Friday, November 15, 2024

'দিনের শেষে' আসলেই সবাই একা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 ‘দিনের শেষে’ বইটি একটি প্রেমের উপন্যাস, তা বলাই বাহুল্য। উপন্যাসের শুরুতে তিনি ইশরাত নামের কাউকে উৎসর্গ করেন যেখানে লেখা ছিল, ‘জনম জনম কাঁদিও।’ এটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপন্যাসে ‘জনম জনম কাঁদিব’ গানটি কয়েকবার আসবে এবং তা পরিস্থিতির সাথে বেশ ভালোভাবে মানিয়ে যাবে। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের গান-কবিতার ব্যবহার বেশ ভালো লাগে আমার।

যাই হোক, মূল কথায় ফিরে আসি। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জহির নামের একজন যুবক। হুমায়ূন আহমেদের নায়কদের সিগনেচার বৈশিষ্ট্যের একটি হলো, নায়ককে শুরুতে মনে হবে বোকা প্রকৃতির কিন্তু কাহিনির ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান।

সাদাসিধে জহিরকে ভালবাসে অরু, তরু নামের দুই মামাতো বোনই। কিন্তু জহির তাদের ভালবাসা বুঝতে পারে না বা বুঝলেও না বোঝার ভান করে থাকে। উপন্যাসের শুরুটা হয়, জহিরের অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা করিম সাহেবের বর্ণনা থেকে। জহিরের প্রতি তার ভাবনা থেকে মোটামুটি জহিরের চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তার কথা ও বিভিন্ন কার্যক্রম পড়ে বোঝা যাচ্ছিলো, তিনি জহিরকে বেশ স্নেহ করেন কিন্তু কাহিনির শেষের দিকে বলেন, ‘তোমাকে আমি কী রকম পছন্দ করি তা কি তুমি জানো?’ এমন বক্তব্যের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। গল্পে বেশ হালকা চালে একে একে চরিত্র প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার কায়দাটি আমার ভালো লেগেছে। অনেকটা স্পটলাইট একজন থেকে অন্যজনে ঘুরে ঘুরে আসার মত ব্যাপার।

তবে, উপন্যাসের শুরুতে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে করিম সাহেবকে আনা হয়েছিলো, ততোটা গুরুত্ব তিনি পরবর্তীতে পাননি। এমনটা ঘটেছে, অরুর ছোট বোন তরুর ক্ষেত্রেও। তার সাথে জহিরের কথোপকথন শুনে মনে হচ্ছিল, তরুর চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য নায়িকার তুলনায় বেশ স্বাভাবিক এবং তার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল, তরু অন্যান্য নায়িকার মত রূপবতী ছিল না। কিন্তু করিম সাহেবের মত তরুর গুরুত্বও ক্রমে ফুরিয়ে যায়। গল্পের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠে অরু। হবে না-ই বা কেন হুমায়ূন আহমেদের গল্পের নায়িকা তো সাধারণ কেউ হতেই পারে না। অরু আত্মকেন্দ্রিক, ছন্নছাড়া স্বভাবের মেয়ে যে কিনা বরিশাল মেডিকেলে পড়া বাদ দিয়ে তার কলেজের ইতিহাস বিভাগের একজন স্যারের কথার প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে পালিয়ে যায়। সেই স্যারের আবার স্ত্রী সন্তানও রয়েছে। কিন্তু অরু মনেপ্রাণে ভালবাসে জহিরকে।

উপন্যাসের বিশেষ চরিত্রে ছিল, অরুর স্বামী আজাহার। যিনি বেশ কায়দা করে মানুষের আকর্ষণের উদ্রেক হয় এমনভাবে গল্প করেন। তিনি মদ খান, তাস খেলেন, সংসার ছেড়ে আসায় তাকে হতাশ মনে হয় কিন্তু স্ত্রীকে তার মত করে ভালোও বাসেন। তবে অরু যে জহিরকে ভালবাসে তা জানার পরও তিনি জহিরের প্রতি বেশ উদার। কথা শুনে মনে হয়, জহিরের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ তো নেইই বরং তিনিও এই মানুষটির প্রতি মমতাবান। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে চরিত্রের স্বাভাবিকতা থাকে না কিন্তু তার জাদুকরী লেখা দিয়ে দর্শককে অস্বাভাবিক বিষয়ও বেশ স্বাভাবিকভাবে গেলান। আজহার চরিত্রটির ভালো মানুষী অস্বাভাবিক। উপন্যাসে বোঝা যাচ্ছিলো, কেবল লেখক চাইছেন বলেই জহিরের প্রতি সবাই অকারণে মমতা প্রদর্শন করেন কিন্তু তাতে তার দুর্ভাগ্য ঘোচে না একটুও।

জহির গ্রামের সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। বিএ পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ার পর সে যখন ঢাকা আসে, প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও তার গায়ে ছিল একটা ছেড়া সোয়েটার যা ঢাকতে সে ফুল হাতা শার্ট পরেছে আর গলায় ছিল লাল রঙের মাফলার। হুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের মধ্যে মায়াভাব প্রবল থাকে। যে কারণেই হয়ত অরু-তরু দুই বোন জহিরের সরলতা আর অসহায়ত্বের প্রতি মমতাময়ী হয়ে তার প্রেমে পিছলে যায়। পুরো কাহিনীতে এমন কোনো বিষয় নেই যা ব্যাখ্যা দেবে কেন দু’জন কিশোরী জহিরের প্রেমে ব্যাকুল।

তবে, বইয়ের সবচেয়ে বিরক্তিকর জায়গাটি হলো, জহিরের মেয়ে দেখতে যাওয়া, মেয়ে পছন্দ হওয়া এবং পরবর্তীতে বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়া। আসমানী নামের যে মেয়েটিকে জহির ও তার মামা দেখতে যায়, তার আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু তা টেলিফোনে। কিন্তু আসমানীর আমেরিকা প্রবাসী স্বামীই বিয়ের প্রায় এক বছরের মাথায় টেলিগ্রামে কোনো কারণ উল্লেখ না করেই সম্পর্ক বিচ্ছেদ করার কথা বলে। কখনো স্বামীর সঙ্গে আসমানীর দেখা হয়নি; এমনটাই পাত্রপক্ষকে জানানো হয়। কিন্তু আমাদের নায়ক তো জায়গামতো খুবই বুদ্ধিমান, তিনি ঠিকই ধরতে পারেন তথ্যটি আসলে ঠিক নয়। হুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের মতো এই আসমানীও অত্যন্ত রূপবতী, মুখে মায়াভাব প্রবল, স্বভাবে অত্যন্ত কোমল।

বইয়ের পৃষ্ঠা কমার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক পাঠিকারা যখন মোটামুটি নিশ্চিত আসমানীর সাথেই জহিরের বিয়েটা হতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই একের পর এক দুর্যোগের ঘনঘটা আসতে থাকে। প্রথমে অরু নিখোঁজ হয়ে যায়, তারপর জহিরের চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, বিয়ের দুইদিন আগে আসমানীর প্রথম স্বামী এসে হাজির হয় এবং বিয়েটা ভেঙ্গে যায় আর সবশেষে যা না করলে চলছিলোই না, পা পিছলে গর্ভবতী অরুর রক্তপাত শুরু হয় এবং সে ও তার গর্ভের সন্তান মারা যায়। যারা হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে অভ্যস্ত তারা নিশ্চয়ই এ ধরনের সমাপ্তির সাথে পরিচিত আছেন। শেষে ট্র্যাজেডি না দিলে চলছে না বলে দুম করে সব দুঃসংবাদ একসাথে হাজির করে উপন্যাস শেষ করে দেওয়াটা মোটেই ভালো লাগেনি।

(ফাবিহা বিনতে হক এর " 'দিনের শেষে’ হুমায়ূন আহমেদের বিকল্প পাঠ" লেখা থেকে নেয়া।)



বইঃ দিনের শেষে
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশকঃ অন্যপ্রকাশ
মূল্যঃ ২৮০ টাকা

Md. Helal Uddin
16.09.2024

No comments:

Post a Comment