Monday, January 23, 2023

তুমি আছো বলে -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

তুমি আছো বলে আমার স্বপ্ন আছে

তুমি আছো বলেই আছে আমার ভালোবাসা

তুমি আছো বলে হয় আমার কবিতা লেখা

তুমি আছো বলেই আমার এই রাত জাগা

তুমি আছো বলে আসে আমার সোনালী সকাল

তুমি আছো বলেই আমার নতুন দিনের প্রত্যাশা

তুমি আছো বলে আমার কাজ করা

তুমি আছো বলেই আমার আগামী গড়া

তুমি আছো বলে আমার বেঁচে থাকা

তুমি আছো বলেই আমার স্বপ্ন দেখা

যদি তুমি না থাকতে জীবনে আমার

আর হতো না কোন কবিতা লেখা

কিংবা রাত জেগে কোন স্বপ্ন দেখা

আমার সবকিছু শুধু তোমার জন্য করা

কারন তুমি যে আমার জীবনের সাধনা।।

তুমি আছো বলে 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

প্রেমাঙ্গ ভাবনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

ঐ নয়নে পড়ে যখন নয়ন

দিশে হারায় মন তখন।

ঐ ঠোঁটে দেখে যখন কাঁপন

হৃদয়ে ঢেউ জাগে তখন।

ঐ বুকে যখন ঢেউ ভাঙ্গে

ধমনী তখন জাগিয়া উঠে।

দেখা হয়নি নিতম্ব এখনও

জানা যায়নি কি তাহার ধরন।

দেখা হয়নি ভগ্নাঙ্কুরে ভাঙ্গন

তাতেই লোহিতকণা করে কেমন।

তুমি কি ধরা দিবে প্রেমে

জড়িয়ে নিবে মোরে দেহে।

প্রেমের মিলন হৃদয়ে হলে

দেহের মিলনে স্বর্গ রচিবে।

তোমার উদ্যানে হাওয়া বহিলো

আমার হৃদয়ে কামনা জাগিলো।

সেই কামনার নোনা জলে

তোমারে পুড়িতে চাই অনলে।

তুমি এসে মিশে যাও প্রাণে

রচি স্বর্গের সুখ এ ভুবনে।।

 প্রেমাঙ্গ ভাবনা 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Thursday, January 19, 2023

মানুষের যাত্রা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

প্রথম ছিলো রুহের জগতে

তারপর এলো মাতৃগর্ভে

মহান আল্লাহর হুকুম হলো

দুনিয়ার বুকে চলে এলো

যাকে যতোদিন হায়াত দিবে

সে ততোদিন দুনিয়ায় রইবে

আবার আল্লাহ হুকুম দিবে

দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে

দুনিয়ায় যারা ভালো করবে

পরকালে সে বেহেশত পাবে

দুনিয়ায় যারা খারাপ করবে

পরকালে সে দোজখে যাবে

এমনি করে মানুষের যাত্রা শেষ হবে।

মানুষের যাত্রা

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Friday, January 13, 2023

দেখা অদেখা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

তোমার সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিল

প্রায় ভুলতে বসে ছিলাম।

আজ আবার দেখে মনে হলো

হ্যাঁ এইতো সেদিনই দেখা হয়েছিল।

তুমি ঠিক আগের মতোই আছো

যেমন দেখেছি তোমায় প্রথম বার।

তোমায় এমন করেই দেখতে চাই

শেষবার পর্যন্ত জীবনে আমার।

_________
______
দেখা অদেখা 
04/06/2016

Tuesday, January 10, 2023

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনঃ বাঙালির ইতিহাসে মাহেন্দ্রক্ষণ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনঃ বাঙালির ইতিহাসে মাহেন্দ্রক্ষণ

১০ জানুয়ারি, বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক আনন্দের দিন। কেননা ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যু যন্ত্রণা শেষে ১৯৭২ সালের এই দিনে লন্ডন-দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে থেকে মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে সে বিজয় পূর্ণতা লাভ করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি হানাদার সামরিক বাহিনী শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে।

স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের দখলদার সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে পাকিস্তানের কারাগারে গোপন বিচারের মাধ্যমে তাঁর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের সামনেই তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ় অবিচল। এই অবিচলতার মূলে ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।

বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার বন্ধ করে মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেয়ার বিষয়ে অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭ টি দেশের সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি ইউরোপের ৫ টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন । ফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পাকিস্তান সরকার, প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ও বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদে বঙ্গবন্ধুকে তার স্বদেশে ফিরিয়ে দিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে ইংরেজি হিসেবে ৮ জানুয়ারি। এদিন একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ বিমানে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে বেলা ১০টার পর থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। যতদূর জানা গেছে যে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন ইয়ান সাদারল্যান্ড। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেন আপা বি পন্থ। ত্রিশ মিনিট ধরে চলেছিল বঙ্গবন্ধু- ইন্দিরা টেলিফোন আলাপচারিতা। দুপুরের দিকে এক প্রেস কনফারেন্সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। সেখানে চারটি বিষয়কে ঘিরে ভাষণ দেন। এ চারটি বিষয় ছিলঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানানো; যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা বা সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি কুতজ্ঞতা এবং যেসব দেশ সমর্থন করেনি অথচ জনগণ সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানানো; সকল দেশের কাছে স্বাধীনতার স্বীকৃতি চাওয়া; পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য চাওয়া। প্রধানত এ চারটি বিষয় ধরে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর ভাষণ তুলে ধরেছিলেন।

সেখানে সাংবাদিকদের দেওয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, ‘পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে দেশদ্রোহীর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনো প্রকাশ করা হবে না। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন।’

‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন মানুষকে ভোগ করতে হয়নি। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতো, বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডে সেও লজ্জা পেত।’

‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’

স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু বৃটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ জানুয়ারি সকালেই তিনি নামেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সেদেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সে বৈঠকে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি আলোচনা হয়।

দিল্লিতে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে আমি ৯মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ ৯ মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তির, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে তাতে যোগ দেওয়ার জন্য আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে।”

১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে তিনি ঢাকা এসে পৌঁছেন। সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো সারিবদ্ধ মানুষ। বিমান বন্দর থেকে পল্টনের রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)- এক বিপুল জনসমুদ্র। যা বিশ্ববাসী ও বাঙালিরা প্রত্যক্ষ করেছিল।বাং লাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতা। সবার চোখেমুখে অন্যরকম উত্তেজনা। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। যিনি বাঙালী জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। লাখো লাখো মানুষের ভীড় রাজপথ জুড়ে। কণ্ঠে ’জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বদেশে।

যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামলো তাঁর দু’চোখ বেয়ে। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে যারা গিয়েছিলেন, অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা তারাও অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছুতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিনকার রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। বাঙালি জাতি তেজোদীপ্ত ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়।

প্রাণপ্রিয় স্বদেশে ফিরে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যাঁদের প্রাণের ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতে বলেন, “স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু, মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দুই একটা কথা বলতে চাই। ”

জনগণনন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তাঁর ঐতিহাসিক ধ্রুপদি বক্তৃতায় বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কীনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছিলেন আর সেই রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীনতার পূর্ণতা সম্পর্কে স্পষ্ট করে তিনি বলেন “আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে। নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না। যদি এ দেশের মা- বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।” দেশের উন্নয়নের জন্য ডাক দিলেন এভাবে “ যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই, জমিতে যাও, ধান-বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজন ঘুষ খাবেনা না, মনে রাখবেন, তখন সুযোগ ছিলোনা, আমি ক্ষমা করব না। ”

পাকিস্তানে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার ও ফাঁসির হুকুম সম্পর্কে তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন “আমার সেলের পাশ আমার জন্য কবর খোড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব। আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাব না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।”

নতুন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি কূটনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে বিবেচনায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে উদাত্ত আহবান জানান এ ভাবে, “দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমার রিকগনাইজ করো। জাতিসংঘে স্থান দেও, দিতে হবে। উপায় নাই। দিতে হবে, আমি, আমরা হার মানব না। আমরা হার মানতে জানি না।”

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সবাইকে দেশ গড়ার ডাক দেন। সে ভাষণটি হচ্ছে ভবিষ্যত বাংলাদেশের রূপরেখা ও নতুন দেশ হিসেবে দেশ পুনর্গঠনের নীল নকশা । ভাষণটি অন্যান্য ভাষণের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর আলোকিত সোনার বাংলা বির্নিমাণে অবিনাশী অনুপ্রেরণা, পাথেয় ও দিক নিদের্শনা।

রবার্ট পেইন তাঁর ম্যাসাকার বইয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ জানুয়ারির জনসভার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গণহত্যার অবসান হয়েছিল, দখলদারদের পরাভব ঘটেছিল, শুরু হয়েছিল নতুন জীবন, উজ্জীবিত হচ্ছিল নতুন আশা। সেই রৌদ্রালোকিত দিনে দূরের এক শহরে রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চে দাঁড়ানো এক ঋজু ব্যক্তি, দুনিয়ার সব নিপীড়িতজনের জন্য বয়ে এনেছিলেন আশা।’

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

এরপর শুরু হয় দেশ পুনর্গঠনে তাঁর দুরূহ যাত্রা। দুর্গম পথচলা।

টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারির সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলে, গত অর্ধশতাব্দীতে মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ উপমহাদেশের ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাবসঞ্চারী নেতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন; তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নাম: শেখ মুজিবুর রহমান।

সেদিন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি যে কতটা প্রয়োজন ছিল, তা এখনকার প্রজন্মের অনেককেই বোঝানো সম্ভব নয়। তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই মনে করছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। কেউ কাউকে মানছিলেন না। তরুণ নেতারা অস্থায়ী সরকারের কোনো কথা শুনছিলেন না। একটি নৈরাজ্যের মতো অবস্থা ছিল ২৫টি দিন। তিনি না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতে চাইতেন না সহজে। ভারতীয় সৈন্যও হয়তো অত তাড়াতাড়ি ফিরে যেত না। অনেক দেশের স্বীকৃতি পেতেও বেগ পেতে হতো। তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংহত হয়।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন হলো, এক বছরের মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দিলেন, ষোলো মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান, বাংলাদেশের জন্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়, ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ এবং সেখানে বাংলায় ভাষণ দানএসবই তাঁর অর্জন।

যে বাংলাদেশের তিনি স্থপতি, সে বাংলাদেশের বস্তুগত অর্জনের প্রশংসা আজ পৃথিবীব্যাপী ধ্বনিত।

তবু আমাদের আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তবেই হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার প্রতিষ্ঠা। তাঁর সোনার বাংলা অর্থবৈষম্যহীন ও শোষণহীন সমাজ, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে যেখানে সকল মানুষের সমান অধিকার, জনগণ যেখানে রাষ্ট্রের মালিক। সেই জায়গাটায় আমাদের পৌঁছতে হবে। আর সেই যাত্রাপথে তাঁর জীবনের দৃষ্টান্ত প্রতিমুহূর্তে আমাদের প্রেরণা দেবে।

 

তথ্যসূত্রঃ

1.  বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর.কম, জানুয়ারি ১০, ২০১৩

2. উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ, জানুয়ারি ০৯, ২০১৬

3. ইত্তেফাক অনলাইন ডেস্ক জানুয়ারি ০৯, ২০২৩

4.  দৈনিক কালের কন্ঠ,জানুয়ারি ০৯, ২০২৩

5.  দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারি ১০, ২০২০

 

মোঃ হেলাল উদ্দিন

৩৩তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা

Monday, January 9, 2023

শীতের রজনী -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

  নিস্তব্ধ নিশীথে
কুয়াশায় ঢাকা নিয়নের আলোতে।
মাঝ রাত হলো ইচ্ছে
বেরিয়ে পড়ি খোলা আকাশের নিচে
সুদূর অজানার মেঠো পথ পাড়ি দিতে
যে পথের মাঝে মায়া আছে, ভরা ভালোবাসতে।
দিগন্ত জোড়া কুয়াশার ছায়াতে
তার মাঝে তোমার পাওয়া হাতছানি তে
তুমি ডাকলে আমায় কি করে যায় থাকা দূরে
আমি আসছি, দাঁড়াও তুমি সাথে আমায় নিতে
হারিয়ে যাবো এই রজনীর সাথে ভালোবাসার বুকে
তোমাতে হবো বিলীন আমি, বাহুতে বাহু মিলিয়ে সুখে
এমন শীতার্ত রজনী, তৃষ্ণার্ত কামিনী, উষ্ণ করো মিলনে।

শীতের রজনী 
১৪/০১/২০২০

 

Friday, January 6, 2023

বিনাশ না হওয়া উপন্যাস 'ন হন্যতে' -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'ন হন্যতে'। হন্যতে অর্থ শরীর। ন হন্যতে অর্থ যার বিনাশ হয় না, যা অমর। এই উপন্যাসটি ছিল 'লা নুই বেঙ্গলী' উপন্যাসের প্রতিক্রিয়া থেকে লেখা।

অনেকেই বলেন, দুই যুগল প্রেমের উপন্যাসের মধ্যে কারো মির্চা এলিয়াদের 'লা নুই বেঙ্গলী' বেশি ভালো লেগেছে, আবার  কারো হয়তো মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' বেশি ভালো লেগেছে। আমি বলবো, ভিন্ন কথা। 

আমার দুটো উপন্যাসকেই ভালো লেগেছে। কারণ দুটি উপন্যাসই হলো একটি গল্পের এপিঠ আর ওপিঠ। আমি গল্পের সম্পুর্ণ অংশই দেখতে চাই, ভালো লাগার দৃষ্টিতেই শুধু নয়,জানার উপলব্ধি থেকে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, দু'জন লেখকই দুইভাবে পাঠকের সামনে এসেছেন দুই রকম ভালো লাগার পশরা সাজিয়ে।

যখন 'লা নুই বেঙ্গলী' পড়েছি, তখন মনে হয়েছে, লেখক একটা ছোট্ট শিশুর মতো করেই তার পাওয়া, না পাওয়ার আনন্দ- বেদনা ভরা আকুতির গল্প লিখে চলেছেন দ্বিধাহীনভাবে, কোন রাখঢাক না করে। এটিই ছিল 'লা নুই বেঙ্গলীর' সারল্য। এই সারল্যই আকৃষ্ট করেছে পাঠককে। আমার নিজস্ব উপলব্ধি হলো, মির্চা এলিয়াদের 'লা নুই বেঙ্গলী' বিদেশ বিভুঁইয়ে মাত্র তেইশ বছরের এক যুবকের অপরিপক্ক আবেগে লেখা,সদ্য ভেঙে পড়া প্রেমের কষ্ট, সাথে ভিন্ন দেশ আর ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির দেয়ালে মাথা খুঁটে একা একা কষ্ট বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা। সাথে আছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং ভারতীয়দের প্রতি তাদের অবহেলিত দৃষ্টিভঙ্গি।তবে মির্চা নিজেকে ভারতীয় বলেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।

অপরদিকে মৈত্রেয়ীর 'ন হন্যতে' সেদিক থেকে বেশ পরিণত। এই বইটি মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন তার জীবনের ষাটতম বসন্তে, হাতে ছিল পর্যাপ্ত রসদ,সেই সাথে মির্চার বইটি। মির্চার বইয়ে ফুটে উঠেছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি আর মৈত্রেয়ীর বইয়ে ফুটে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আর তার কাব্যিক আবহ। মৈত্রেয়ী বইয়ের একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তার কাব্যলাইন,যা উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। 

তবে 'লা নুই বেঙ্গলী' আর 'ন হন্যতে' এর মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। মির্চা তার বইটিতে ২৩ বছর বয়সে ঘটে যাওয়া ঘটনা লিখেছেন ২৬ বছর বয়সে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অপরদিকে মৈত্রেয়ী তার ১৬ বছরের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া একই ঘটনা বর্ণনা করেছেন ৬০ বছর বয়সে। এই বার্ধক্য বয়সে মৈত্রেয়ী দেবী 'ন হন্যতে' উপন্যাসে নিজেকে তার কৈশোরের চপলতায় হারিয়ে ফেলেছেন। একই সঙ্গে পাঠকও ১৬ বছরের মৈত্রেয়ী আর ২৩ বছরের যুবক মির্চা এলিয়াদের মাঝে  ডুব দিয়ে নিজেদের ফেলে আসা জীবনকেই যেন হাতড়ে ফেরেন। 

বলা যায়, মির্চার বইয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার এই বইটি লেখা। মৈত্রেয়ী বইটি লেখেছেন পরিপক্ক হাতে। বইটি লেখার পিছনে মির্চার প্রতি তার আবেগ যতটা কাজ করেছে, তার চেয়েও বেশি কাজ করেছে, মির্চা কেন তাকে মিথ্য কলঙ্ক দিল এই বিষম কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে।

এই বইটিতে মৈত্রেয়ী সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা, নারীর সামাজিক দুরবস্থা, বাঙালি সংস্কৃতি, ব্রিটিশ শাসনের নানা চিত্র কলমের ছোঁয়ায় তুলে এনেছেন।

মৈত্রেয়ী দেবী তার লেখায় আবহ, শব্দবুনন এবং কবিতার কারুকাজ দিয়ে বইটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। তিনি বইটিতে প্রাসঙ্গিক ঘটনায় রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার লাইন কোটেশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মূলত মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনে আলোকবর্তিকা ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল শ্রদ্ধা আর প্রেমপূর্ণ। মৈত্রেয়ী দেবীর লেখকসত্তা প্রস্ফুটিত করার অন্তরালের কুশীলব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 

১৯৩০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সকল কবিতা তার মুখস্থ ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল যার ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একই সাথে মৈত্রেয়ী গানও শিখত। আর এসবই সম্ভব হয়েছে মৈত্রেয়ীর বাবার সংস্কৃতিমনা মনোভাবের কারণে।

তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার একটি মফস্বল শহরের অধ্যাপক। এরপর কলকাতায় এসে মাত্র ছয় বছরে কলেজের দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে  কলকাতার পন্ডিত সমাজে বিশেষ জায়গা করে নেন স্বীয় পান্ডিত্যে। সংস্কৃতে পারদর্শী, প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী, শ্রুতিধর এবং দ্রুত বই পড়তে পারতেন।

তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির সাত-আট হাজার বই তিনি পড়ে ফেলেছেন। তিনি বেশ কিছু বইও লিখেছেন। দর্শন বিষয়ে পড়ার জন্য মৈত্রেয়ী পেয়েছেন একজন লিবারেল বাবার যুগোতীর্ণ সুচিন্তিত চিন্তা, তাইতো মৈত্রেয়ী সমকালীন দশটা নারীর তুলনায় ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে মাঠের সবুজে ধুয়েছেন পা।

মির্চাকে যেদিন তাদের বাসায় থাকার জন্য আনা হলো সেদিন মৈত্রেয়ী আপত্তি করেছিল, একজন ইংরেজকে তাদের বাড়িতে রাখার জন্য। যদিও মির্চা ইংরেজ নয়, বরং ইউরোপের একটি ছোট দেশ থেকে এসেছে। মেয়ের এমন মানসিকতার জন্য বাবা তাকে 'ন্যাশনালিজম' নামে একটি প্রবন্ধের বই পড়তে দেন এবং বলেন, "এমন একদিন আসবে যেদিন 'প্যাট্রিয়িটিজম' মানেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। মৈত্রেয়ীর বাবার এই কথার সাথে সাদাত হোসেন মান্টোর সীমানা প্রাচীরহীন পৃথিবীর স্বপ্নের মিল রয়েছে।  

তিনি বাবা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তার মেয়ে চেষ্টা করলে একদিন 'সরোজিনী নাইডু' হবে। কতটা স্বপ্নচারী হলে মানুষ মেয়েকে নিয়ে এমন দুর্লভ স্বপ্ন দেখতে পারেন, মৈত্রেয়ীর বাবার প্রতি অপার মুগ্ধতা কাজ করেছে আমার।  যদিও শেষের দিকে এই বাবার পরিবর্তন হয়েছিল একটি বিশেষ দোষে।

মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা তৎকালীন সমাজকে উপেক্ষা করে বাসায় রেখেছিলেন তার ভীষণ প্রিয় একজন ছাত্রকে যার নাম মির্চা এলিয়াদ। মির্চা ছিল একজন বিদেশী শেতাঙ্গ। মৈত্রেয়ীর বাবা ভেবেছিলেন, মির্চার সংস্পর্শে মৈত্রেয়ী ইউরোপিয়ান কালচার এবং ভাষা শিখতে পারবে। কারণ তত দিনে মৈত্রেয়ীদের বাড়িতে প্রায়ই বিদেশিরা আসত। তাদের পুরনো সংস্কার ছেড়ে তারা যেন ক্রমশ আরো সংস্কারমুক্ত হয়ে উঠছিল। কারণ মৈত্রেয়ীর বাবা এসব সংস্কার মানতেন না। 

মৈত্রেীর মা সংস্কার না মানলেও চিরায়ত স্বামীভক্ত বাঙালি নারী ছিলেন। স্বামীর এমন বিদ্বান হয়ে ওঠার পিছনে তার সেবা-যত্নের বিশেষ অবদান ছিল। 

বইটির মূলবক্তব্য হলো,মির্চার সাথে মৈত্রেয়ীর প্রেম। দুই দেশের, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির,দু'জন শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ অল্পবয়সী নর-নারীর ব্যর্থ প্রেমের পরিণতি হলো দুটি বিখ্যাত উপন্যাস লা নুই বেঙ্গলী এবং ন হন্যতে। এই উপন্যাসে মৈত্রেয়ীর নাম 'অমৃতা' এবং মির্চার নাম 'মির্চা ইউক্লিড'।

যদিও মৈত্রেয়ীর পরিবার আধুনিক এবং সংস্কারমুক্ত, তারপরও তারা এই সম্পর্ক মেনে নেননি। কারণ মির্চার সংস্কৃতি আর মৈত্রেয়ীর সংস্কৃতি আলাদা। মির্চার সংস্কৃতিতে বৈবাহিক জীবনের পরও একাধিক অবৈধ সম্পর্কে জড়ানোর সুযোগ আছে। যা ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে বড্ড বেমানান। বলা যায় এই একটি কারণেই মির্চা পরিত্যক্ত হয়। অথচ মৈত্রেয়ীর বাবা মা কিন্তু বিদেশির সাথে মেয়ে বিয়ে দিলে সমাজ নিন্দা করবে এমন ভয়ে ভীত নয়। ব্যাপারটা হয়তো এমন, তখনও তারা এতটা আধুনিক হতে পারেনি। অথবা মেয়েকে তারা এমন সংস্কৃতির লোকের সাথে বিয়ে দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। যেখানে ব্যক্তি মির্চার গুণে তারা মুগ্ধ ছিল।

মেত্রেয়ীর একটি কথা মনে পড়লো, বইয়ের একটা জায়গায় তিনি লিখেছেন, "আমরা হলাম পর্দাছাড়া পর্দানশীন।" অর্থাৎ বাবার  বিদেশি ছাত্রের সাথে মেশার সুযোগ পেলেও দেশি ছাত্রদের সাথে তেমন কথা বলা হতো না। তবে মৈত্রেয়ী যত সহজে বিদেশি হওয়ায় মির্চার সাথে মিশত পারত, নিজ দেশের ছেলেদের বেলায় সে ছিল ততটাই আড়ষ্ট।

উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ একটি বিশাল জায়গা জুড়ে আছেন। তার কৈশোরের আবেগ, শ্রদ্ধার সবটুকু জায়গা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। তাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। তারমধ্যে কয়েকটি স্মৃতি জেনে আমার ভালো লেগেছে। সেই সময়ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিন্দা-মন্দ হতো। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন দিয়েছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে।

ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত সমাজে নাচ ছিল অকল্পনীয়।  রবীন্দ্রনাথ এই অচলায়তন ভাঙলেন, ' নটীর পূজা '

মঞ্চস্থ করে। তিনি দেখালেন, 'একজন নটী তার নাচের মাধ্যমে তার পূজা নিবেদন করতে পারেন।' সমাজ তোলপাড় হলো, রবীন্দ্রনাথকে কিছুদিন খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হলো। এভাবে সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজকে বদলে দেবার প্রবল ইচ্ছে বাস্তবায়নে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসম সাহসী।

রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তি নিকেতনে আলো জ্বালাচ্ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছিল মৈত্রেয়ী। সে প্রায়ই শান্তি নিকেতনে যেত। রবীন্দ্রনাথ তার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হতেন। মৈত্রেয়ী দেবীর মনে তখন একটি সূর্য,আর সে সূর্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একটি ষোল বছরের মেয়ে তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল, সে তাঁর আলোয় নিজের জগতে পথ চলে। এমনকি তার বাবা যখন রবীন্দ্রনাথের নতুন প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সমালোচনা করতেন, তখনও কষ্ট পেত সে। আর তাই মির্চা এই বৃদ্ধ লোকটাকে ঈর্ষা করত খুব। দু'জনের মধ্যে এ নিয়ে বেশ রাগ-অনুরাগ চলত। যদিও একটি মজার তথ্য আছে বইয়ে,মৈত্রেয়ীর প্রথম প্রেম ছিল একটি ছাতিম গাছ। 

তবে মৈত্রেয়ী সময় ভালোই কাটছিল। মির্চা তাকে ভালোবাসে, এটা মৈত্রেয়ীর বোন ১১ বছর বয়সী ছোট্ট সাবি বুঝতে পারে। তার অভিযোগ, সবাই মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসে কিন্তু কেউ তাকে ভালোবাসে না। এমন ভাবনা থেকে একসময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, পাগলের মত আচরণ করে। তবে মির্চাকে ভীষণ পছন্দ করে। এরই মধ্যে মৈত্রেয়ীর বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

মৈত্রেয়ীর বাবা একটু সুস্থ হলেও তার বোন সাবি আর সুস্থ হয়ে ওঠে না। তবুও এই অবস্থায়ও  মৈত্রেয়ীর ষোলতম জন্মদিন বেশ ঘটা করে পালন করে বাবা। কলকাতার সব গণ্যমান্য গুণীজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। সেদিন সাবি দো'তলার বারান্দা থেকে লাফ দিতে ধরেছিল। মির্চা ওকে নিরস্ত করে। এভাবেই চলছিল। এরপর প্রায়ই তারা সাবিকে সাথে নিয়ে ওদের শেভরলে গাড়িতে করে বেড়াতে যেত আশপাশের  লেকের ধারে। একদিন মির্চা আর মৈত্রেয়ীর চুম্বন করা দেখে সাবি তার মাকে  বলে দেয়। 

ঐ দিনই তাদের প্রেমের আনুষ্ঠানিক যবনিকা শুরু। পরের দিন মির্চাকে এক ঘন্টার নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। মৈত্রেয়ীর মা একটা অজুহাত খুঁজছিলেন তাদের একত্র করার জন্য। সেজন্য তিনি বার বার বলছিলেন, তোমরা গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেছো কিনা। গান্ধর্ব মতে বিয়ে মানে হলো কন্যা স্বেচ্ছায় কোন বর পছন্দ করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেয়। মির্চার চলে যাবার দিন মৈত্রেয়ী অজ্ঞান হয়ে যায়। সেদিন তার বাবা মির্চার উপহার দেয়া তিনটি বইয়ের শুভেচ্ছাবার্তা লেখা পাতাগুলো ছিড়ে ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, তার বাবা বইপ্রেমী হবার কারণে বইগুলো ছিড়েন না। এই বিষয়টি তার বইয়ের প্রতি অনুরাগের প্রকাশ।

এরপর মির্চাকে চিঠি লিখে মৈত্রেয়ীর বাবা যোগাযোগ করতে বন্ধ করে। মৈত্রেয়ী বিভিন্নভাবে তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু মির্চা নিজেই আর যোগাযোগ করে না। হয়তো মৈত্রেয়ীর বাবার কঠোর নিষেধ এর কারণ হতে পারে। তারপরও খোকার কাছে লেখা কিছু চিঠি ৪৫ বছর পর মৈত্রেয়ী সংগ্রহ করে যেগুলো মির্চা মৈত্রেয়ীকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিল। খোকা হলো মৈত্রেয়ীর বাসার কাজের ছেলে।

আর ওদিকে মৈত্রেয়ী তখনও আইনে বাধা। সে মির্চার কাছে চলে এলেও প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তাকে জোর করে নিয়ে যাবার আইনগত অধিকার তার বাবার আছে। এই কারণে মৈত্রেয়ী আর বাসা থেকে চলে যাবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। তবে তারা তাদের এই বাড়িটা ছেড়ে দেয়,কারণ প্রতিবেশীরা এই ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করছিল। 

সে খুব চেয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকে বলে এই সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু কবিগুরুকে তার বাবা কোনোভাবে কষ্ট দিক, অপমান করুক তা মৈত্রেয়ী চায়নি। তবে কবিগুরুর দেয়া মূল্যবান উপদেশে মৈত্রেয়ী সান্ত্বনা খোঁজে। পরবর্তীতে মৈত্রেয়ী পড়াশোনা শুরু করে আবার। 

এরই মধ্যে মৈত্রেয়ীর মায়ের সংসারে ভাঙন ধরে। তার বাবা এক নারীকে দ্বিতীয় বিয়ে করে। কন্যা মৈত্রেয়ীকে নিয়ে সরোজিনী নাইডু হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাবা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। মৈত্রেয়ী লেখাপড়ায় তার কোন আগ্রহ নেই। মৈত্রেয়ী এই বন্দীখানা থেকে মুক্তি পেতে যেন বিয়ের পথ বেছে নেয়। মুক্তি সে পায়। তার স্বামী ছিলেন আপাদমস্তক একজন নিপাট ভদ্রলোক । তিনি মৈত্রেয়ীর লেখালেখির জগতে কোন হস্তক্ষেপ করেননি। বরং সাপোর্ট দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমার বেগম রোকেয়ার কথা মনে হয়েছে, যদি তিনি সাখাওয়াত হোসেনের মত একজন সাপোর্টিভ লিবারেল জীবনসঙ্গী না পেতেন, তাহলে রোকেয়ার এমন লেখা হয়তো আমরা পেতাম না।

বিয়ের রাতে মৈত্রেয়ী মির্চাকে কল্পনা করে যে আবহ এঁকেছে, পাঠক মাত্রই বুকজুড়ে বিশাল শূণ্যতা অনুভব করবেন, মনে হবে কালের স্রোতে আপনি ১৯৩৩ সালে চলে গেছেন, আপনার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়বে দিখাদ অশ্রু, বুকের ভিতর চিনচিন করবে ব্যথা, হাহাকার করবে অতৃপ্ত হৃদয়, মুহুর্তের মধ্যে মিশে যাবেন মির্চা আর মৈত্রেয়ী অনুভূতিতে।

বিয়ের পর তিন বছর মৈত্রেয়ী স্বামীর কর্মস্থল পাহাড়ি এলাকায় ছিল। সেই সময় তিন বার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে গিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই তার লেখালেখির প্রতি আরো ভালোভাবে জড়িয়ে যাওয়া।

মৈত্রেয়ী এসময় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনটি প্রবন্ধ অনুবাদ করেন।

কবিগুরু মৈত্রেয়ীকে মানুষের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে বলেন। মৈত্রেয়ী পাঁচ বছর ধরে মহাভারত, দুই বছর ধরে উপনিষদ, ছয় বছর ধরে মানব সভ্যতার ইতিহাস পড়াশোনা করেন। এরপর লিখতে শুরু করেন। রবীন্দরনাথকে নিয়েই তার পাঁচটি বই আছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শরনার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মৈত্রেয়ী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শরনার্থীদের সেবা করে আমাদের তিনি ঋনের বাঁধনে বেঁধেছেন। আটান্ন বছর বয়সে জানতে পারেন মির্চা তাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন যেখানে তিনি তার চরিত্রে কালিমা লেপন করেছেন। ষাট বছর বয়সে লিখতে বসেন 'ন হন্যতে'। সত্যিই তাদের এই বিরহে পাঠক পেয়েছে দুই বিখ্যাত যুগল উপন্যাস। এটা না ঘটলে হয়তো ভিন্নভাবে তাদের আমরা পেতে পারতাম।

জীবনের এই কঠিন সময়ে স্বামীকে পাশে পেয়েছেন, স্বামী তাকে উৎসাহ দিয়েছেন মির্চার সাথে দেখা করতে। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে মৈত্রেয়ী এবং তার জন্য ভালো কিছুই ঘটবে। এই জায়গায় মৈত্রেয়ীকে চিরাচরিত আবহমান বাঙালি নারী মনে হয়েছে। চরিত্রে কলঙ্কের দাগ যদি আসে সেটা প্রাণপণ মুছে পেলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। এই সমাজ হয়তো তাই চায়।

মৈত্রেয়ী মির্চার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কাজের সূত্রে তার ইউরোপ ভ্রমণের ডাক আসে। জীবনের এতটা বছর পর মৈত্রেয়ী দেখা করে মির্চার সাথে। সেই দেখা হবার দৃশ্য পাঠক হিসেবে আমার কল্পনায় ভেসে ওঠে। মৈত্রেয়ী বইয়ের সমুদ্র পার হয়ে মির্চার পড়ার ঘরে। আগে থেকেই জানতে পারা মির্চা পিছন ফিরে থাকে। মৈত্রেয়ীর মুখোমুখি হবার শক্তি তার নেই।

মৈত্রেয়ী জানতে চায়, "তোমার বইতে ও কী চরিত্র একেঁছ আমার, ওখানে তো আমাকে পেলাম না আমি।"

মির্চা বলে, "ফ্যান্টাসী,ফ্যান্টাসী, তোমাকে আমি রহস্যময়ী এক দেবী করতে চেয়েছিলাম যার কাজের কোন ব্যাখ্যা নেই। অঘনঘটনপটিয়সী দেবী কালির মতোই।"

মৈত্রেয়ী বাচ্চা মেয়ের মতো বলে ওঠে, "খবরদার আমাকে কালীর সঙ্গে তুলনা করবে না। চিরকাল তোমার এই,,,, আমি এত কি কালো?"

মির্চা তৎক্ষণাৎ। বলে, "আচ্ছা, আচ্ছা, দূর্গার মতো,যে অসম্ভব কাজ করতে পারে; এক হাতে অস্ত্র, অন্যহাতে বরাভয়।" 

জবাবে মৈত্রেয়ী বলে,"ফ্যান্টা‌সির সৌন্দর্য আছে,সত্যের সৌন্দর্য উজ্জ্বলতর, কিন্তু অর্ধসত্য ভয়ঙ্কর। তোমার বইটা তাই আমার কাছে বিভীষিকা।"

তাইতো 'লা নুই বেঙ্গলী' নিয়ে করা বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র 'The Bengali Nights' বন্ধের জন্য মৈত্রেয়ী মির্চা স্ত্রীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ঐ চলচ্চিত্র পরিচালকের নামে এক পর্যায়ে মামলা করেন। বন্ধ হয় চলচ্চিত্রটির প্রকাশ্য প্রদর্শনী। তবে সেটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।

এছাড়াও উপন্যাসটিতে তৎকালীন নারীদের দুরবস্থা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে,যা না বললেই নয়। এছাড়া ব্রিটিশ শাসনের নানান চিত্র এবং বৈষম্যও ফুটে  উঠেছে তার লেখায়। সত্যি বলতে, তাদের এই বিরহকাতর প্রেমে সাহিত্যের লাভ হয়েছে। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যে এই যুগল প্রেমের উপন্যাস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তাদের শেষ দেখার দৃশ্যটি একটি শোকার্ত আবহে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পাঠককে বহুকাল। ঘোর কাটবে না কিছুতেই। মনে হবে সমাজ সভ্যতার এই বৈষ্যমের নিচে যুগ যুগ ধরে চাপা পড়ে আছে কত কান্না, চাপা পরে আছেন হয়তো আপনিও।  মির্চা এবং মৈত্রেয়ী কেবলই তাদের প্রতিনিধিমাত্র। 

পারলৌকিক আশাবাদীরা এটুকু আশা করতেই পারে, কোন এক ছায়াপথে আবার তাদের দেখা হবে, ঘুচবে যুগান্তরের অচলায়তন, জাগবে ফের অনন্ত হৃদয়।


উপন্যাস: ন হন্যতে

লেখক: মৈত্রেয়ী দেবী

প্রাপ্তিস্থান : Uttara Book House, Dhaka.


Review by Jesmin Aktar 

                     18.07.2021

বিনাশ না হওয়া উপন্যাস 'ন হন্যতে'

মোঃ হেলাল উদ্দিন