তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে সমবেত মানুষের ওপর গুলি চালায় এবং এতে কয়েকশো মানুষ নিহত হন। ঠিক কতজন সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তার সংখ্যা কখনও প্রকাশিত হয়নি। এই আন্দোলনের পর চীনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না এলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় কিছুটা উদারনীতি গ্রহণ করা হয়।

ভেলভেট রিভল্যুশন

১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়ার ৮ দিন পর, চেকোস্লোভাকিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রাগ শহরে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী দিয়ে প্রাগ শহরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ৫ লাখ মানুষের বিশাল এক গণসমুদ্রে পরিণত হয়। দাঙ্গা পুলিশ বারবার আক্রমণ চালাতে উদ্যত হলেও আন্দোলনকারীরা তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এই আন্দোলনের ফলে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল ইতিহাসের এক ব্যতিক্রম আন্দোলন। লেখক টিমোথি গার্টেন অ্যাশ-এর ভাষ্যে আন্দোলনটি ছিল ‘দ্রুততম, কোনো মারামারি কাটাকাটি ছাড়া, আনন্দময় এবং হাস্যরসপূর্ণ।’ আধুনিক সময়ের কোনো ছাত্র আন্দোলনই এমন সফল এবং সুকোমল হতে পারেনি।

ইরানের ছাত্র বিক্ষোভ

১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর ৮ জুলাই মাঝ রাতের পর ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে পুলিশের অভিযান এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলার পর ইরানের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভে অংশ নেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়া ১২৫ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে সরকারি বাহিনী। কিন্তু তারপরও অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী ইরানের রাজপথে নেমে আসেন। এই আন্দোলনে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পুলিশি অভিযানের সমালোচনা করে এবং সংযমের আহ্বান জানান। ইরানের রাজনীতিতে এই আন্দোলনের ফলে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসে। ইরানের সাধারণ মানুষ সরকারি নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে নীরবে জীবন অতিবাহিত করলেও দেশটির শিক্ষার্থীরা এখনো যে কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদী অবস্থান নেন।

 

যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে ছাত্ররাই অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নানান গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসহ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বাংলাদেশের ছাত্ররা। যার মধ্যে অন্যতম আন্দোলনগুলো হলো-

ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ এর দেশভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে আন্দোলনের শুরু হলেও চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নামলে ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে শাসকরা। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা।

শিক্ষা আন্দোলন

আইয়ুব খান সরকারের গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকট হয়। এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ১৯৬২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে ফেব্রুয়ারি জুড়ে আন্দোলন চাঙা হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আগস্টে ছাত্র ধর্মঘট ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সেপ্টেম্বর আন্দোলন পরিণতির দিকে যায়। এতে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। হরতালের মিছিলে পেছন থেকে পুলিশ ও ইপিআর আক্রমণ করে এতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত, অনেক আহত এবং শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়।

গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

স্বাধীন দেশের ছাত্ররা ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ঘটান। নূর হোসেন শহীদ হলে এই আন্দোলন চূড়ান্তরুপ পায়। যার বুকে-পিঠে লেখা ছিলো ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এই আন্দোলনে ছাত্ররা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন নিশ্চিত করে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন

সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ২০১৮-এর এপ্রিলের পূর্বে এবং বিগত কয়েক বছর বিচ্ছিন্নভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন চললেও, তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে এসে সারা দেশব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে। ৮ই এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে কোটা সংস্কারের পক্ষে বিক্ষোভ শুরু হয়ে আস্তে আস্তে সেটি বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই ২০১৮ রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় এবং ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চলে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের দমনপীড়নমূলক ব্যবস্থা দেশে ও বহির্বিশ্বে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়। পরবর্তীতে ৬ আগস্ট শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়; যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদন্ড দাবি করেছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয় যা "বাংলা ব্লকেড" কর্মসূচি নামে পরিচিত। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দেয়। ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। আন্দোলনকারীরা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে। ২১ জুলাই ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি পালন করে। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে ঘিরে ৪ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ৯৮ জনের বেশি সাধারন মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন এবং এরই সাথে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময় শাসনের অবসান হয়।


(মোঃহেলাল উদ্দিন – শিক্ষক, লেখক ও গবেষক)

  পত্রিকার লিঙ্কঃ বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ (ভোলার খবর)

পত্রিকার লিঙ্কঃ বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ (বাহান্ন নিউজ)

 

No comments:

Post a Comment