Wednesday, October 11, 2023

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামঃ হাজার বছরের ইতিহাস -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের পথ পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাঙালি জাতি প্রাচীনকাল থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বর্তমানে পৌছেছে। এই পথ পরিক্রমকালে বাংলা ভূখন্ড বার বার তার মানচিত্র পরিবর্তন করেছে, ঘটেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। তবে আবহমানকাল ধরে বাঙালির স্বাতন্ত্র জীবনবোধ, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা পুরোপুরি আবিস্কার করা হয়ে উঠেনি। তাই বাঙালির একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর মূল্যায়ণ করা হয় না।


সাধারণত ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বাঙালি জাতিয়তাবাদের সূচনা ও অনুপ্রেরণা খোঁজা হয়। বলা হয়ে থাকে ভাষা আন্দোলনের সফলতা বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে। এ কথা সত্য যে ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎস সন্ধান করলে আরো প্রাচীনকালে যেতে হবে। মূলত প্রাচীনকাল থেকেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাজাত্যবোধ বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছিলো, যারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিকামী বাঙালি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ লাভ করে।


বৈদিক সাহিত্যের সূত্রধরে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার অব্দে বাংলার মাটিতে বিদেশি শক্তির আগমণ ঘটে এবং প্রায় এক হাজার বছর ধরে আর্যরা তাদের শাসন বিস্তৃত করে নিজেদের সুসংহত করে। অনেকটা বাধ্য হয়ে ভারতের কৌম্য জাতিগোষ্ঠী পরাভাব মেনে নিলেও বাঙালিরা তাদের আত্মমর্যাদাবোধ পুরো বিকিয়ে দেয়নি। বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, বাঙালি আর্য বংশোদ্ভূত নয় এবং বাঙালির বীরত্ব আর্য আগমণকে বার বার রুখে দিয়েছিলো। সময়ের হিসাবে দেখা যায় আর্যরা বাংলায় আসে বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে। কিন্তু বাংলার সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যের কথা জেনেও কেন তারা এতো দেরিতে বাংলায় আসে? উত্তর বাঙালির প্রতিরোধে সম্ভব হয়নি। তাইতো বহুকষ্টে বাংলা দখলের পর আর্যগ্রন্থে পূর্ব পরাজয়ের ক্ষোভ প্রকাশ করে বাঙালির নিন্দা করে বলেছে বাঙালিরা বর্বর, তারা পাখির ভাষায় কথা বলে তাই তারা পূর্বে বাংলায় বসতি গড়েনি।


খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ অব্দে মৌর্য রাজারা সাম্রাজ্যের আদলে ভারতবর্ষে তাদের শাসন শুরু করে। বগুড়ার মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে মৌর্য সম্রাট অশোক উত্তর বাংলায় শাসন শুরু করে। কিন্তু বাঙালিরা বিদেশি শাসকের অধীনতা মেনে নিতে পারেনি। বাংলার কতিপয় অঞ্চলে মৌর্যরা সহজে রাজত্ব গড়লেও অনেক জায়গাতেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বাংলার 'গঙারিডি' তার একটি অন্যতম প্রমাণ। গ্রীক বিবরণী থেকে জানা যায়, গঙানদীর তীর ঘেঁষে চার হাজার হস্তী বাহিনীতে সমৃদ্ধ বাঙালির এই স্বাধীন বসতি গঙারিডি রাজ্যটি মৌর্য যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।


খ্রিষ্টীয় তিন শতকের শেষ দিকে গুপ্ত রাজারা ভারতবর্ষে তাদের রাজবংশ পত্তন করেছিলো। ক্রমে এই বাংলা গুপ্ত শাসনে চলে গেলে বাঙালিরা বর্হিভারতীয় শাসনে স্বস্তি পায়নি। তাই স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের স্বাধীন রাজত্বের উত্থান ঘটায়। যার প্রমাণ হলো- দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট রাজ্য এবং পশ্চিম বাংলার পুষ্করণ রাজ্য। গুপ্ত শাসন সমগ্র বাংলাকে গ্রাস করলেও বাঙালি সমতট রাজ্যকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাখে।


ছয় শতকের শুরুতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়, যার প্রভাব বাংলা অঞ্চলে পড়ে। যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশ নিয়ে 'বঙ্গরাজ্য' এবং পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চল নিয়ে 'গৌড়রাজ্য' নামে দুইটি আলাদা স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামে তিনজন রাজা বঙ্গরাজ্য শাসন করে বলে জানা যায়। তবে বাঙালি এই স্বাধীনতা বেশিদিন ভোগ করতে পারেনি। দক্ষিণাত্যের রাজা কীর্তিবর্মনের হাতে বঙ্গরাজ্যের স্বাধীনতা খর্ব হয়।


শত বছরের অরাজকতায় বিপর্যস্ত বাংলার দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ সময়ে সিংহাসনে বসে গোপাল। শুরু হয় পাল শাসনামল। এই সময়ে বাংলার সমৃদ্ধি আর গৌরবের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তবে পাল শাসনের শেষের দিকে বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় যার সরব প্রমাণ হলো কৈবর্ত বিদ্রোহ। বাংলার অস্থির রাজনীতি এবং বিদেশি আক্রমণ বাংলাকে দুর্বল করে দেয়, শুরু হয় বাংলার ভাঙন। তবে এই ভাঙনেও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কয়েকটি রাজ্য স্বাধীনভাবে টিকে ছিলো। এছাড়া কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চল স্বাধীন ছিলো।


অষ্টম শতকের শুরুতে বাংলায় দেব বংশের চারজন বিখ্যাত রাজার নাম পাওয়া যায়, যারা বাংলাকে স্বাধীনভাবে নেতৃত্ব দেয়। নয় শতকে এসে কান্তিদেবের ক্ষমতা চলে যায় 'চন্দ্র' নামের নতুন বংশের অধিকারে এবং চন্দ্ররা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শক্তিশালী শাসক হয়ে উঠে। কুমিল্লা, সিলেটসহ বরিশাল তাদের অধীনে থাকে। তবে এগার শতকের মাঝামাঝি বাংলায় আবার বিদেশি আক্রমণ হয় এবং চন্দ্রদেবকে পরাহত করে সেন বংশের রাজারা বাংলাকে দখল করে নেয়।


সেন শাসনে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা তের শতকে বর্হিভারতীয় মুসলমানদের বাংলা আক্রমণকে সমর্থন করে মুসলিম শাসক বখতিয়ার খালজিকে মুক্তির অগ্রদূত ভাবেন। সেনরা পরাজিত হয় এবং অবাঙালি মুসলমানরা বাংলা চালায়। যেখানে বাঙালিরা অস্বস্তিতে ছিলো না, কেননা মুসলমানরা চরিত্রে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলো। তারা বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা করে টানা দুইশত বছর স্বাধীন শাসন চালায়। ষোল শতকের মাঝামাঝি ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলার স্বাধীনতা খর্ব হয়। তবে বারভূঁইয়ারা একটা সময় পর্যন্ত বাংলার কতিপয় অঞ্চল স্বাধীন রাখতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত সমগ্র বাংলা মোগলদের অধীনে চলে যায়।


মোগলদের অধীনে বাঙালিরা অশান্তিতে না থাকলেও আঠের শতকের শুরুতে মোগলদের অবস্থা দুর্বল হলে বাংলার নবাবরা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন শুরু করে। তবে বাংলার প্রতি বিদেশিদের নজর সব সময় ছিলো এবং  ইংরেজদের সাথে নবাব সিরাজদৌলার পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা আবার ইংরেজ শাসনের অধীনে চলে যায়। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজ শাসন চলে এই বাংলায়। এই ইংরেজ শাসনের দুইশত বছরে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন, সংগ্রাম গড়ে তোলে এবং বাংলা হয়ে উঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব ইংরেজ শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দেয়। এছাড়াও এ সময়ে সংগঠিত হয় ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলন,  ফরায়েজী আন্দোলন, হিন্দু সংস্কার আন্দোলনসহ অসংখ্যক বিদ্রোহ, সংগ্রাম ও আন্দোলন।


উনিশ শতকের শুরুতে বাংলায় কতিপয় শিক্ষিত উদার মনের মানুষের আবির্ভাব হলে শুরু হয় বাংলার নবজাগরণ।  শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজ সচেতন হয়ে উঠে বাঙালি জাতি এবং শুরু হয় ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র আন্দোলন। গড়ে উঠে কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালি জাতি। একপর্যায়ে ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হলে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ভেঙে যায়। বাঙালির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।


শুধু ধর্মের কারণে হাজার মাইল ব্যবধানে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয় বাংলা। তাই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের চোখে সেন রাজাদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। ব্রাক্ষ্মণ শাসকরা যেমন তাদের স্বার্থে স্বধর্মের মানুষদেরও রেহাই দেয়নি তেমনি পাকিস্তানীরাও বাঙালিদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে রেহাই দেয়নি। স্বাধীনতার পরপরই প্রথম আঘাতহানে বাঙালির মুখের ভাষার উপর। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা ঘোষণা দিলে স্বাধীনচেতা বাঙালি প্রতিবাদ শুরু করে এবং ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্তের বিনিময় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। এই জয়ের পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা সরকার গঠন করে। তবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাজনীতির পথ বন্ধ করে বাঙালির উপর নির্মম নির্যাতন, বৈষম্য অব্যাহত রাখে। বাঙালি তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির সনদ 'ছয়দফা' কর্মসূচি, যা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নৎস্যাত করতে মিথ্যা মামলা, গণগ্রেফতার, বিচারের নামে প্রহসন শুরু করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু বাঙালিদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছয়দফার শক্তিতে বলিয়ান বাঙালিরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও জান্তা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলে ৭ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালির উপর পাকিস্তানীদের বর্বর হামলায় রাজপথ বাঙালির রক্তে ভিজে যায়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। পূর্ণতা পায় বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন, স্বাধীন হয় বাংলাভূমি, নাম হয় বাংলাদেশ।


তথ্যসূত্রঃ

১. বাংলাদেশের ইতিহাস- ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. এ বি এম মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম

২. বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০১৮- ড. হারুন-অর-রশিদ

৩. বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য- এ কে এম শাহনাওয়াজ


বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামঃ হাজার বছরের ইতিহাস

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:

Post a Comment