Tuesday, April 18, 2023

আলাউদ্দিন আল আজাদ এর উপন্যাস 'তেইশ নম্বর তৈলচিত্র -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

আলাউদ্দিন আল আজাদ এর প্রথম উপন্যাস 'তেইশ নম্বর তৈলচিত্র। উপন্যাসটি ১৯৬০ সালে 'পদক্ষেপ' নামক একটা অনিয়মিত পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রথম ছাপা হয়। বই আকারে প্রথম প্রকাশ করে 'নওরোজ কিতাবিস্তান' প্রকাশনী। তৎকালীন সময়ে রচিত ও প্রকাশিত উপন্যাসটি ছিলো আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। উপন্যাসের কাহিনী সংক্ষেপ হলোঃ

আর্ট স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র জাহেদের সঙ্গে রঙের দোকানে হঠাৎ করেই পরিচয় ঘটে জামিলের। জামিলের অনুরোধে তাকে বিজ্ঞাপন আঁকার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে জামিলের বোন ছবির সঙ্গে জাহেদের পরিচয় হয়। ছবির সাদামাটা মায়াময়ী ভাব অতি দ্রুতই জাহেদকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলে। ছবির আকর্ষণেই জাহেদ বারবার জামিলের বাড়িতে যেতে থাকে। একপর্যায়ে জাহেদ ছবির প্রতি ভালবাসা অনুভব করতে শুরু করে এবং শীঘ্রই দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবেসে কাছে আসে। মূলত, প্রেমের উত্থান এবং প্রেমকে লালন করার তীব্র সৌন্দর্যের বর্ণনার মাধ্যমে উপন্যাসটির সূচনা ঘটে।

জামিল একসময় ছবির প্রতি জাহেদের আকর্ষণ বুঝে ফেলে। জামিল মনে করতো, বিয়ে সত্যিকারের শিল্পী হওয়ার পথে অন্তরায়। তাই জাহেদ জামিলের কাছে ছবিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে বিরুপভাবে প্রতিক্রিয়া করে। জামিল জাহেদকে আঘাত করে এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। কলকাতায় আর্ট স্কুলে পড়াকালে সহপাঠিনী মীরা দাশগুপ্তার সাথে জামিলের প্রেম হয় এবং তাদের বিয়েও হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিরাগ জন্মালে তারা পৃথক হয়ে বাস করতে শুরু করে।

জামিল অসুস্থ হয়ে পড়লে জাহেদ মীরাকে ডেকে আনে এবং মীরা অসুস্থ জামিলের আবারও সেবা করতে শুরু করে। তাদের পুনরায় পারিবারিক মিলন ঘটে। এরপর মীরার মাধ্যমেই জাহেদ ও ছবির বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়।

অবশেষে শরতের একদিনে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের প্রথম রাতে জাহেদ আবিষ্কার করে- ছবির দেহে স্পষ্ট মাতৃত্বের চিহ্ন। মুহূর্তেই তার পুরো জগত দুলে ওঠে। কোথায় যেন সুর কেটে যায়। দীর্ঘ কয়েকদিন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়ে সে ছবির কাছে প্রশ্ন করে, “কেন ধোঁকা দিলে?” রাতভর জেগে ছবির কান্নাভরা কণ্ঠ থেকে সে জানতে পারে, ছবির দাদা জামিলের কাছে আসা এক ব্যবসায়ী পশুর হাতে বাধ্য হয়ে সকলের অজান্তে তার নিরীহ আত্মসমর্পণের গল্প। ছবির পেটে আসা বাচ্চাটিকে পরে গর্ভপাত করে নষ্ট করে ফেলা হয়। শিশুর কান্না শুনলেই ছবির বুকে যে হাহাকার জেগে ওঠে, তার করুণ গল্প সে শোনায়। ছবি গভীর ভালবাসায় বলে, জাহেদই তার জীবনের প্রথম প্রেম এবং তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। জাহেদ অনুভব, দুর্ঘটনার কবলে ছবি ছিল নিতান্তই অসহায়, তাই সেটি উপেক্ষা করাই শ্রেয়।

সংকীর্ণতার বদলে মহত্ত্ব দেখিয়ে সব ঘটনাকে জাহেদ সহজভাবে গ্রহণ করে এবং ভালবেসে আবার ছবিকে আগলে ধরে। তার কাছে মনে হয়, ছবির আর তার ভালবাসাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। তাদের ভালবাসায় জন্ম নেয় তাদের ভালবাসার প্রথম পুষ্প-সন্তান টুলটুল।

জীবনে দুঃখ-কষ্ট বা বেদনার চেয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসরিত প্রেমও যে একজন শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির প্রধান অনুপ্রেরণা হতে পারে, তা জাহেদ বিশেষভাবে অনুভব করে। মায়ের কোলে গভীর মমতায় জাপটে ধরে বসে থাকা শিশুর যে চিত্র, ঐ চিত্রের সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই বলে জাহেদের মনে হয়। ছবি ও টুলটুলের একটি ছবি এঁকে সে ছবিটির নাম দেয় 'মাদার আর্থ', অর্থাৎ ‘বসুন্ধরা’। পাকিস্তানের 'জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী'তে ছবিটি প্রথম পুরস্কার পায়। স্নিগ্ধতায় ভরা সেই ছবিটির সৃষ্টির কাহিনী বলতে গিয়েই এ উপন্যাসের গল্প জাহেদ বলতে শুরু করে। এছাড়া বন্ধু মুজতবার সাথে জাহেদের পতিতালয় এবং পাহাড়ী এলাকায় যাওয়ার কিছু আনুষঙ্গিক ঘটনাও রয়েছে। পতিতালয়ের রাধারানী অথবা পাহাড়ি এলাকায় মগকন্যা তিনার সাথে মুজতবার ব্যর্থ প্রেমও এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ।  জাহেদের পাকিস্তান থেকে পুরস্কার পেয়ে প্লেনে করে পুনরায় ঢাকায় ফিরে ছবি ও টুলটুলকে কাছে টেনে নেওয়ার কথা বলে উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটেছে।

উপন্যাসটিকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এর উদ্যোগে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রুপ দেয়া হয় 'বসুন্ধরা' নামে, যাতে মূল চরিত্রে ছিলেন ববিতা ও ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার পেয়েছিল। এছাড়াও উপন্যাসটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

 







বইঃ তেইশ নম্বর তৈলচিত্র

লেখকঃ আলাউদ্দিন আল আজাদ

প্রকাশকঃ বইপত্র

মূল্যঃ ৭০ টাকা

 

আলাউদ্দিন আল আজাদ এর উপন্যাস 'তেইশ নম্বর তৈলচিত্র 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

2 comments:

  1. সুন্দর একটা উপন্যাস এবং সুন্দর রিভিউ হয়েছে।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ আলোচনা হয়েছে।

    ReplyDelete