Monday, May 6, 2024

বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস -- মোঃ হেলাল উদ্দিন


১৯৭১ সালের বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব হওয়ার পর সংগত কারণেই একটি সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থায়ী সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি করেন।

গণপরিষদ আদেশঃ ২৩ মার্চ, ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এ আদেশ অনুযায়ী ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালের নির্বাচন অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৩০০ জন সর্বমােট ৪৬৯ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। এ গণপরিষদের মূল দায়িত্ব ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়ন।

অস্থায়ী সংবিধান আদেশঃ অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশে বলা হয় যে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত সকল জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদের সদস্য বলে বিবেচিত হবেন। এ আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় সরকারের প্রবর্তন করা হয়। গণপরিষদের সদস্যদের উপরই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান রচনার ভার অর্পণ করা হয়।

গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনঃ ১০ এপ্রিল, ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনের প্রথম দিনে গণপরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক স্পিকার নির্বাচিত হন শাহ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১০ জুন, ১৯৭২ উক্ত কমিটি এক বৈঠকে সংবিধানের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমােদন করেন। এ অধিবেশনে ৪১৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠনঃ ১২ এপ্রিল, ১৯৭২ গণপরিষদ খসড়া সংবিধান প্রণয়নের জন্য ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। গণপরিষদে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তই কেবল আওয়ামী লীগের বাহির হতে উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। গণপরিষদের ৭ জন মহিলা সদস্যের মধ্যে বেগম রাজিয়া বানু-কে কমিটির সদস্য করা হয়। এ কমিটিকে ১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে একটি বিলের আকারে তাদের রিপাের্ট গণপরিষদে পেশ করতে বলা হয়।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কার্যক্রমঃ খসড়া সংবিধান কমিটি সর্বমোট ৭৪টি বৈঠকে মিলিত হয়। কমিটির প্রথম বৈঠকের প্রস্তাব অনুযায়ী বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব চাওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জুনের বৈঠকে সংবিধানের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমোদিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে বলে স্থির করা হয়েছিল, সেহেতু একে পূর্ণাঙ্গ ও যথাসম্ভব ফলপ্রসূ করে তোলার লক্ষ্যে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও ব্রিটেন সফর করেন। তিনি উভয় দেশের পার্লামেন্টের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেন এবং দেশে ফিরে উক্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। কমিটির সভাপতি ১১ জুন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন এবং খসড়া সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করেন। ১১ অক্টোবর কমিটি সর্বশেষ আলোচনা করেন এবং ঐ দিন সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ খসড়া চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।

গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনঃ বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ১২ অক্টোবর, ১৯৭২। এই অধিবেশনে গণপরিষদ কতিপয় সংশোধনী মতে খসড়া সংবিধান কার্যপ্রণালি সংক্রান্ত বিধিমালা গ্রহণ করেন। গণপরিষদে সাংবিধানিক বিলটির উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এ সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত।’ সে সাথে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এ সংবিধান দেশের সমগ্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক বলে বিবেচিত হবে। সংবিধান বিলটি উত্থাপনকালে আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘এ সংবিধান গণতান্ত্রিক উপায়ে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। এটা এমন এক সমাজব্যবস্থা যাতে আইনের শাসন, মৌল মানবিক অধিকার এবং স্বাধীনতা, সাম্য ও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার সকল নাগরিকের জন্য অর্জিত হবে।’

সংবিধান বিধিবদ্ধকরণঃ ১২ অক্টোবর, ১৯৭২ গণপরিষদ অধিবেশনে মিলিত হয়। ঐ দিন বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের সময় ৭৩ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান অধিবেশনে পেশ করেন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কমাল হোসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ যে সংবিধান রচনা করেছে, তা বাংলাদেশের জনগণের তাজা রক্তে লেখা হয়েছে।’ আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ সংবিধান বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বিরাট দিকদর্শন।’ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের নিকট হতে গৃহীত প্রায় ৭৫০টি সংশােধনী প্রস্তাব পরীক্ষা করে মাত্র কয়েকটি গ্রহণ করা হয়। ১৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সংবিধান বিল সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা চলে। অতঃপর ৩১ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের দফাওয়ারী আলোচনা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর কতকগুলো সংশোধনীসহ খসড়া সংবিধানের সকল অনুচ্ছেদ ও তফসিল গৃহীত হয়। ৪ নভেম্বর গণপরিষদে জনপ্রতিনিধিগণ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থায়ী সংবিধান বিধিবদ্ধ করেন। সেদিন বেলা ১টা ৩০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড এর সময় গণপরিষদের সদস্যদের তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে সংবিধানটি পাস হয় এবং তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘একটি জাতি হিসেবে বাঙালি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সংবিধান প্রণয়ন করলো।’ এভাবে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ হতে বিধিবদ্ধ সংবিধান বলবৎ হয়।

বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:

Post a Comment