Monday, May 6, 2024

নৈতিকতার ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Morality। ইংরেজি Morality শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Moralitas থেকে, যার অর্থ ‘সঠিক আচরণ বা চরিত্র’। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল সর্বপ্রথম নৈতিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। সক্রেটিস বলেছেন, “সৎ গুণই জ্ঞান” (Virtue is knowledge)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বোধের উৎস, হচ্ছে ‘জ্ঞান’ (knowledge) এবং অন্যায়বোধের উৎস হচ্ছে ‘অজ্ঞতা’ (ignorance)। পরবর্তীতে রোমান দার্শনিকরা প্রথাগত আচরণের অর্থে mas কথাটি ব্যবহার করেন। ল্যাটিন এই mas শব্দ থেকেই Morals Morality শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।

নীতিবিদ ম্যুর বলেছেন, ‘শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।’

জোনাথান হেইট (Jonathan Haidt) মনে করেন, ‘ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ- এই তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।’

নৈতিকতার সংজ্ঞায় Collins English Dictionary - তে বলা  হয়েছে, Morality is concerned with on negating to, human behavior, esp. the distinction between good and bad and right and wrong behavior.

নৈতিকতা সম্পর্কে অধ্যাপক নিউনার ও কিলিং বলেন, ‘নৈতিকতা হলো বিজ্ঞান ও দর্শনের সেই সকল কাজ যা মানুষের নৈতিক আচরণ, কর্তব্য এবং বিচার বিবেচনা বিশ্লেষণ করে।’

Cambridge International Dictionary of English - তে বলা হয়েছে, নৈতিকতা হলো ‘ভালো-মন্দ আচরণ, স্বচ্ছতা, সততা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি গুণ, যা প্রত্যেক ব্যক্তিই আইন কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।’

মানুষের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বা অনুভূতি থেকে নৈতিকতা বা নীতিবোধের বিকাশ ঘটে। শুধুমাত্র আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানই নাগরিক জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্যই আর. এম. ম্যাকাইভার বলেছেন, ‘Law, does not and can not cover all grounds of morality’।

নৈতিকতার পিছনে সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সমর্থন বা কর্তৃত্ব থাকে না। নৈতিকতা মূলত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাপার। নৈতিকতা বা ন্যায়নীতিবোধের ধারণা বা এর প্রতি যে দেশের জনগণের শ্রদ্ধাবোধ বেশি এবং যে রাষ্ট্রের মানুষের নৈতিক মান সুউচ্চ, সেদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ।

 

নৈতিকতার ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

মূল্যবোধের ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

মূল্যবোধের ধারণা

যে চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি। সমাজবিজ্ঞানীরা মূল্যবোধকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেনÑ
এম. ডবিøউ. পামফ্রে বলেন, ‘মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি বা সামাজিক দলের অভিপ্রেত ব্যবহারের সুবিন্যস্ত প্রকাশ।’
স্টুয়ার্ট সি. ডড এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হলো সে সব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং সমাজ ব্যক্তির নিকট থেকে লাভ করে।’
সমাজবিজ্ঞানী স্কেফার বলেন, ‘ভালো বা মন্দ, ঠিক বা বেঠিক এবং কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের বিদ্যমান ধারণার নাম হলো মূল্যবোধ।’
ক্লাইড ক্লুখোন এর মেত, সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব প্রকাশ্য ও অনুমেয় আচার-আচরণের ধারা যা ব্যক্তি ও সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত।’
নিকোলাস রেসার বলেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধ সেসব গুণাবলির, যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি
মোটকথা, মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি মানবিক গুণাবলীর সমষ্টি।

মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য

সামাজিক মূল্যবোধের কতিপয় বৈশিষ্ট্য হলো-
    মূল্যবোধ হচ্ছে সামাজিক মাপকাঠি। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মকান্ডের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।
    মূল্যবোধ সমাজের মানুষের মধ্যে যোগসূত্র ও সেতুবন্ধন স্থাপন করে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে।
    মূল্যবোধ এক প্রকার সামাজিক নৈতিকতা। এটা আইন নয়, এর বিরোধিতাও বেআইনি নয়।
    দেশ, জাতি, সমাজ ও প্রকৃতিভেদে মূল্যবোধ পরিবর্তন হয়।
    মূল্যবোধ নৈর্ব্যক্তিক। বর্তমানের অনেক মূল্যবোধ ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। যেমন অতীতে অনেক কিছু বর্তমানে নেই।
    মূল্যবোধ বৈচিত্রময় ও আপেক্ষিক।

মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগ

সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যার মধ্যে অন্যতম হলো-
 

সামাজিক মূল্যবোধ 

সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা গুণাবলির সমষ্টি।
নিকোলাস রেসার-এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব গুণাবলি যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে মূল্যবান মনে করে খুশি হয়।’
ক্লাইড ক্লখোন- এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব প্রকাশ্য ও অনুমেয় আচার-আচরণের ধারা যা ব্যক্তি ও সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত।’
স্টুয়ার্ট সি. ডড- এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হলো সে সব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে।’
সুতরাং বলা যায়, যে সকল চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামাজিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তার সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে।

রাজনৈতিক মূল্যবোধ 

রাজনৈতিক সততা, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ, রাজনৈতিক সহনশীলতা, রাজনৈতিক জবাবদিহিতার মানসিকতা, দায়িত্বশীলতার নীতি কার্যকর করা, পরমতসহিষ্ণুতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রতি সংখ্যালঘিষ্ঠের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান, সংখ্যালঘিষ্ঠের মতের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সহিষ্ণু আচরণ, বিরোধী মতকে প্রচার ও প্রসারের সুযোগ প্রদান, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বাধা প্রদান না করা, নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে মেনে নেয়া, আইনসভাকে কার্যকর হতে সাহায্য করা ইত্যাদি হলো রাজনৈতিক মূল্যবোধ।
মোটকথা হলো, যে চিন্তাভাবনা লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের রাজনৈতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে রাজনৈতিক মূল্যবোধ বলে।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ 

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেসব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার ও দৈনন্দিন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে অন্যের মতামত ও মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। গঠনমূলক সমালোচনা করার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা ও সংযম গড়ে তুলতে হবে। শৃঙ্খলাবোধে বিশ্বাসী হতে হবে। দায়িত্ব, অধিকার ও কর্তব্য সচেতন হতে হবে। সরকারকে তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ বা মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও নয়, বরং আইনসভায় বসে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

ধর্মীয় মূল্যবোধ 

সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, অপরের ধর্মমতকে সহ্য করা, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মকর্মে বাধা না দেয়া, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ধর্মকে বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করাই হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ। মোটকথা, যে সব ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-আচরণ ধর্মীয় কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ 

যে সব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বলে। সমাজে বসবাসকারী মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার, কর্মকান্ড ও সংগঠন থাকতে পারে। সেগুলোর প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি চর্চা, আকাশ-সংস্কৃতির মন্দ দিকগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে। তবে দেশীয় সংস্কৃতির লালন-পালনে রাষ্ট্রের কোন ধরনের বাধা দেয়া উচিত নয়।

নৈতিক মূল্যবোধ 

সত্যকে সত্য বলা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা, অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং অন্যকে বিরত রাখতে পরামর্শ প্রদান করা, দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অসহায় ও ঋণগ্রস্ত মানুষকে ঋণমুক্ত হতে সাহায্য করাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলা যেতে পারে।
মোটকথা, নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব মনোভাব এবং আচরণ যা মানুষ সবসময় ভালো, কল্যাণকর ও অপরিহার্য বিবেচনা করে মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করে। নীতি ও উচিত-অনুচিত বোধ হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস। শিশু তার পরিবারেই সর্বপ্রথম নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা পায়।

অর্থনৈতিক মূল্যবোধ 

মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো রয়েছে অর্থনৈতিক জীবন। অর্থনৈতিক জীবনে তাকে কিছু কাজ-কর্ম করতে হয়, বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হয়, যার সমষ্টিই হলো অর্থনৈতিক মূল্যবোধ।
আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ (ঝঢ়রৎরঃঁধষ ঠধষঁবং)
মানুষের কিছু আধ্যাত্মিক বা আত্মিক মূল্যবোধ রয়েছে। আত্মিক মূল্যবোধ সহজাত। এজন্যই মানুষ ভালোভাবে, সৎভাবে বাঁচতে চায়, সৎ থাকতে চায় এবং সৎ মানুষকে পছন্দ করে, মিথ্যেবাদী ও অসৎ মানুষকে ঘৃণা করে, ভালো কাজ করতে পারলে মনে স্বস্তি ও তৃপ্তিবোধ করে।

আধুনিক মূল্যবোধ

পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। এজন্যই অতীতের অনেক মূল্যবোধ এখন অর্থহীন। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। এগুলো বর্তমান সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। এভাবেই সময়ের সাথে মূল্যবোধও পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

 

মূল্যবোধের ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন


সুশাসনের ধারণা - মোঃ হেলাল উদ্দিন

সুশাসনের ধারণা

মানব সভ্যতার বিবর্তনের ফসল হলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। এই সংগঠনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এক সময় গড়ে উঠে শাসন ব্যবস্থা। শুরুতে সমাজ ও রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমানে জনকল্যাণই রাষ্ট্রের মূখ্য উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হয়। তাই শাসনের পরিবর্তে সুশাসনের প্রয়োজন হয়।


‘সুশাসন’ বা ‘
Good Governance’ সম্পর্কে জানতে প্রথমেই জানা প্রয়োজন ‘শাসন’ বা ‘Governance’ বলতে কী বুঝায়। ‘গভর্নেন্সকে’ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘শাসনের ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ল্যান্ডেল মিলস এবং সেরাজেল্ডিন (Landell Mills and Serageldin)-এর মতে, “জনগণ কীভাবে শাসিত হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পরিচালিত হয়, কীভাবে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় এবং একই সাথে এ সকল প্রক্রিয়া কীভাবে লোকপ্রশাসন ও আইনের সাথে সম্পর্কিত সে বিষয়কেই ‘গভর্নেন্স’ বা শাসন বলে।” 


বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯৪ সালে শাসনের সংজ্ঞায় বলে, ‘সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো শাসন বা গভর্নেন্স।’


হালফ্যানি (
Halfani) ও অন্যান্য গবেষকগণ সহমত পোষণ করে বলেন, ‘গভর্নেন্স বা শাসন হলো সরকারের এমন এক ব্যবস্থা যার লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত থাকে রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের মধ্যে বৈধ সম্পর্ক ও উন্মুক্ত যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং সেই সাথে কার্যকরী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, নির্বাচনি প্রক্রিয়া স্থাপন এবং প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল সরকারি কাঠামোকে ক্রিয়াশীলকরণ।’


‘গভর্নেন্স বা শাসনের সংজ্ঞায় ডি. কউফম্যান ও অন্যরা (
D. Kaufmann & others) বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় শাসকবর্গ নির্বাচিত হন, জবাবদিহি করেন, নিরীক্ষিত ও পরিবর্তিত হন; সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সরকারি দক্ষতা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ধারিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা বিবেচিত হয় তাকেই গভর্নেন্স বা শাসন বলে।’


অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান-এর মতে,     শাসন হলো এমন একটি ধারণা যেখানে কর্তৃপক্ষ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করে।’


শাসনের সাথে ‘সু’ প্রত্যয় যোগে ‘সুশাসন’ শব্দটির প্রকাশ করা হয়েছে। যার ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। ‘সুশাসন’ বিশ্বব্যাংকের উদ্ভাবিত একটি ধারণা। ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম ‘সুশাসন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় এবং বলা হয় উন্নয়নশীল দেশসমূহে সুশাসনের অভাবেই অনুন্নেয়ন ঘটেছে। তাই বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ঋণ সাহায্য ও প্রকল্প সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিতকরণের জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তা পূরণের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। বিশ^ব্যাংক ২০০০ সালে সুশাসনের প্রধান চারটি স্তম্ভ হিসাবে ১. দায়িত্বশীলতা, ২. স্বচ্ছতা, ৩. আইনি কাঠামো ও ৪. অংশগ্রহণ কে প্রকাশ করে।


বিশ্বব্যাংক (
World bank)-এর মতে, ‘সুশাসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয় যেখানে উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়’ (Good Governance is a manner in which power is exercised in the management of a country's economic and social resources for development.)।


UNDP- এর মতে, ‘একটি দেশের সার্বিক স্তরের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চর্চার বা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন’ (Good Governance is the exercise of economic, Political and administrative authority to manage a country's affairs at all levels.)।


জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান (
Kofi Annan) বলেছেন, ‘সুশাসন মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতাকে প্রবর্তন করে।’
 

ভি. কে. চোপড়া (V. K. Chopra) বলেন, ‘সুশাসন হলো শাসনের একটি পদ্ধতি যা সমাজের মৌলিক মূল্যবোধগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করতে সমর্থ, সেখানে মূল্যবোধগুলো হচ্ছে মানবাধিকারসহ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ক এবং একটি দায়বদ্ধ ও সৎ প্রশাসনের মাধ্যমে এই মূল্যবোধগুলো অন্বেষণ করা’ (Good governance is a system of governance that is able to Unambiguously identify the basic values of the society where values are economic, political and socio-culture issues including human rights and pursue these values through and accountable and honest administration.)। 


জি. বিলনে (
G. Bilney)- সুশাসনের সংজ্ঞায় বলেন, ‘Good Governance is the effective management of a country's Social and economic resources in a manner that is open, transparent, accountable and equitable.


অধ্যাপক ড. মহব্বত খান-এর মতে, ‘সুশাসন হলো একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা। তবে ব্যবস্থাটি হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায্য সমতাপূর্ণ।


ম্যাককরনী (
MacCorney) ‘সুশাসন’ সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান কওে বলেন, ‘সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়’ (Good governance is the relationship between civil society and the state, between government an governed, the ruler and ruled)।


পশ্চিমা বিশ্বের মতামত
‘সুশাসন’ বিষয়টি একটি বহুমাত্রিক এবং একটি আন্তর্জাতিক ধারণা। পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ সুশাসনের চারটি দিকের কথা উল্লখ করেছে। যথা-
    সুশাসন অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনাকে বুঝায়
    সুশাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
    রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ যাতে উত্তম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
    প্রশাসনিক দক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক।
 

দাতা সংস্থার মতামত
সুশাসন ধারণাটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উদ্ভাবিত হলেও এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছে বিভিন্ন দাতা ও সহযোগী সংস্থা। দাতা সংস্থাগুলো সুশাসনের কয়েকটি নির্দেশনা প্রদান করেছে। যথা-
    রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং একটি অবাধ নির্বাচিত আইনসভা।
    ব্যক্তি সত্তার অধিকার সংরক্ষণে সংবিধান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।
    স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ।
    শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন।
    একটি স্বাধীন নির্বাচিত আইনসভার নিকট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি প্রভৃতি।
 

মোটকথা, প্রশাসনের যদি জবাবদিহিতা (Accountability), বৈধতা (Legitimacy), স্বচ্ছতা (Transparency) থাকে, এতে যদি অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে, বাক স্বাধীনতাসহ সকল রাজনৈতিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের অনুশাসন থাকে তাহলে সে শাসনকে সুশাসন বলে।

 

সুশাসনের ধারণা - মোঃ হেলাল উদ্দিন