Friday, August 12, 2022

জহির রায়হান এর 'হাজার বছর ধরে' পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

“জীবনের হাটে সকল বেচাকেনা শেষ করে দিয়ে একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ওরা। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো।

রাত বাড়ছে।

হাজার বছরের পুরানো সেই রাত।”

সেই রাত বাড়ার মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে হাজার বছরের ইতিহাস। এই ইতিহাস গ্রাম-বাংলার সামাজিক ইতিহাস। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার সামাজিক প্রথা, কুসংস্কার, সাংসারিক টানা পোড়ন, নারী নির্যাতন, রোগ-শোক, সামাজিক বন্ধনের মতো বিষয়গুলো। উপন্যাসটি ১৯৬৪ সালে লিখেছিলেন এবং এই বছরই আদমজি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলো উপন্যাসটি। উপন্যাসটি লেখা নিয়ে একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটি হলো, জহির রায়হানের বন্ধু ‘সচিত্র সন্ধানী’-র সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য অনেক দিন ধরে একটা উপন্যাস লিখতে বলতে ছিলো কিন্তু জহির রায়হান সিনেমা তৈরী নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে কোন সময়ই দিতে পারছিল না। তাই গাজী শাহাবুদ্দিন বাধ্য হয়ে শুটিং স্পটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকতো, শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে উপন্যাস লিখতেন। শুটিং এর মধ্যেই উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন। তবে কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে, গাজী শাহাবুদ্দিন তাকে এক সপ্তাহের জন্য জোর করে ধরে নিয়ে এসে একটা রুমে বসে উপন্যাসটি লিখতে বাধ্য করেন এবং বলেন তার যা যা দরকার সব রুমে দেয়া হবে কিন্তু বাইরে যেতে দেয়া হবে না। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন, জহির রায়হান উপন্যাসটি কোন গ্রামে না গিয়ে শহরে বসে অল্প সময়ে লিখে দেন। উল্লেখ্য যে, গাজী শাহাবুদ্দিন এবং জহির রায়হান বন্ধু ছিলেন এবং উপন্যাস লেখার সময় জহির রায়হানের বয়স ছিলো ২৯ বছর।

‘পরীর দীঘি’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। এই পরীর দীঘি হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামস্থ ‘জগন্নাথ দীঘি’। সেই জগন্নাথ দীঘি ও তার পাশের কয়েকটি গ্রাম নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনী। উপন্যাসের চরিত্রগুলো হলো-

  • বুড়ো মকবুল – শিকদার বাড়ির প্রধান ও মুরব্বি
  • আমেনা – বুড়ো মকবুলের প্রথম স্ত্রী
  • ফাতেমা – বুড়ো মকবুলের দ্বিতীয় স্ত্রী
  • টুনি – বুড়ো মকবুলের তৃতীয়া স্ত্রী ও উপন্যাসের নায়িকা
  • মন্তু – উপন্যাসের মূলচরিত্র
  • আম্বিয়া – করিমের বোন, উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে মন্তুর স্ত্রী
  • ফকিরের মা – প্রতিবেশী
  • আবুল – প্রতিবেশী
  • হালিমা – আবুলের স্ত্রী
  • গনু মোল্লা – ধর্মীয় ব্যক্তি (প্রতিবেশী)

উপন্যাসটি প্রধানত তিনটি চরিত্র কেন্দ্রিক হলেও, প্রত্যেকটা চরিত্রের আছে বিশেষ গুরুত্ব । আবুলের কথাই ধরা যাক, যার কাজই ছিলো বউ পেটানো। আবুলের পিটুনি খেয়ে তিনটি বউ আয়েশা, জমিলা আর হালিমা মারা গেলো। যা ততকালীন বাঙ্গালী সমাজেরই চিত্র নয়, নারী নির্যাতনের এমন চিত্র এখনো এই সমাজেও বিদ্যমান, ধরন পাল্টেছে শুধু। গ্রামের ধার্মিক ব্যক্তি ছিলো গনু মোল্লা। মানুষের বিপদে আপদে, ঝাড়-ফুঁকে যাকে সব সময় পাওয়া যেতো। বুড়ো মকবুল তার নারিকেল, সুপারি আর কৃষি জমি নিয়ে জানান দিচ্ছে যে গ্রামীণ জীবন কৃষি নির্ভর এবং সংসার, গৃহস্থী কাজ করেই জীবন চলে। আমেনা, ফাতেমা আর টুনি ছিলো তার হাতিয়ার। আয়ের মাধ্যম ছিলো কৃষি তাই কৃষি কাজেও তিন বউয়ের ডাক পড়ত। তিন বউ, কৃষি আর এক মেয়ে নিয়েই ছিলো মকবুলের সংসার। তবে বুড়ো মকবুলের বউদের দিয়ে কাজ করানোর মধ্য মাঝে মাঝে বাঁধ পরতো ফকিরের মায়ের। কিন্তু বুড়ো মকবুল তা কেয়ার করত না।

মকবুলের ছোট বউ টুনি। উপন্যাসের একটি মূল চরিত্র। যার সাথে ছিলো মন্তুর একটা ভাব। পরকীয়া প্রেমও বলা যেতে পারে একে। টুনি আর মন্তু মকবুলের চোখের আড়ালে দীঘির পাড়ে বসে গল্প করা, রাতের আধাঁরে মাছ ধরতে যাওয়া, শেষ রাতে খেজুর রস চুরি করার সাহস, শাপলার বিলে নৌকায় চড়ে শাপলা তোলা এমন মধুর সময় পাড় করার বর্ণনা এক সুন্দর প্রেমের কাহিনী। আবার আম্বিয়া মন্তুর দিকে চেয়ে তার অপ্রকাশ্য প্রেমের এক প্রকাশ্য রুপ দেখায়, যা ত্রিভূজ প্রেমের দিকে নিয়ে যায় উপন্যাসটিকে।

টুনি, মন্তু আর আম্বিয়ার এই চিত্র দেখে মনে হয়, মন্তুর আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করবে টুনির সনে আর আম্বিয়াকে নিয়ে ঘর বাধবে গহীন বালু চড়ে যা উপন্যাসের শেষে দেখা যায়। বুড়ো মকবুল মারা যাবার পর টুনি এই অনুশোচনায় ভুগতে থাকে যে, বুড়োর মৃত্যুর জন্য টুনিই দায়ী। তাইতো মন্তু তাকে বিয়ে করতে চাইলেও ফিরিয়ে দেয়। মন্তুকে ফিরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আরো একটি বিষয় সামনে আসে যে, ঐ সময়ে বিধবা বিয়ে হলে যে সমাজ এ নিয়ে কটু কথা বলবে, এমন কি তাদের সমাজচ্যুতিও হতে পারে। তাইতো বুড়ো মকবুলের স্মৃতি বুকে নিয়ে টুনি চলে গেলে মন্তু বিয়ে করে আম্বিয়াকে। এভাবেই শেষ হতে থাকে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের কাহিনী।

উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে একান্নবর্তী পরিবার, সমাজের বাস্তব চিত্র। ফুটে উঠেছে গ্রামীণ লোকাচার, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, নানান ধরনের কুসংস্কার, বিশেষ করে ওলা বিবির হাত থেকে বাঁচার জন্য, মনের মানুষকে পাবার জন্য ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজের মতো কর্মকান্ড, নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইত্যাদি।

 হাজার বছর ধরে -- জহির রায়হান 
(পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন)

No comments:

Post a Comment