ইতিহাসের পাতায় আগস্ট মানে নৃশংসতার এক মাস। এই মাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কতিপয় ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। তেমনি একটি ঘটনা ২১ আগস্ট, ২০০৪ এ বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। যে হামলার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কেমন ছিলো সেই প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদ বিশ্লেষণে তা দেখা হবে। তবে এর পূর্বে আগস্টের আরো কিছু নৃশংস ঘটনা দেখা যাক।
এই আগস্টে ঘটেছে ইতিহাসের প্রথম পারমানবিক বোমা হামলা। ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সালের সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অনুমান করা হয় যে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ জন এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ জন লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর একটি দল হানা দেয়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাইকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তারা প্রাণে বেঁচে যান।
এই আগস্টেই বাংলাদেশে ঘটে আরো নৃশংস ঘটনা। ১৭ আগস্ট, ২০০৫ সালের বেলা ১১টার দিকে ঢাকা সহ দেশের ৩০০টি স্থানে ৫০০ বোমা হামলা হয়। ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলা বাদে অবশিষ্ট ৬৩টি জেলায় এই হামলা হয়। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারি-আধা-সরকারি স্থাপনায় বোমা হামলা হয়। আধ ঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এ সিরিজ বোমা হামলায় দু’জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হন।
২১ আগস্ট, ২০০৪ সালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। যে হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়- এই ঘটনাই একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা হিসাবে পরিচিত।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ভয়বহতা এবং এর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকাওে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সমাবেশের ২১ আগস্টের সেই ভয়ংকর ঘটনা পুরো বিশ্বকেই নাড়া দিয়েছিলো যা তাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়েছিলো। তখন ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ- সবাই দফায় দফায় এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে, কথা বলেছে।’ তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ এর হামলার পর তখন এমনিতেই বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সমমনা দেশগুলো এ বিষয়ে বৈশ্বিকভাবে কাজ করছিলো। এমন এক পরিস্থিতিতে ঢাকার সেই ভয়াবহ হামলা সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিকেই আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলো- যে কারণে গ্রেনেড হামলা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিলো।
২১ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার খবর মুহূর্তেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঐ দিন রাত থেকে পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজন বিশ^নেতা। এছাড়া বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন থেকে বিবৃতি দিতে থাকে।
ঘটনার দিন রাতেই শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তিনি শেখ হাসিনার সাথে সার্বিক বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করেন। পরের দিন টেলিফোনে কথা বলেন তখনকার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরবাকেন, ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, লোকসভার বিরোধী দলীয় নেতা আদভানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রোকো। তাঁরা সকলেই শেখ হাসিনার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন এবং হামলার ঘটনায় নিন্দা জানান। ঐ দিনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গভীর দু:খ প্রকাশ করেন, যা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ফোন করে জানান। ২৫শে আগস্ট কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল ডন ম্যাককিনন শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তার স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন। এভাবেই বিশ^ নেতারা সেই দিন গ্রেনেড হামলায় আহত শেখ হাসিনার কাছে টেলিফোনে কথা বলেন এবং আহত ও নিহতদের খোঁজখবর নেন।
২১ আগস্ট বিকালে হামলার ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচারের পরপরই বিভিন্ন দেশ থেকে বিবৃতি দেয়া শুরু হয়। ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রথম বিবৃতি দেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়শকা ফিশার। এরপর পরপরই পৃথক ভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে বিবৃতি আসে। প্রতিটি দেশ ও সংস্থার বিবৃতিতেই স্পষ্টভাবে হামলার সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিলো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তার বিবৃতিতে বলেন, ‘এধরণের ঘৃণ্য রাজনৈতিক সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
বিরোধী দলের নেতৃত্বের উপর এমন হামলা সফল হলে এটি গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতো।’ পরে ওয়াশিংটনে দেয়া এক বিবৃতিতে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার আহবান জানান। ইউরোপীয় কূটনীতিকদের যৌথ বিবৃতিটির মূল কথা ছিলো এমন, সরকারকে হামলার ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা এবং একই সাথে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা জোরদারের নিশ্চিত ব্যবস্থা করা। জাপান ও অস্ট্রেলিয় পৃথক বিবৃতি দিয়ে বলেন, এই ঘৃণ্য হামলার ঘটনার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। এছাড়া বিবৃতিতে সব পক্ষকে ধৈর্য ধারণ করা এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। ২১ আগস্ট হামলার ঘটনায় তখনকার জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলেন।
হামলার ঘটনার পর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতগণ শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন এবং নিজ দেশের সরকার প্রধানদের বার্তা পৌছে দেন। প্রথমেই আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিনা সিক্রী। তারা আলাদাভাবে শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করে তাকে সমবেদনা জানান ও পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে সাক্ষাৎ করেন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। এছাড়া নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি ও শ্রীরংকার রাষ্ট্রদূতরাও শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে নিজ দেশের সরকার প্রধানের বার্তা পৌঁছে দেন। এছাড়াও পাকিস্তানের সিনেটর ইকবাল হায়দার শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঘটনার পাঁচদিন পর ২৬শে আগস্ট ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডীন শাহতা জারাবের নেতৃত্বে ১৯ জন কূটনীতিক শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পরে তারা ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর এভাবেই আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। যার মাধ্যমে এই ঘটনার ভয়াবহতা এবং ঘটনা পরবর্তী ফলাফল যে অনেক বেশি আশংকাজনক ছিলো তা সহজেই অনুমেয়। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ফলে সেই সময়ে বিরোধী দল যেমন সাহস পাচ্ছিলো, তেমনি সরকারও ঘটনার তদন্ত ও বিচারের জন্য চাপের মধ্যে ছিলো।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা
পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার লিঙ্কঃ