Friday, March 22, 2024

এক নজরে বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীসমূহ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

প্রত্যেক দেশের সংবিধানে এর সংশোধনের বিধান থাকে। বাংলাদেম সংবিধানও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করার বিধান রেখেছে। সময়ের চাহিদা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সালে কার্যকর হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংক্ষেপে সংশোধনীসমূহ আলোচনা করা হলো-
 
প্রথম সংশোধনী: সংবিধানের প্রথম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭ অনুচ্ছেদে দুটি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর মূল কারণ ছিল গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য আইন তৈরি এবং তা কার্যকর করা। সংবিধান (প্রথম সংশোধনী) আইন ১৯৭৩ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১২ই জুলাই, ১৯৭৩ সালে।

দ্বিতীয় সংশোধনী: সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২ এ সংশোধন আনা হয়। নিবর্তনমূলক আটক, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও এ সময় মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিতকরণ সম্পর্কে প্রথমদিকে সংবিধানে কোনো বিধান ছিল না। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানগুলো সংযোজন করা হয়। সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধনী) আইন ১৯৭৩ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সালে।

তৃতীয় সংশোধনী: সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান করার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়। সংবিধান (তৃতীয় সংশোধনী) আইন ১৯৭৪ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ২১শে নভেম্বর, ১৯৭৪ সালে।

চতুর্থ সংশোধনী: সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা; একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা; রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রপতি অপসারণ পদ্ধতি জটিল করা; মৌলিক অধিকার বলবৎ করার অধিকার বাতিল করা; উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা এবং বাকশাল গঠন করা হয়। সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন ১৯৭৫ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে।

পঞ্চম সংশোধনী: সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল। পঞ্চম সংশোধনী সংবিধানে কোনো বিধান সংশোধন করেনি। এ সংশোধনী ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে সামরিক শাসন জারির পর থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় আদেশ, ঘোষণা ও দন্ডাদেশ বৈধ বলে অনুমোদন করে নেওয়া হয়। সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন ১৯৭৯ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে। ২০১০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে এ সংশোধনীটি উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়।

ষষ্ঠ সংশোধনী: সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই। ষষ্ঠ সংশোধনী কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে করা হয়নি। এ সংশোধনীর মাধ্যমে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিতকরণ করা হয়। এ সংশোধনীতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী পদকে প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদ বলে গণ্য করা হবে না। সংবিধান (ষষ্ঠ সংশোধনী) আইন ১৯৮১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ১ জুলাই ১৯৮১ সালে।

সপ্তম সংশোধনী: সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল ছিল। তাই এ সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক শাসনামলে জারি করা সব আদেশ, আইন ও নির্দেশকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং আদালতে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করার বিধান করা হয়। এছাড়াও এ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করা হয়। সংবিধান (সপ্তম সংশোধনী) আইন ১৯৮৬ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বিচারপতি কে এম নুরুল ইসলাম ১০ নভেম্বর ১৯৮৬ সালে। ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট এ সংশোধনী আদালতে কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়।

অষ্টম সংশোধনী: সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮৮ সালের ৯ জুন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২, ৩, ৫, ৩০ ও ১০০ এ পরিবর্তন আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতিদান, ঢাকার বাইরে হাই কোর্ট বিভাগের ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, উধপপধ-এর নাম উযধশধ এবং ইধহমধষর-এর নাম ইধহমষধ-তে পরিবর্তন করা হয়। সংবিধান (অষ্টম সংশোধনী) আইন ১৯৮৮ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১১ই মে ১৯৮৮ সালে। তবে হাই কোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করে।

নবম সংশোধনী:
সংবিধানের নবম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮৯ সালের ১০ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সাথে একই সময়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোন ব্যক্তিকে পর পর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ রাখার বিধান সংযোজন করা হয়। সংবিধান (নবম সংশোধনী) আইন ১৯৮৯ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ৬ জুলাই ১৯৮৯ সালে।

দশম সংশোধনী: সংবিধানের দশম সংশোধনী পাস হয় ১৯৯০ সালের ১২ জুন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরো ১০ বছরকালের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সংবিধান (দশম সংশোধনী) আইন ১৯৯০ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন ও বিচারমন্ত্রী হাবিবুল ইসলাম ১০ জুন ১৯৯০ সালে।

একাদশ সংশোধনী: সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। এ সংশোধনীর মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের স্বপদে ফিরে যাবার বিধান করা হয়। এতে আরো বলা হয়, নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করতে পারবেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কর্মকাল বিচারপতি হিসেবে হিসেবে গণ্য হবে। সংবিধান (একাদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন ও বিচারমন্ত্রী মীর্জা গোলাম হাফিজ ২ জুলাই ১৯৯১ সালে।

দ্বাদশ সংশোধনী: সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২রা জুলাই ১৯৯১ সালে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী: সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয় ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ। এ সংশোধনীর মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নিদর্লীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ২১ মার্চ ১৯৯৬ সালে।

চতুর্দশ সংশোধনী: সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস হয় ২০০৪ সালের ১৬ মে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং সরকারি ও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি বা ছবি প্রদর্শনের বিধান করা হয়। সংবিধান (চতুর্দশ সংশোধনী) আইন ২০০৪ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২৭ মার্চ ২০০৪, দ্বিতীয়বার ২৮ এপ্রিল ২০০৪ সালে।

পঞ্চদশ সংশোধনী: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পূনর্বহাল, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, ১/১১ পরবর্তী দ্বিতীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার নিয়ম বহির্ভুতভাবে ৯০ দিনের অধিক ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি প্রমার্জ্জনা, নারীদের জন্য সংসদে ৫০ টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা, অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দন্ডের বিধান রাখা ইত্যাদি যুক্ত করা হয়। সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন ২০১১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ ২৫শে জুন ২০১১ সালে।

ষোড়শ সংশোধনী: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন পাস হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আইন প্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয়। সংবিধান (ষোড়শ সংশোধনী) আইন ২০১৪ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে।

সপ্তদশ সংশোধনী: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন পাস হয় ২০১৮ সালের ৮ জুলাই। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখা হয়। সংবিধান (ষোড়শ সংশোধনী) আইন ২০১৮ উপস্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ৮ জুলাই ২০১৮ সালে।

 


এক নজরে বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীসমূহ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:

Post a Comment