Thursday, October 5, 2023

বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং একজন শিক্ষকের পেশাগত নীতি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্টিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় শিক্ষক কনফারেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় এবয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা গৃহীত হয়। সেই সুপারিশসমূহের একটি হলো বিভিন্ন দেশে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করা। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ^ব্যাপী ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশও দিবসটি উপলক্ষ্যে সেমিনার, আলোচনা সভা, বিশিষ্ট ও কৃতী শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করে থাকে। বিষয়টি সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু দায়িত্ব সচেতন এবং নিবেদিত শিক্ষক তৈরির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আরো উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, পদোন্নতি, পদ-মর্যাদা, শিক্ষাদানের পরিবেশ, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ে অধিকতর চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ইউনেস্কো/আইএলও- এ শিক্ষাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে ব্যক্ত করে শিক্ষার অগ্রগতি, দেশ, জাতি ও আধুনিক সমাজ গঠনে শিক্ষকের অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সুপারিশপত্রের Guiding Principles - এ বলা আছে,‘ ‘Teaching should be regarded as a profession: it is a form of public service which requires teachers expert knowledge and specialized skills, acquired and maintained through rigorous and continuing study; it also calls for a sense of personal and corporate responsibility for the education and welfare of the pupils in their change. (Guiding Principles- Section II, Article-6).’ শিক্ষকের এই ভূমিকা পালন করতে তাঁর পেশাগত কিছু নীতি মেনে চলতে হয়, যা পেশাজীবী শিক্ষক হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

‘নীতি’ শব্দটি নৈতিকতার সাথে যুক্ত, যার সাথে আদর্শের বিষয়টিও জড়িত। নীতি বলতে এমন মানদন্ডকে বুঝায় যার দ্বারা আমরা একজন মানুষকে চরিত্রবান, আদর্শ মানুষ বলে থাকি। আমেরিকান শিক্ষাবিদ Ralph E. Himslead বলেন, ‘Ethics is concerned with morality, with ideal human character.’পেশা বলতে বুঝায় একজন মানুষ যে কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে পেশার সাথে শুধু আয় রোজগারের বিষয়টিই সম্পৃক্ত নয়, সমাজ এবং মানবতার সেবা বা কল্যাণও সম্পৃক্ত। শিক্ষকতা একটি পেশা আর যিনি শিক্ষকতা করেন তিনি একজন শিক্ষক। কাজেই শিক্ষক হলেন পেশাজীবী আর পেশাজীবী হিসাবে পেশাগত নীতির প্রতি আস্থা ও অনুসরণ করার মাধ্যমে পেশার মর্যাদা নিশ্চিত হয়। একজন শিক্ষককেও তাই কতিপয় পেশাগত নীতি পালন করতে হয়।

এই পেশাগত নীতিসমূহের মধ্যে রয়েছে- ১. পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষকতা এমা একটি পেশা যার দ্বারা অন্য সকল পেশাজীবীর শিক্ষার হাড়েখড়িসহ সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তাই মানবকল্যাণই এখানে মূখ্য, লাভ-ক্ষতির হিসাব গৌণ। ২. পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষককে গুরু দায়িত্বের কথা মনে রাখতে হয়। কেননা পরবর্তী রাষ্ট্রনায়ক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক, প্রকৌশলীসহ সবার শিক্ষার দায়িত্ব তাঁর হাতে বরতায়। ৩. বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আরো বেশি শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক, তাই শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে পরিচালনার যোগ্যতা শিক্ষককে রাখতে হবে। ৪. শিক্ষককে অবশ্যই শেখার এবং শেখাবার ইচ্ছা থাকতে হবে। শেখাবার ইচ্ছা শিক্ষকে যোগ্যতম করে তোলে। আর পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সাথে মিল রেখে শিক্ষকে তার জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। তাই শিক্ষককে সারাজীবন ধরে শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে নিজেকে শিক্ষা নিতে হবে। ৫. প্রতিটি পেশার জন্য কিছু নীতিমালা থাকে। পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষকদেরও কিছু নীতিমালা মানতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে- পেশার প্রতি একাগ্রতা, দায়িত্ব পালনে সচেতনতা, কর্মে দক্ষতা, শিক্ষার্থীদের মন-মানসকে জানা, জানার আগ্রহ ও নিত্য নতুন জ্ঞান আহরণের বাসনা, নিরলস জ্ঞান চর্চা, সমাজ সচেতনতা এবং সামাজিক কর্মকান্ডে অবদানের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা প্রভৃতি। উল্লেখিত নীতিমালার প্রথম তিনটি সকল পেশার জন্য হলেও পরবর্তীগুলো বিশেষভাবে শিক্ষকদের জন্য। ৬. প্রতিটি পেশাতেই পেশাজীবী সংগঠন থাকে। শিক্ষকতা পেশাতেও সংগঠন থাকা বাঞ্ছনীয়, যার মাধ্যমে তাদের দাবী-দাওয়া তুলে ধরা যায় এবং নিজেদের অধিকার রক্ষা করা সহজ হয়। ইউনেস্কো/আইএলও- এর সুপারিশপত্রের Guiding Principles- এ বলা আছে, ‘‘Teachers’ Organizations should be recognised as a force which can contribute greatly to educational advance and which therefore should be associated with the determination of education policy.’’ ৭. সবাই ভালোবেসে শিক্ষকতা পেশায় আসে না। বিভিন্ন কারণে এই কাজের সাথে সঙ্গতি বিধান না করতে পেরেও শিক্ষকতা পেশায় রয়েছেন। তাদের এই অসঙ্গতি দূর করতে আত্মবিশ্লেষণ অপরিহার্য। আর আত্মবিশ্লেষণের জন্য নিজেকে কতিপয় প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন- ক. আমি কি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি? খ. শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পূর্বে আমি কি প্রস্তুতি নিচ্ছি? গ. আমি কি শিক্ষার্থীদের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন? ঘ. আমি কি সব শিক্ষার্থীদের প্রতি সমান আচরণ করছি? ঙ. আমি কি শিক্ষার্থীকে তার ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করছি? চ. আমি কি পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্য সম্পর্কে সচেতন আছি? ছ. পেশাগত উন্নয়নের জন্য আমি কি নিজ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি? জ. আমি কি আমার পেশা সংক্রান্ত বই-পুস্তক পাঠ করছি? ঝ. আমি কি আমার সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছি? ইত্যাদি প্রশ্নগওলোর উত্তর বের করে নিজেই নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে উন্নয়ন বা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করা প্রয়োজন।

শিক্ষকতায় সাফল্যের জন্য মর্যাদা বৃদ্ধি প্রয়োজন আর এই মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আত্মোন্নয়ন জরুরি। আত্মোন্নয়ন শিক্ষকের তরফ থেকে আসতে হয়। তাই পেশাজীবী হিসাবে শিক্ষকতাকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে অবশ্যই শিক্ষকদের নিজেদের নৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। নিত্য নতুন তথ্য জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সময়ে সাথে, প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত করে আপডেট থাকতে হবে। ব্যক্তিগত এবং পেশাগতভাবে নিজেকে উন্নত করতে পারলেই শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা নিশ্চিত উন্নত হবে। তাই শিক্ষকতা পেশাজীবী হিসাবে একজন শিক্ষককে পেশাগত নীতিসমূহ মেনে চলতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা।

লেখক: মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা এবং ফেলো, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল: helaluddin565@gmail.com

 

পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার লিঙ্কঃ

  বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং একজন শিক্ষকের পেশাগত নীতি 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:

Post a Comment