সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষপট বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর একান্ত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন আহমদ বলেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গতি রুখতেই হত্যা করা হয়ে ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেই চক্রান্ত তারাই বাস্তবায়ন করেছে, যাদের বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেছিলেন, পরম ভরসায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আগেই পেয়েছিলেন্, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরই আস্থাভাজনরা ইতিহাসের সবরচেয়ে বিশ^াসঘাতকতার নমুনা তারাই তৈরি করবে এটা তিনি ভাবতেই পারেননি।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের ভোররাত অন্য সকল ভোর রাতের মতো শান্ত ছিলো না। কেননা শ্রাবণের সেই ভোর রাতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে গিয়েছিলো ইতিহাসের নির্মম-নৃশংস হত্যাকান্ড, যে হত্যাকান্ড হলো সেই রাষ্ট্রের স্রষ্টা জাতির পিতার হত্যাকান্ড। ১৫ আগস্টের সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ভোর পাঁচটা বা পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটে ফোন এলো, আব্দুল মালেক ভূইয়া কনফিডেন্সিয়াল অফিসার, তিনি বললেন স্যার তাড়াতাড়ি রেডিও শুনেন, সামথিং টেরিবল হ্যাজ হ্যাপেন। আমি তাকে বললাম কি হয়েছে মালেক সাহেব। তিনি বললেন বঙ্গবন্ধু আর নেই। আমি তাকে বললাম আপনি আমার সঙ্গে মসকরা করছেন? রেডিও ধরলাম, মেজর ডালিম তার জঘণ্য ঘোষণাগুলো দিচ্ছে। তখন ফোন করলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কেউ ফোন ধরলেন না।
বঙ্গবন্ধু যাদের বেশি বিশ্বাস করতেন, যারা সব সময় বঙ্গবন্ধুর অতি কাছে থাকতেন তারাই বঙ্গবন্ধুর সপরিবাবে হত্যার পর ৩২ নম্বরের বাড়িতে নিথর লাশগুলো রেখে মন্ত্রিসভা গঠনে যোগ দিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ সিড়িতে পড়ে আছে আর সেই মুজিব সরকারের ২১ জন যোগ দেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। অথচ এরা সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ব্যক্তি, যাদেও নিয়ে বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার লাশ ফেলে রেখে যারা মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যস্ত তাদের সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, টিভিতে দেখলাম, যে সমস্ত বেইমানরা বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে পড়ে থাকতো, তার অনুগ্রহের জন্য কেলাইতো, তারা মোশতাকের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ঠেলাঠেলি করছে।
এ থেকে অনুমান করা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিছক সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাসী অফিসারদের শুধু নয়, এর পিছনে রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকে ভারত সতর্ক করেছিলো, আমেরিকাও সতর্ক করেছিলো। তারা বঙ্গবন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছিলো কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোথাও যাবেন না, তিনি তার ভালোবাসার মানুষদের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিলো এবং ২৫ মার্চের সাহসিকতা দিয়ে ১৫ই আগসেটর রাতকেও মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ছিলো আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। অনেকেই বলে গোয়েন্দা ব্যর্থতা, তিনি বলেন গোয়েন্দা পাটির্সিপেশন। বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অনুমান করতে পেরেই খন্দকার মোশতাককে পশ্চিম জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাতে আপদ দূরে থাকে। কিন্তু ঐ অর্ডার চাপ দিয়ে বাতিল করা হয়েছিলো, কারা করেছিলো এই কাজ? তারা কি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত নয়? জাতির পিতা এই সকল বিষয় বুঝতে পারার পরেও শুধু বাঙালিদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসার কারণে গুরুত্ব দেয়নি। তিনি বিশ্বাস করতেন যারা তাঁকে এতো ভালোবাসে তারা কখনও তা৭কে হত্যা করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে জাতির পিতাকে হত্যা করতে বাঙালিদের হাত কাঁপেনি, অথচ তিনিই এনে দিয়েছিলে আমাদের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আইন করে এই হত্যাকান্ডের বিচার পর্যন্ত রোধ করা হয়েছিলো। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার সরকার এই ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বিচারের পথ সুগম করেন। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বহু বাধা পেরিয়ে ৩৪ বছর পর হত্যার বিচার সম্পন্ন করে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জাতিকে কিছুটা দায়মুক্ত করা হয়। বাকি আসামীদের বিচারের রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতিকে পুরো কলঙ্কমুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা মর্যাদা রক্ষা করা হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মোঃ হেলাল উদ্দিন
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
ফেলো, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট
দৈনিক এশিয়া বাণী'তে প্রকাশিত লেখার লিঙ্কঃ
ষড়যন্ত্র চলছে জেনেও বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন
No comments:
Post a Comment