শহীদ ওসমান হাদীর সাথে আমার তেমন বিশেষ কোন স্মৃতি নেই তবু এই লেখা, কারণ তাঁর মৃত্যুটা সবার মতো আমারও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই মনের কষ্টকে যদি কিছুটা লাঘব করা যায় তাই কিছু লেখার চেষ্টা।
শহীদ শরীফ ওসমান বিন হাদী— কিংবা শহীদ ওসমান হাদী; নামের আগে-পিছে যাই যুক্ত হোক, আমার কাছে সে ছিল কেবলই ওসমান। এক নিঃশব্দ, দৃঢ়চেতা মানুষ। যার আসল নাম মোঃ ওসমান গনি— নামটি তাঁর কফিনে লেখা ছিল, আর সেই নাম নিয়েও যখন অপপ্রচারের কোলাহল উঠেছিল, তখন মনে হয়েছিল— মানুষ মরেও শান্তি পায় না, যদি সে সত্যের পথে হাঁটে।
ওসমানের সঙ্গে আমার পরিচয় শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের দিকে, পারিবারিক আত্মীয়তার এক নীরব সেতু বেয়ে। সম্পর্কটা ছিলো এমন— ওসমানের বড় বোন আর আমার ছোট বোন দুই জা; মানে ওসমানের বড় ভগ্নীপতি আর আমার ভগ্নীপতি আপন দুই ভাই। সেই সূত্রেই ২০১০ সালের দিকে একবার তাদের বাসায় যাওয়া। সেই যাওয়া যেন ছিল ভবিষ্যতের অনেক স্মৃতির প্রথম দাগ।
ওসমানের ভগ্নীপতির মুখে তাদের ছয় ভাইবোনের গল্প শুনতাম। বিশেষ করে ওমর আর ওসমানের কথা— তাদের শৈশব, সংগ্রাম, সততা, দায়িত্ববোধ। তখন সেসব গল্প শুধু গল্পই ছিল, আজ বুঝি— সেগুলো ছিল ভবিষ্যৎ শহীদের জীবনপাঠের ভূমিকা।
২০১২ সাল। ঢাকা শহরে পড়াশোনার ব্যস্ত সময়েই ওসমান আর ওমর হারায় তাদের বাবাকে। বাবার মৃত্যু ছিল যেন একটি পাহাড় ভেঙে পড়া— একদিকে মানসিক শূন্যতা, অন্যদিকে সংসারের চাপ। সেই শূন্যতা আর চাপ ওসমানের জীবনকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। কেননা তার বাবা ছিলো তাঁর জন্য সৃষ্টিকর্তার বিশেষ নিয়ামত যার কারনে ওসমানের এই ওসমান হাদী হয়ে উঠা। পরবর্তীতে তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সে কথার প্রতিধ্বনি আমরা সবাই শুনেছি। অসুস্থতাও তাঁকে পেয়ে বসেছিল, পড়াশোনায় তৈরি হয়েছিল বাধা। তবু ওসমান ছিলেন সেই মানুষ, যে ভাঙে না— ভেঙে নিজেকে গড়ে তোলে। সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছিল ভালো ফলাফল নিয়ে।
ইংরেজিতে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। সেই দক্ষতাই একসময় তার আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। কিন্তু ওসমান কেবল নিজের জন্য বাঁচেনি— সে সবসময় অন্যকে সহায়তা করতে চাইত, পাশে দাঁড়াতে চাইত। তার উদারতা ছিল নীরব, প্রচারবিমুখ।
আমার চিন্তাধারা আর ওসমানের চিন্তাধারা ছিল প্রায় বিপরীত মেরুর। যুক্তিতর্কে সে এতটাই পারদর্শী ছিল যে তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা খুব বেশি হতো না। তাই ব্যক্তিগত স্মৃতির ঝুলি খুব ভারী নয়। তবু আজ এই লেখা— কারণ এমন উদার মনের, এমন দৃঢ় বিশ্বাসী মানুষের এভাবে চলে যাওয়া মানা যায় না।
ওসমান কবিতা লিখত। আমিও লিখতাম। কিন্তু আমাদের কবিতার পৃথিবী ছিল আলাদা। আমার কবিতায় ছিল প্রেম, বিরহ, অনুভবের নরম আলো-ছায়া; আর ওসমানের কবিতায় ছিল বিদ্রোহ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা, মুক্তির গান। সে একসময় আমার ‘কবিতার খাতা’ গ্রুপে কবিতা দিত, তারপর একসময় আর দেয়নি— হয়তো তার ভেতরের আগুন তখন অন্য ভাষা খুঁজছিল।
ওসমানের স্মৃতি মনে পড়লেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তার কবিতার বই প্রকাশের সময়টা। সে যখন বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিল, আমাকে জানাল। প্রচ্ছদ পছন্দ করতে বলল। আমি একটি পছন্দ করে দিলাম। পরে ফেসবুকে তিনটি প্রচ্ছদ নিয়ে ভোটের আয়োজন হলো— আমার পছন্দটাই টিকে গেল। আজ যখন তার ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ বইটি চোখে পড়ে, বুকের ভেতর কোথাও যেন ভারী একটা ঢেউ উঠে আসে।
আরও বেশি ভারী লাগে তখন— যখন নিজের মেয়েকে নিয়ে দুষ্টুমি করি। হঠাৎ মনে হয়, একই বয়সী ওসমানের ছেলেটা কোথায় পাবে বাবার আদর, বাবার কাঁধ, বাবার ছায়া? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই— শুধু নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।
ওসমানের মেধা, শ্রম আর যোগ্যতা এমন ছিল যে সে চাইলে অনায়াসেই প্রথম শ্রেণির কোনো চাকরি নিয়ে নিশ্চিন্ত, সাজানো জীবন বেছে নিতে পারত। কিন্তু সে তা করেনি। সে বেছে নিয়েছিল বাংলার বুকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মতো কঠিন, বিপজ্জনক পথ। আর সেই পথই একদিন একটি বুলেট দিয়ে তার আজীবনের স্বপ্নকে থামিয়ে দিল।
তবু সত্য এটাই— ওসমান হাদীকে শারীরিকভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া গেলেও তার চিন্তাকে, তার স্বপ্নকে কেউ হত্যা করতে পারেনি। বরং তার রক্ত সেই স্বপ্নকে আরও বিস্তৃত করে দিয়েছে, আরও দৃঢ় করে তুলেছে।
হে ওসমান হাদী, পরপারে ভালো থেকো।
তোমার শহিদী মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ কবুল করেছেন।
ইনসাফ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তুমি বুকে লালন করেছিলে— সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তা একদিন বাস্তবায়ন করবেন।
তুমি নেই, কিন্তু তোমার চিন্তা আজও বেঁচে আছে— আগুনের মতো, আলোর মতো।
স্মৃতিতে ওসমান হাদী — মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:
Post a Comment