Wednesday, October 18, 2023

সরদার ফজলুল করিমের 'আমি মানুষ' বইয়ের একটি পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

বই পড়া আমার কাছে কিছুটা নেশার মতো। সময় পেলেই পড়ার চেষ্টা করি। পড়ি, ভুলে যাই, তবু পড়ি। আর এই পড়া বইগুলোর নাম জানাতেই কিছুদিন ধরে একটু লেখার চেষ্টা করি। এই লেখার চেষ্টাকে ঠিক রিভিউ বলা যাবে না। রিভিউ বলতে যা বুঝায় তা করার ক্ষমতা এই অধমের নাই। শুধু আমার পছন্দের কিছু বই যা অন্যেরও ভালো লাগতে পারে তাই লিখে প্রকাশ করি।

আজ যে বইটির কথা বলছি তা হলো সরদার ফজলুল করিমের লেখা 'আমি মানুষ'। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে স্যারের নাম জানাটা স্বাভাবিক। প্লেটোর 'রিপাবলিক', এরিস্টটলের 'পলিটিক্স', রুশোর 'সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট' এর মতো বইগুলোর অনুবাদ সরদার ফজলুল করিম স্যার করেছেন। এর বাইরে স্যারের লেখার সাথে আমার আর পরিচয় ছিলো না।

গত ১৫ জুন ২০২২ ছিলো স্যারের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সরদার ফজলুল করিম স্সৃতি সংসদ এক স্মরণসভার আয়োজন করে জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়ামে। সেই স্মরণসভায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। আর এখান থেকেই সরদার ফজলুল করিম স্যার সম্পর্কেবিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছে। স্যারের জীবন দর্শন, শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনা এমন অনেক কথা তুলে ধরেছেন যারা স্যারের সাথে ছিলেন, স্যারের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং স্যারের কাজ নিয়ে যারা গবেষণা করেন। সেখানে স্যারের প্রকাশিত বইগুলোর প্রদর্শন এবং বিক্রিরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখান থেকেও তার সম্পর্কে জানতে পারি এবং 'আমি মানুষ' বইটি উপহার হিসাবে পাই। যদিও স্যারের অনুদিত কয়েকটি বই আগেই সংগ্রহ করা আছে।

'আমি মানুষ' বইটি পড়তে গিয়ে বুঝলাম সরদার ফজলুল করিম স্যারের লেখা এতো তাড়াতাড়ি পড়ে বুঝা সম্বভ নয়। তার লেখার ধরন একেবারে আলাদা এবং সহজ ও সংক্ষেপ কথার মাঝে লুকিয়ে আছে জীবন দর্শনের বিশালতা, যা বুঝতে হলে সময়ের প্রয়োজন। বইটিতে মোট বিশটি লেখা আছে। লেখাগুলো মূলত তার ডাইরিতে লিখে রাখা দিনপিলির অংশ। ২০০১-০৮ সালের কয়েক দিনের দিনলিপি। তবে ২০০৩-০৪ সালের দিনরিপিই বেশি। এগুলো স্যারের দিন লিপি হলেও এর মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে জীবন দর্শন, মানবতা, বিশ্বশান্তি, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থার পথ নির্দেশনা।

বইয়ের প্রথম লেখা 'আমি মানুষ' এখানে লিখেছেন, 'আমি লেবু, শশা, কাঁচা আম ইত্যাদি কিনতে গিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে তাকিয়ে, আমার ভাব ভাবভঙ্গি দেখে জিজ্ঞেস করলঃ চাচা আপনি হিন্দু? আমি অবাক হলাম না। আমি বললামঃ 'আমি মানুষ'। আমার জবাবে ও মজা পেল। আবার প্রশ্ন করলঃ আপনি চাচা মুসলমান? আমি আবার বললামঃ 'মানুষ'। এবার তার মজা আরো বেড়ে গেল। দোকানীকে সম্বোধন করে বললঃ দেখছেন নি! উনি হিন্দুও না, মুসলমানও না। উনি 'মানুষ'।' কথাগুলো খুবই সহজ কিন্তু এর গভীরতা অনেক বেশি। এই যে 'মানুষ' হওয়াটা এটাকে জীবন দর্শন করা এতো সহজ না, যদি তাই হতো তবে সমাজে, রাষ্ট্রে এতো সমস্যার সৃষ্টি হতো না।

'সহজ সরল সত্য কথা'য় লিখেছেন, 'আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি  ১৩ কোটি মানুষ। আমি বলি ১৩ কোটি বই। ছাত্রছাত্রীরা কম্পিউটার বুঝে কিন্তু বই কাকে বলে বুঝে না। বই বস্তু বটে। কিন্তু বস্তু মাত্রই তো বই নয়। আমার শেষ করা কম্পিউটার আর আইটির বাহাদুরদের কাছেঃ রবোট বানান, ক্ষতি নেই। কিন্তু আগে মানুষ হন, মানুষ বানান।' এই যে মানুষ হবার কথা বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সেই মানুষের বড়ই প্রয়োজন।

'মানুষের উপায় কী বল' তে স্যার তার অতীতের কিছু কথা বলেছেন। যেখানে ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালের বন্যার স্মৃতিচারণ করেছেন। ১৯৪২-৪৪ সালে বর্তমান ঈদগাহ মাঠ, হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশন এর জায়গার কেমন অবস্থা ছিলো তা বলেছেন। এখানে মূল যে বিষয়টা বলেছেন তাহলো, এক সময় মনে করা হতো মানুষই হবে প্রকৃতির প্রভু; প্রকৃতি মানুষের উপর নয়। অথচ আসল সত্য হলো সবারই সহাবস্থানের ব্যাপার। কিন্তু মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারনেই এই বন্যা, খরা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের বন্যা নিয়ে সরদার ফজলুল করিম স্যার 'নূহের কিশতি' বইটি লিখেছেন।

বইয়ের প্রতিটা লেখাতেই পাওয়া যাবে কিছু দার্শনিক উক্তি, যা জীবনের নানান দিকের ইঙ্গিত করে। যেমন- 'সত্য কথার একট কথামালা'য় লিখেছে, 'সত্যের মৃত্যু নেই।' 'জীবন মরে না, মৃত্যুই মরে।' 'আত্মশাসনই সব চাইতে কঠিন শাসন।' 'দেশের রক্ষী বাহিনী হবে নাগরিকদের রক্ষক, ভক্ষক নয়।' 'আদিকালকে যেমন আমি জানিনে, অনন্তকালকেও তেমনি জানিনে তবু বস্তুর ক্রমপরিবর্তনই যে কাল, তাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।' 

 '৭১-এর আলামত? এ বলেছেন, 'চায়ের কেটলীর পানি, প্রথমে অল্প গরম, তার পরে আবার একটু গরম, এবং পরিশেষে গরমের পরিমাণের বৃদ্ধিতে পানির, পানি থেকে গ্যাসে রুপান্তর। এই হচ্ছে সামাজিক রসায়নের কথা।' 'আমরা সবাই ইতিহাসের সন্তান; জানি বা না জানিঃ দর্শক হই বা না হই।' এখানে তিনি ইতিহাসের কথা কেন বলেছে এইটাও ভেবে দেখা দরকার।

বইটির অন্যান্য লেখাগুলো থেকে আমার কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলোঃ

'মানুষ ক্ষুদ্র প্রাণী। সহজ পথের সন্ধানী।' 

'উদভ্রান্তরা জানে হত্যা করার মতো সহজ কাজ আর নেই।' 

'এ ম্যান হু ক্যানট বি এ গুড ফাদার টু হিজ ফামিলি, ক্যানট বি এ গুড কমিউস্ট।' 

'মানুষের সমাজ হচ্ছে মানুষের বাগানঃ মানুষ মাত্রই একটি ফুলঃ সে ক্ষুদ্র হোক, কিংবা দীর্ঘ হোক, সাদা কিংবা কালো হোক।' 

'মানুষ মানুষের ভাই, মানুষ মানুষের হত্যাকারী নয়।'

'আমাদের মৃত্যু আজ, কাল বা পরশু ঘটুক না কেন, আমাদের স্বপ্নের মৃত্যু কোনদিন ঘটবে না। মৃত্যুই মরে এবং জীবনই বাঁচে।' 

'জীবনের উপর বিশ্বাস হারানোর মতো পাপ আর নেই। জীবনের ওপর বিশ্বাস হারানোর অধিকার আমাদের নেই।' 

'মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা অবশ্যই ওষুধ।'

'আমার মতো বিত্তহীন মধ্যবিত্তের কষ্ট করা নিয়ে আফসোস করার বিলাসিতার উপায় নেই।' 

'গরিব-ধনী প্রত্যেকটি পরিবারই সাম্যবাদী নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত পরিবার।'

বইঃ আমি মানুষ
লেখকঃ সরদার ফজলুল করিম
প্রকাশকঃ কথা প্রকাশ
মূল্যঃ ১২০ টাকা।






সরদার ফজলুল করিমের 'আমি মানুষ' বইয়ের একটি পর্যালোচনা 

Friday, October 13, 2023

গল্প লেখার কৌশল -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

অনেক অনেক জানা প্রয়োজন, তবে অল্প জেনে সঠিক প্রয়োগকৌশল জানা আরো বেশি প্রয়োজন।

গল্প লিখতে হলে ভাবনার জগত যেমন প্রসারিত হতে হয় তেমনি কিছু কৌশল অবলম্বন গল্প লেখাকে সহজ করে দেই। তাই জেনে নেই সেই কৌশলগুলো যা প্রয়োগ করে সহজে গল্প লিখতে পারবো।

১. গল্পের কাহিনি: গল্পের প্রাণ দান করতে ব্যতিক্রমি কাহিনি দরকার। গল্পে নতুনত্ব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।

২. গল্পের চরিত্র: কাহিনিকে গতিশীল করতে চরিত্র প্রয়োজন। চরিত্রের বৈচিত্র্য গল্পের ভিন্নতা তৈরি করে।

৩. গল্পের সংলাপ: কাহিনির না-বলা ভাষা প্রকাশ করে সংলাপ। সংলাপ যতো সুন্দর হবে, গল্প ততো গ্রহণযোগ্য হবে।

৪. গল্পের পরিবেশ: কাহিনির পরিবেশ গল্পের সত্যতা বজায় রাখে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়। তাই কাহিনির নিজস্ব পরিবেশ দরকার আছে।

৫. গল্পের ভাষা ও উপস্থাপনশৈলী: গল্পকে শক্তিশালী করতে, অন্য গল্প থেকে পৃথকীকরণে এবং স্বাতন্ত্র দানে গল্পের ভাষা ও উপস্থাপনশৈলী শক্তিশালী হওয়া দরকার।

এই কৌশল অবলম্বন করে সাথে বেশি বেশি গল্প পড়ার মাধ্যমে আপনার গল্প লেখা শুরু করতে পারেন।


গল্প লেখার কৌশল 

Wednesday, October 11, 2023

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামঃ হাজার বছরের ইতিহাস -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের পথ পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাঙালি জাতি প্রাচীনকাল থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বর্তমানে পৌছেছে। এই পথ পরিক্রমকালে বাংলা ভূখন্ড বার বার তার মানচিত্র পরিবর্তন করেছে, ঘটেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। তবে আবহমানকাল ধরে বাঙালির স্বাতন্ত্র জীবনবোধ, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা পুরোপুরি আবিস্কার করা হয়ে উঠেনি। তাই বাঙালির একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর মূল্যায়ণ করা হয় না।


সাধারণত ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বাঙালি জাতিয়তাবাদের সূচনা ও অনুপ্রেরণা খোঁজা হয়। বলা হয়ে থাকে ভাষা আন্দোলনের সফলতা বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে। এ কথা সত্য যে ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎস সন্ধান করলে আরো প্রাচীনকালে যেতে হবে। মূলত প্রাচীনকাল থেকেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাজাত্যবোধ বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছিলো, যারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিকামী বাঙালি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ লাভ করে।


বৈদিক সাহিত্যের সূত্রধরে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার অব্দে বাংলার মাটিতে বিদেশি শক্তির আগমণ ঘটে এবং প্রায় এক হাজার বছর ধরে আর্যরা তাদের শাসন বিস্তৃত করে নিজেদের সুসংহত করে। অনেকটা বাধ্য হয়ে ভারতের কৌম্য জাতিগোষ্ঠী পরাভাব মেনে নিলেও বাঙালিরা তাদের আত্মমর্যাদাবোধ পুরো বিকিয়ে দেয়নি। বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, বাঙালি আর্য বংশোদ্ভূত নয় এবং বাঙালির বীরত্ব আর্য আগমণকে বার বার রুখে দিয়েছিলো। সময়ের হিসাবে দেখা যায় আর্যরা বাংলায় আসে বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে। কিন্তু বাংলার সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যের কথা জেনেও কেন তারা এতো দেরিতে বাংলায় আসে? উত্তর বাঙালির প্রতিরোধে সম্ভব হয়নি। তাইতো বহুকষ্টে বাংলা দখলের পর আর্যগ্রন্থে পূর্ব পরাজয়ের ক্ষোভ প্রকাশ করে বাঙালির নিন্দা করে বলেছে বাঙালিরা বর্বর, তারা পাখির ভাষায় কথা বলে তাই তারা পূর্বে বাংলায় বসতি গড়েনি।


খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ অব্দে মৌর্য রাজারা সাম্রাজ্যের আদলে ভারতবর্ষে তাদের শাসন শুরু করে। বগুড়ার মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে মৌর্য সম্রাট অশোক উত্তর বাংলায় শাসন শুরু করে। কিন্তু বাঙালিরা বিদেশি শাসকের অধীনতা মেনে নিতে পারেনি। বাংলার কতিপয় অঞ্চলে মৌর্যরা সহজে রাজত্ব গড়লেও অনেক জায়গাতেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বাংলার 'গঙারিডি' তার একটি অন্যতম প্রমাণ। গ্রীক বিবরণী থেকে জানা যায়, গঙানদীর তীর ঘেঁষে চার হাজার হস্তী বাহিনীতে সমৃদ্ধ বাঙালির এই স্বাধীন বসতি গঙারিডি রাজ্যটি মৌর্য যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।


খ্রিষ্টীয় তিন শতকের শেষ দিকে গুপ্ত রাজারা ভারতবর্ষে তাদের রাজবংশ পত্তন করেছিলো। ক্রমে এই বাংলা গুপ্ত শাসনে চলে গেলে বাঙালিরা বর্হিভারতীয় শাসনে স্বস্তি পায়নি। তাই স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের স্বাধীন রাজত্বের উত্থান ঘটায়। যার প্রমাণ হলো- দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট রাজ্য এবং পশ্চিম বাংলার পুষ্করণ রাজ্য। গুপ্ত শাসন সমগ্র বাংলাকে গ্রাস করলেও বাঙালি সমতট রাজ্যকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাখে।


ছয় শতকের শুরুতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়, যার প্রভাব বাংলা অঞ্চলে পড়ে। যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশ নিয়ে 'বঙ্গরাজ্য' এবং পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চল নিয়ে 'গৌড়রাজ্য' নামে দুইটি আলাদা স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামে তিনজন রাজা বঙ্গরাজ্য শাসন করে বলে জানা যায়। তবে বাঙালি এই স্বাধীনতা বেশিদিন ভোগ করতে পারেনি। দক্ষিণাত্যের রাজা কীর্তিবর্মনের হাতে বঙ্গরাজ্যের স্বাধীনতা খর্ব হয়।


শত বছরের অরাজকতায় বিপর্যস্ত বাংলার দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ সময়ে সিংহাসনে বসে গোপাল। শুরু হয় পাল শাসনামল। এই সময়ে বাংলার সমৃদ্ধি আর গৌরবের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তবে পাল শাসনের শেষের দিকে বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় যার সরব প্রমাণ হলো কৈবর্ত বিদ্রোহ। বাংলার অস্থির রাজনীতি এবং বিদেশি আক্রমণ বাংলাকে দুর্বল করে দেয়, শুরু হয় বাংলার ভাঙন। তবে এই ভাঙনেও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কয়েকটি রাজ্য স্বাধীনভাবে টিকে ছিলো। এছাড়া কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চল স্বাধীন ছিলো।


অষ্টম শতকের শুরুতে বাংলায় দেব বংশের চারজন বিখ্যাত রাজার নাম পাওয়া যায়, যারা বাংলাকে স্বাধীনভাবে নেতৃত্ব দেয়। নয় শতকে এসে কান্তিদেবের ক্ষমতা চলে যায় 'চন্দ্র' নামের নতুন বংশের অধিকারে এবং চন্দ্ররা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শক্তিশালী শাসক হয়ে উঠে। কুমিল্লা, সিলেটসহ বরিশাল তাদের অধীনে থাকে। তবে এগার শতকের মাঝামাঝি বাংলায় আবার বিদেশি আক্রমণ হয় এবং চন্দ্রদেবকে পরাহত করে সেন বংশের রাজারা বাংলাকে দখল করে নেয়।


সেন শাসনে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা তের শতকে বর্হিভারতীয় মুসলমানদের বাংলা আক্রমণকে সমর্থন করে মুসলিম শাসক বখতিয়ার খালজিকে মুক্তির অগ্রদূত ভাবেন। সেনরা পরাজিত হয় এবং অবাঙালি মুসলমানরা বাংলা চালায়। যেখানে বাঙালিরা অস্বস্তিতে ছিলো না, কেননা মুসলমানরা চরিত্রে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলো। তারা বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা করে টানা দুইশত বছর স্বাধীন শাসন চালায়। ষোল শতকের মাঝামাঝি ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলার স্বাধীনতা খর্ব হয়। তবে বারভূঁইয়ারা একটা সময় পর্যন্ত বাংলার কতিপয় অঞ্চল স্বাধীন রাখতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত সমগ্র বাংলা মোগলদের অধীনে চলে যায়।


মোগলদের অধীনে বাঙালিরা অশান্তিতে না থাকলেও আঠের শতকের শুরুতে মোগলদের অবস্থা দুর্বল হলে বাংলার নবাবরা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন শুরু করে। তবে বাংলার প্রতি বিদেশিদের নজর সব সময় ছিলো এবং  ইংরেজদের সাথে নবাব সিরাজদৌলার পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা আবার ইংরেজ শাসনের অধীনে চলে যায়। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজ শাসন চলে এই বাংলায়। এই ইংরেজ শাসনের দুইশত বছরে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন, সংগ্রাম গড়ে তোলে এবং বাংলা হয়ে উঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব ইংরেজ শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দেয়। এছাড়াও এ সময়ে সংগঠিত হয় ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলন,  ফরায়েজী আন্দোলন, হিন্দু সংস্কার আন্দোলনসহ অসংখ্যক বিদ্রোহ, সংগ্রাম ও আন্দোলন।


উনিশ শতকের শুরুতে বাংলায় কতিপয় শিক্ষিত উদার মনের মানুষের আবির্ভাব হলে শুরু হয় বাংলার নবজাগরণ।  শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজ সচেতন হয়ে উঠে বাঙালি জাতি এবং শুরু হয় ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র আন্দোলন। গড়ে উঠে কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালি জাতি। একপর্যায়ে ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হলে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ভেঙে যায়। বাঙালির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।


শুধু ধর্মের কারণে হাজার মাইল ব্যবধানে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয় বাংলা। তাই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের চোখে সেন রাজাদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। ব্রাক্ষ্মণ শাসকরা যেমন তাদের স্বার্থে স্বধর্মের মানুষদেরও রেহাই দেয়নি তেমনি পাকিস্তানীরাও বাঙালিদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে রেহাই দেয়নি। স্বাধীনতার পরপরই প্রথম আঘাতহানে বাঙালির মুখের ভাষার উপর। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা ঘোষণা দিলে স্বাধীনচেতা বাঙালি প্রতিবাদ শুরু করে এবং ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্তের বিনিময় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। এই জয়ের পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা সরকার গঠন করে। তবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাজনীতির পথ বন্ধ করে বাঙালির উপর নির্মম নির্যাতন, বৈষম্য অব্যাহত রাখে। বাঙালি তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির সনদ 'ছয়দফা' কর্মসূচি, যা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নৎস্যাত করতে মিথ্যা মামলা, গণগ্রেফতার, বিচারের নামে প্রহসন শুরু করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু বাঙালিদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছয়দফার শক্তিতে বলিয়ান বাঙালিরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও জান্তা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলে ৭ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালির উপর পাকিস্তানীদের বর্বর হামলায় রাজপথ বাঙালির রক্তে ভিজে যায়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। পূর্ণতা পায় বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন, স্বাধীন হয় বাংলাভূমি, নাম হয় বাংলাদেশ।


তথ্যসূত্রঃ

১. বাংলাদেশের ইতিহাস- ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. এ বি এম মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম

২. বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০১৮- ড. হারুন-অর-রশিদ

৩. বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য- এ কে এম শাহনাওয়াজ


বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামঃ হাজার বছরের ইতিহাস

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Friday, October 6, 2023

Harvard পদ্ধতিতে Reference লেখার নিয়ম -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

থিসিস, গবেষণা প্রবন্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখায় তথ্যসূত্র লিখতে হয়। এই তথ্যসূত্র লেখার একটা পদ্ধতি হলো Harvard Reference System. এই পদ্ধতিতে রেফারেন্স লেখার জন্য নিচের নিয়ম অনুসরণ করা যায়। 

বই এর এর প্রিন্টেড ভার্সন থেকে যেভাবে Reference লিখবেনঃ
১) লেখক বা সম্পাদকের নামের শেষ অংশ
২) নামের প্রথম অংশের আদ্যক্ষর
৩) যদি সম্পাদিত বই হয়ে থাকে তবে
Ed./Eds.
৪) বই প্রকাশের সাল/বছর
৫) বইয়ের শিরোনাম
৬)
Edition নাম্বার যদি থাকে
৭) বইয়ের
Volume নাম্বার
৮) কোথায়
Publish করা হয়েছে তার নাম
৯) প্রকাশকের নাম
১০) পৃষ্ঠা নাম্বার

উদাহরণঃ
Standard books
Tracy, E. (2002) The student’s guide to exam success. Buckingham: Open University Press.
Edited books
Stott, R., Young, T. and Bryan, C. (eds.) (2001) Speaking your mind: oral presentations and seminar skills. Harlow: Pearson Education. (Speak-write series)
Chapter in a book
Bryan, C. (2001) “Presenting your case”. In: Stott, R., Young, T. and Bryan, C. (eds.) Speaking your mind: oral presentations and seminar skills. Harlow: Pearson Education. (Speak-write series). pp. 106-122


বইয়ের অনলাইন ভার্সন থেকে যেভাবে লিখবেনঃ
১) লেখক বা সম্পাদকের নামের শেষ অংশ
২) নামের প্রথম অংশের আদ্যক্ষর
৩) যদি সম্পাদিত বই হয়ে থাকে তবে
ed./eds. লিখতে হবে
৪) বই প্রকাশের সাল/বছর
৫) বইয়ের শিরোনাম
৬) বইয়ের
edition নাম্বার উল্লেখ করতে হবে যদি থাকে
৭) অনলাইন হলে মিডিয়াম
[online] এভাবে লিখতে হবে
৮) কোথায় Publish করা হয়েছে তার নাম(যদি থাকে)
৯) প্রকাশকের নাম
১০)
Available from: লিখে যে ebook service থেকে পড়ছেন তার নাম যেমন Google Books
১১)
url বা accessed web address টা লিখতে হবে
১২) যে তারিখে
Article টা পড়েছেন মানে Accessed date টা লিখতে হবে

উদাহরণঃ
Peate, I. (ed.) (2010) Nursing Care and the Activities of Living. 2nd ed. [online]. Chichester: Wiley. Available from: MyiLibrary. http://lib.myilibrary.com/Open.aspx?id=248322 [Accessed: 24 July, 2012]

 

Journal এর প্রিন্টেড ভার্সন থেকে যেভাবে Reference লিখবেন:

১) প্রথমে লেখকের নামের শেষ অংশ (Surname)
২) এরপর লেখকের নামের প্রথম অংশের আদ্যক্ষর
(Initials)
    ক্রমান্বয়েঃ ৩)ব্র্যাকেটের মধ্যে প্রকাশের সাল/বছর
৪)
Article টির শিরোনাম
৫) জার্নালের নাম (
Bold করে লিখতে হবে)
৬)
Volume নাম্বার
৭) যদি
Issue নাম্বার থাকে তবে Volume এরপরে ব্র্যাকেট দিয়ে লিখতে হবে
৮) পৃষ্ঠা নাম্বার লিখতে হবে। ৩২৩-৩৫৪ এভাবে। কিন্তু,৩২৩-৫৪ এভাবে নয়

উদাহরণঃ
Avila-Flores, R. and Medellin, R.A. (2004) Ecological, taxonomic, and physiological correlates of cave use by mexican bats. Journal of Mammalogy, 85: (4): 675-687

 
Journal এর অনলাইন ভার্সন থেকে লিখবেন যেভাবেঃ
১) প্রথমে লেখকের নামের শেষ অংশ
(Surname)
২) এরপর লেখকের নামের প্রথম অংশের আদ্যক্ষর
(Initials)
    ক্রমান্বয়েঃ ৩)ব্র্যাকেটের মধ্যে প্রকাশের সাল/বছর
৪)
Article টির শিরোনাম
৫) জার্নালের নাম (
Bold করে লিখতে হবে)
৬)
Volume নাম্বার
৭) যদি
Issue নাম্বার থাকে তবে Volume এরপরে ব্র্যাকেট দিয়ে লিখতে হবে
৮)
Available from মানে যে url থেকে পেপারটি দেখতে পাচ্ছেন তা লিখতে হবে
৯)
Date accessed মানে যেদিন আপনি অনলাইনে এটি দেখেছেন সেই তারিখটা উল্লেখ করতে হবে।
 
উদাহরণঃ
Bailey, S. (2005). Assessing the Impact of the Freedom of Information Act on the FE and HE Sectors. Ariadne [online], 42. Available from: www.ariadne.ac.uk/issue42/bailey/ [Accessed 20 June 2012].
 

ওয়েব সাইট থেকে লিখবেন যেভাবেঃ
১) লেখকের নাম
২) যে দিন লেখাটা
Published হয়েছে
৩) পেপারসটির টাইটেল
৪)
medium [online]
৫) যেখানে
Publish করা হয়েছে (Place of Publication যদি থাকে)
৬) প্রকাশকের নাম যদি থাকে
৭) যে
url/web adress থেকে লেখাটা পড়ছেন
৮) যে তারিখে সেটা আপনি
access করেছেন সেটা উল্লেখ করতে হবে।

উদাহরণঃ
Environment Agency (2012) Agricultural Waste [online]. Available from: http://www.environment-agency.gov.uk/business/sectors/32777.aspx [Accessed 2 August 2012]
বিস্তারিত-
University of Birmingham এর ওয়েবেঃ
https://intranet.birmingham.ac.uk/as/libraryservices/library/referencing/icite/referencing/harvard/referencelist.aspx

 

Harvard পদ্ধতিতে Online Reference Generator এর উপায়ঃ
যদি এমনটা হয় যে উপরের নিয়ম কানুন বেশ বিদঘুটে মনে হচ্ছে বা থিসিস
Ready তে সময় কম তবে অনলাইন জেনারেটর এর সাহায্য নিতে পারেন।
http://www.neilstoolbox.com/bibliography-creator/
https://www.citethisforme.com/

এই সাইট দুটিতে
specific কিছু ডাটা চাইবে আপনি তা দিলে আপনাকে সে reference generate করে দিবে।

 


Harvard পদ্ধতিতে Reference লেখার নিয়ম 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন


Wednesday, October 4, 2023

বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্তঃসরকার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। এসব পরামর্শ প্রথমবারের মতো শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে ছিল। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। এই দিবসটি পালনে বিশ্বর ১০০টিও বেশি দেশ এবং এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতি বছরের ন্যায় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩’ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হল- ‘The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage.’ বিশ্বব্যাপী বর্তমান শিক্ষা ব্যববস্থায় যে শিক্ষক সংকট বিদ্যমান সেই প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যুক্তিসঙ্গত, বিশেষত বাংরাদেশের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে যেমন মানসম্মত শিক্ষকের সংকট রয়েছে, সাথে সাথে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। তথাপি যে সংখ্যক শিক্ষক রয়েছে তাদের সকলকে অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে।

একজন আদর্শ শিক্ষকই জাতির মেধা গড়ার কারিগর। তাই তাকে হতে হয় আর দশজন মানুষের তুলনায় সেরা। কেননা তাকে দেখেই আগামী প্রজন্ম শিক্ষা নিবে। যদিও আদর্শ শিক্ষকের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন, তবে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একজন আদর্শ শিক্ষকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তেমনই কিছু বৈশিষ্ট্য এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে নিজের মধ্যে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়েই এই আলোচনা।

একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ÔTodd WhitakerÕ - তাঁর লেখা Ô50 Ways to Improve Student BehaviourÕ - এ বলেছেন, একজন শিক্ষকের আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম বাধা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। তাঁর মতে, ১. অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে না যে তাদের শিক্ষকরা আসলে তাদের উপর বিশ্বাস করে; ২. অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে না যে তাদের বাবা-মা তাদের বিশ্বাস করে; ৩.  অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে না যে বড়রা তাদের বিশ্বাস করে; ৪. তাই অনেক শিক্ষার্থী নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করে না এবং ৫. যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিজেরা বিশ্বাস করে না তাদের আচরণগত ও একাডেমিক সমস্যা বেশি থাকে। তাই শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে একজন শিক্ষকের কতিপয় করণীয় হলো- ১. নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য তৈরি করা যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতেই একটা ধারণা নিতে পারে; ২. শিক্ষকের মতো তারাও যে কাউকে শেখাতে পারে, এই দৃষ্টিভঙ্গিটি তাদের মাঝে তৈরি করা যার মাধ্যমে তাদের নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে, সাথে শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপ্রেরণা বাড়বে; ৩. শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত এবং উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাদের দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা যায়। তাই তাদেরকে প্রতিনিয়ত বলা, ‘তোমার উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে, হাল ছেড়ো না, আমি তোমার পাশে আছি’ এতে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে; ৪. শিক্ষাবিষয়ক প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণকে আরও আনন্দদায়ক ও কার্যকরী করে তুলতে পারে, যা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে দিবে।

একজন শিক্ষক অনেক জ্ঞানী হতে পারে, ক্লাসে পাঠদানের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আসতে পারে এমনকি অত্যন্ত সুন্দর করে বোঝানোর ক্ষমতাও থাকতে পারে; কিন্তু আকর্ষণীয় ও কার্যকরভাবে শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা করতে না পারলে সমস্ত অর্জনই মাটি হয়ে যেতে পারে। তাই একজন আদর্শ শিক্ষক আকর্ষণীয় ও কার্যকরভাবে শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা করেন। এর জন্য শিক্ষকের করণীয় হলো প্রথমত, শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসের কতিপয় নিয়মকানুন নির্ধারণ করে দেয়া। যেমন- ১. শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে; ২. দলগত কাজের সময় সবার মতামত শুনবে; ৩. অন্যের মতের সাথে একমত না হলে ভদ্রভাবে যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে; ৪. দলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে; ৫. কিছু বলার আগে হাত তুলবে; ৬. সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে এবং সদ্ভাব বজায় রাখব; ৭. সবাই একসাথে কথা বলবে না, একজন বলার পর অন্যজন বলবে; ৮. সবাইকে দলের কাজ উপস্থাপন করার এবং অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেবে; ৯. শান্তি বজায় রাখব যাতে সবাই সবার কথা শুনতে পায় এবং ১১. দলের কাজ পরিচালনায় একে অন্যকে সহযোগিতা করবে ইত্যাদি। এছাড়াও শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণে ক্যাপটেন বা শ্রেণিনেতা নির্বাচন করা, তা হতে পারে প্রতি পনের দিন পর বা প্রতি মাসে পালাক্রমে নেতৃত্বে নিয়ে আসলে সকল শিশুর মধ্যেই নেতৃত্বের গুণাবলি তথা আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হবে। তাছাড়া, মাঝে মাঝে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা পরিবর্তন করে বসানো যেতে পারে। শিক্ষক যদি পাঠদানের সকল পদ্ধতি বা কৌশল এবং প্রয়োগকৌশল খুব ভালোভাবে জেনে তা যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তবেই শ্রেণিকক্ষকে আকর্ষণীয় ও কার্যকর করে তোলা সম্ভব হবে।

সময় ব্যবস্থাপনা ও ক্লাস নেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আসা একজন ভালো শিক্ষকের বড় গুণ। আর একজন আদর্শ শিক্ষক সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখেন। নিজেকে কার্যকরী প্রস্তুতি অর্জনের জন্য শিক্ষকের করণীয়ের মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, শিক্ষকের প্রস্তুতির ব্যাপারে InTASC- এর মূল নীতিগুলোর মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্তর হচ্ছে- ১. জ্ঞান- যা পড়াবেন তা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকতে হবে; ২. স্বভাব- একজন শিক্ষক সুন্দর স্বভাবের অধিকারি হবে; ৩. ক্রিয়াকলাপ- শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে বৈচিত্র্য থাকতে হবে। বইয়ের বাইরে থেকেও ব্যাখ্যা দিয়ে, বাস্তব বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে উদাহরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝাতে হবে। Yale Center for Teaching and Learning- এর মতে শ্রেণিকক্ষ পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের যেসব বিষয়ে প্রস্তুতি থাকা উচিত তার মধ্যে- ১. পড়া এবং সমস্যা সেট করা; ২. প্রতি সপ্তাহের লেকচার নোট তৈরি করা; ৩. ক্লাসের সময়কে সর্বোচ্চ কার্যকরী করে তুলতে পরিকল্পনা করা; ৪. ক্লাসে ব্যবহার করতে বা বোর্ডে লিখতে প্রশ্নের তালিকা তৈরি করা; ৫. শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসের জন্য হোমওয়ার্ক বা প্রশ্ন নকশা করা; ৬. ক্লাসের জন্য কুইজ তৈরি করা; ৭. শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ, সমস্যা বা আগ্রহের বিষয়গুলো বুঝতে চেষ্টা করা; ৮. বিতর্কের জন্য বিষয় নির্বাচন ও পর্যালোচনা করা এবং ৯. খবরের কাগজ বা অন্যান্য জায়গা থেকে শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য।

জীবনের সর্বস্তরে তথা সামাজিক, পারিবারিক কিংবা রাষ্ট্রীয়; সকল ক্ষেত্রেই নিয়মানুবর্তী হওয়া অত্যাবশ্যক। আর একজন আদর্শ শিক্ষক সর্বদা নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখেন। এই নিয়মানুবর্তিতা চর্চায় একজন শিক্ষকের করণীয় হিসাবে রয়েছে- ১. শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থী শুধু বইয়ের পড়াই শেখে না; তাঁর আচার-ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গিসহ প্রায় সব কিছুই শিক্ষার্থীরা অনুসরণ-অনুকরণ করার চেষ্টা করে। তাই একজন শিক্ষকের খুব সতর্কতার সঙ্গে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা উচিত; ২. অতিরঞ্জিত ও আড়ম্বরতা বিবর্জিত কঠোরতা বর্জন করতে হবে; ৩. শিক্ষার্থীদের ভুলের কারণে রোষান্বিত বা ঈর্ষান্বিত না হওয়া, কেননা তাতে ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশের সম্ভাবনা তৈরি হয়; ৪. মানবিকতা ও নৈতিকতা বজায় রাখতে শিক্ষার্থীদের মাঝে অবশ্যই ন্যায়বিচার বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। তবেই সকল ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তীতা ও শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।

একজন শিক্ষককে সবার মাঝে আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে হলে তাঁকে পিতা-মাতা, অভিভাবক, পরিবার কিংবা সমাজ সব জায়গাতেই পেশাগত ও ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। এই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে একজন শিক্ষকের করণীয় হলো- ১. শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকের প্রতি সম্মান এবং ভদ্রতা প্রদর্শন করা; ২. শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করা বা অভিভাবকদের অভিযোগকে আমলে নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা; ৩. শিক্ষার্থীদের পরিবার এবং সমাজের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষকদের সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

একজন আদর্শ শিক্ষককে নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা না গেলেও উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির ভিত্তিতে আদর্শ শিক্ষককে চিহ্নিত করা যায়। তাই শিক্ষকরা নিজেদের সম্পর্কে ধারণা নিতে কিংবা একজন নতুন শিক্ষক নিজেকে আদর্শ শিক্ষক হিসাবে গড়ে তুলতে তা অনুসরণ করতে পারেন। নতুন শিক্ষকদের দক্ষতা যাচাই এবং আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে Jeffrey Glanz- এর গবেষণার উপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা ÔTeaching 101: Classroom Strategies for the Beginning TeacherÕ এ আটটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রশ্নের তালিকা তৈরি করেছেন- ১. আপনি যে বিষয়বস্তু শেখাচ্ছেন তার উপর আপনার কি সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে? ২. আপনি কি শিক্ষাদান পদ্ধতি, শেখার পদ্ধতি এবং পাঠ্যক্রম পদ্ধতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন? ৩. আপনি কি নিজেকে ভালোভাবে জানেন? ৪. আপনি কি অপরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন? ৫. আপনি কি বিচিত্র, চিন্তাভাবনামূলক প্রশ্ন করতে পছন্দ করেন? ৬. আপনি কি সবসময় নির্দেশনার কাজের পরিকল্পনা করেন? ৭. শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা এবং কার্যকর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আপনি কি সফল? ৮. আপনি কি ভালো যোগাযোগকারী? যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর একজন শিক্ষকের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ হয় তবে তিনি সঠিক পথেই আছেন, আর যদি উত্তর ‘না’ হয় তবে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে তাকে চেষ্টা করতে হবে।

একজন আদর্শ শিক্ষক ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামো দানকারী। তার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়ে থাকে, কেননা সকল ইতিবাচক পরিবর্তন শিক্ষার মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং এই শিক্ষা একজন শিক্ষক দিয়ে থাকেন। তাই শিক্ষক যেন একজন আদর্শ শিক্ষক, সুশিক্ষক হয়ে উঠে আজকের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই হোক আমাদের চাওয়া। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা।

লেখক: মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা এবং ফেলো, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল: helaluddin565@gmail.com

 

 

 

পত্রিকায় প্রকাশিত লিঙ্কঃ বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলি 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন