Wednesday, February 14, 2024

সামাজিক গবেষণায় আইসিটি’র প্রয়োগ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

সামাজিক গবেষণায় আইসিটি’র প্রয়োগ

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সামাজিক গবেষণায় অনেক প্রভাব ফেলে। তিনটি শ্রেনিতে ভাগ করে গবেষণায় আইসিটি’র প্রয়োগকে দেখা যায়। যেমন-

১. প্রাক-তথ্য বিশ্লেষণে আইসিটি

২. তথ্য বিশ্লেষণে আইসিটি

৩. উত্তর-তথ্য (Post-data) বিশ্লেষণে আইসিটি

১। প্রাক-তথ্য বিশ্লেষণে আইসিটি’র প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে-

১. সাহিত্য অনুসন্ধানঃ লাইব্রেরিতে হাজার হাজার বইয়ের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় সাহিত্য অনুসন্ধান করা ক্লান্তিকর ও সীমিত ফলাফলের চেষ্টা। সেখানে ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে বই, নিবন্ধ, জার্নাল সহ প্রয়োজনীয় সকল কিছু সহজেই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে যে সকল এ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে সাহিত্য অনুসন্ধান করা যায় তা হলো- Shodh Ganga, Google Scholar, Microsoft Academia Search, Mendeley, SSRN. এছাড়াও রয়েছে- AMS, Annual Reviews, ASME, Digital Collection, Cambridge Core, CAS, Cochrane Library, e-Book Academia Collection, EBSCO, Databases, IEEE Xplore, JSTOR, Springer Link ইত্যাদি।

২. বিষয়বস্তু অনুসন্ধানঃ সাহিত্য অনুসন্ধানে গবেষক সফ্ট কপি ব্যবহার করে আরো সহজে গবেষণা করতে পারে। অনলাইনে প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষক সহজে অধ্যায় অনুসন্ধান করে এবং কম সময়ে উর্পযুক্ত পর্যালোচনা করতে পারে। বিশেষ করে গুণগত গবেষণায় এটা অত্যন্ত কার্যকরী একটা পদ্ধতি।

৩. সাহিত্য ট্রাকিংঃ অতীতে গবেষককৃত তৈরি করা সমস্ত সাহিত্য বা নির্দশনগুলোকে বাছাই করতে, শ্রেণিবদ্ধ করতে এবং সংরক্ষণ করতে তারা যে ফোল্ডারগুলো ব্যবহার করেছে বর্তমানে গবেষকরা মেন্ডেরির মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই তা করতে পারেন। তবে কম্পিউটার ছাড়া এই কাজ করা কঠিন।

৪. তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে জরিপের মাধ্যমে স্বল্প সময় ও খরচে খুব সহজে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত দুইটি এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারের নাম হলো- Google Forms এবং Survey Mankey.

২। তথ্য বিশ্লেষণে আইসিটি’র প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে-

১. পরিমাণগত তথ্য বিশ্লেষণঃ অনুসন্ধানমূলক ঘটনা বিশ্লেষণে, একাধিক প্রত্যাবৃত্তি (Multiple regression), টি-টেস্ট (T-Test), অনৈক্যবিশ্লেষণ (Analysis of Variance), ইত্যাদির ক্ষেত্রে গবেষক পরিমাণগত তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বর্তমানে আরো কতিপয় তথ্য বিশ্লেষণ কৌশল ব্যবহার করা হয়। যেমন- Path Analysis, Covariance Base Structural Equation Modeling SEM, Hierarchical Regression Analysis, Hierarchical Linear Modeling ইত্যাদি। এছাড়াও পরিমাণাত্মক তথ্য বিশ্লেষণে সহজে আরো যে এ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে-

                                I.            Statistical Package for Social Science

                             II.            R (R foundation for statistical computing)

                           III.            MATLAB (The math work)

                          IV.            Microsoft Excel

                             V.            SAS (Statistical Analysis Software)

                          VI.            Graph Pad Prism

                        VII.            Minitab ইত্যাদি।

২. গুণাত্মক তথ্য বিশ্লেষণঃ গুণাত্মক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য যে সকল পরিসংখ্যানগত সফ্টওয়্যার সমূহ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে-

                                I.            NVivo

                             II.            ATLAS.ti

                           III.            MAXQDA

                        IV.            SPSS Text Analysis

                           V.            Transan ইত্যাদি।

৩। উত্তর-তথ্য (Post-data) বিশ্লেষণে আইসিটি’র প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে-

১. তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জি সংকলন। এক্ষেত্রে যে সকল সফ্টওয়্যার ব্যবহৃত হয় তা হলো- End Note, Zotero এবং Mendeley ইত্যাদি

২. প্রবন্ধ এবং থিসিস/ গবেষণামূলক আলোচনার যে অনলাইন প্লাটফর্ম রয়েছে তা হলো- Academia.edu Research Gate ইত্যাদি।

৩. চৌর্যবৃত্তি সনাক্তকরণে আইসিটি’র বড় অবদান রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে চৌর্যবৃত্তি সনাক্তকরণ সহজ হয়েছে। এই সফ্টওয়্যারের মধ্যে রয়েছে- Grammarly, Article Checker, Turnitin, Dupli Checker ইত্যাদি।

৪. জার্নাল পান্ডুলিপি জমা দেয়ার ক্ষেত্রে এখন ওয়েব ভিত্তিক পান্ডুলিপি ব্যবস্থাপনা এবং পিয়ার রিভিউ সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যা সময় বাঁচায় এবং গুনগত মানকে উন্নত করে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত সফ্টওয়্যারগুলোর মধ্যে রয়েছে- Elsevier, Wiley, Saga Publication ইত্যাদি।

গবেষণার জন্য উল্লেখিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার ছাড়াও আরো বহু সফ্টওয়্যার রয়েছে যা একটি মান সম্মত গবেষণাপত্র তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং বলা যেতে পারে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার গবেষণাকে আরো সহজ এবং মানসম্মত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

সামাজিক গবেষণায় আইসিটি’র প্রয়োগ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Thursday, February 8, 2024

গবেষণা প্রশ্ন -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

গবেষণা প্রশ্ন হলো কোন একটি নির্দিষ্ট সমস্যার বিষয় বা ঘটনার উত্তরযোগ্য অনুসন্ধান। যা গবেষণার বিষয় এবং অনুকল্পের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপন করে থাকে। এটি নিয়মতান্ত্রিক তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু। যেকোনো গবেষণা প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো গবেষণা প্রশ্ন। মোটকথা, গবেষণা প্রশ্নের মাধ্যমে একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু হয় এবং এটি ঐ নির্দিষ্ট গবেষণাকর্মের গতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। একটি গবেষণা প্রশ্ন কিছু নিয়ম মেনে হয়ে থাকে। যেমন-

১. স্পষ্টঃ গবেষণা প্রশ্নটি হতে হবে স্পষ্ট, যাতে কোন অতিরিক্ত ব্যাখ্যা ছাড়াই এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারা যায়।

২. সুনির্দিষ্টঃ গবেষণা প্রশ্নটি হতে হবে সুনির্দিষ্ট, যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

৩. সংক্ষিপ্তঃ গবেষণা প্রশ্নটি অবশ্যই সংক্ষিপ্ততম শব্দে লিখতে হয়।

৪. জটিলঃ গবেষণা প্রশ্নটি এমন হবে যাতে "হ্যাঁ" বা "না" দিয়ে এটির উত্তর দেওয়া সম্ভব না হয়। সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে যাতে গবেষককে প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলির বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ প্রয়োজন হয়।

৫. যুক্তিযুক্তঃ গবেষণা প্রশ্নের সম্ভব্য উত্তরগুলো শুধু তথ্যের পরিবর্তে যুক্তিযুক্ত বিতর্কের জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে।

গুণগত গবেষণা এবং পরিমাণগত গবেষণা এই দুই ধরনের গবেষণা আছে। প্রতিটি গবেষণার জন্যই গবেষণামূলক প্রশ্ন থাকতে হবে। একজন গবেষক কি ধরনের গবেষণা করতে চায় এবং কোন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে চায় তার উপর ভিত্তি করেও গবেষণা প্রশ্নের ধরন নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। গবেষণা প্রশ্ন যে সকল ধরনের হতে পারে-

Research Question Type

Question

Descriptive 

(বর্ণনামূলক প্রশ্ন)

What are the properties of A?

Comparative 

(তুলনামূলক প্রশ্ন)

What are the similarities and distinctions between A and B?

Correlational

(পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত প্রশ্ন)

What can you do to correlate variables A and B?

Exploratory

(অনুসন্ধানমূলক প্রশ্ন)

What factors affect the rate of C's growth? Are A and B also influencing C?

Explanatory

(ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন)

What are the causes for C? What does A do to B? What's causing D?

Evaluation

(মূল্যায়ন মূলক প্রশ্ন)

What is the impact of C? What role does B have? What are the benefits and drawbacks of A?

Action-Based

(অ্যাকশন-ভিত্তিক প্রশ্ন)

What can you do to improve X?

একটা সুন্দর ও শক্তিশালী গবেষণা প্রশ্ন লেখার জন্য নিম্নলিখিত মানদন্ডগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে, যার মাধ্যমে গবেষণা প্রশ্নের গুরুত্ব মূল্যায়ণ করা যায়। মানদন্ডগুলো মধ্যে রয়েছে-

১। গবেষণাযোগ্যঃ

১. এটি শুধুমাত্র একটি সমস্যা সম্পর্কিত হতে হবে।

২. কোন ধরনের বিয়ষবস্তুগত সিদ্ধান্ত অর্ন্তভুক্ত করা যাবে না।

৩. তথ্য বিশ্লেষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে এর উত্তর দেওয়া যাবে।

 

২। নির্দিষ্ট এবং ব্যবহারিক

১. গবেষণা প্রশ্নে কর্মের পরিকল্পনা, নীতি বা সমাধান থাকা উচিত নয়।

২. গবেষণা প্রশ্নটিকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।

৩. এটি গবেষণার সীমার মধ্যে থাকবে।

 

৩। জটিল এবং যুক্তিতর্ক

১. গবেষণা প্রশ্নে উত্তর দিতে কঠিন হবে না।

২. গবেষণা প্রশ্নে সত্য খুঁজে পেতে গভীর জ্ঞান প্রয়োজন হবে।

৩. গবেষণা প্রশ্নটিকে আলোচনা এবং সমালোচনার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। 

 

৪। মূল এবং প্রাসঙ্গিক

১. গবেষণা প্রশ্নটি অবশ্যই গবেষকের অধ্যয়নের এলাকার মধ্যে হওয়া উচিত।

২. গবেষণা প্রশ্নের ফলাফল অবশ্যই পরিমাপযোগ্য হওয়া উচিত।

৩. গবেষণা প্রশ্নটি অবশ্যই আসল তথা মূল হতে হবে।

 

 গবেষণা প্রশ্ন -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Friday, February 2, 2024

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন ছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে আপোষহীন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ়চেতা ও সংগ্রামী। এ জন্য পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বারবার শাসকগোষ্ঠীর খড়গহস্ত বঙ্গবন্ধুর ওপর নেমে আসে।

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধু কারাবন্দি ছিলেন। কারাগারে অবস্থান করেই তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে উচ্চকণ্ঠ থেকে, আন্দোলনকে বেগবান করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৬ ফেব্রæয়ারি, ১৯৫২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর সাথে কারাগারে বন্দি মহিউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। বঙ্গবন্ধুর এসব দাবীর প্রতি সমর্থন পোষণ করে এ  বিষয়ে আলোচনার দাবি জানিয়ে  পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে মূলতবি প্রস্তাাব গ্রহণ করা হয়। এ অবস্থায় শাসকগোষ্ঠী ১৮ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমদকে অনশনরত অবস্থায় ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করেন। এভাবেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে বঙ্গবন্ধু পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সচেষ্ট থেকেছেন।

১৯৫২ সালে চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দুটি কারণে ঐ সম্মেলনে বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। প্রথমত, চীনের অনেক প্রতিনিধি ইংরেজি জানার সত্তে¡ও মাতৃভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের কিছুদিন আগে পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষার জন্য যে আন্দোলন হয়েছে তা অন্য দেশের প্রতিনিধিদের কাছে আরো একবার তুলে ধরা। এভাবে ভাষা আন্দোলনের কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু দেশের বাইরে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন।

বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা ও বহুমাত্রিকতা বিকাশে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলা একাডেমি। বর্তমানে বাংলা একাডেমি একটি বিশ^মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অনেকের অজানা, পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার বিকাশে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী। মূলত ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেস্টায় পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়। এছাড়া বাংলা একাডেমি প্রথম যে আন্তর্জাতিক সাহিত্যে সম্মেলন করে, সেটিও বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ ও আন্তরিক  প্রচেষ্টায়।

ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা এসব ঘটনার পর পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা চর্চা বিশেষ করে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার ব্যাপারে এক প্রবল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির এই আশা আকাঙ্খা ধারণ করে ১৯৭১ সালের ১৫ই ফেব্রæয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের অনুষ্ঠানমালায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন 'যে দিনই আমরা ক্ষমতায় যাবো তার পরদিন থেকে সরকারী নথিপত্র, অফিস-আদালত সব জায়গায় বাংলা চালু হবে। এটা কোনো লোক দেখানো ঘোষণা নয়, দেশের জনগণের তীব্র চাহিদার স্বীকৃতি। '

৫ই জুন, ১৯৫৫ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ সময়ে অবাঙালি পাকিস্থানী শাসকেরা পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে সচেষ্ট হয়। ২৫শে আগষ্ট, ১৯৫৫ করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রদত্ত  এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন,

'স্যার, আপনি দেখবেন ওরা 'পূর্ব বাংলা' নামের পরিবর্তে 'পূর্ব পাকিস্তাান' রাখতে চাই। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। 'বাংলা' শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগনের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না।'

অর্থাৎ যেখানে বাংলার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে সেখানেই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন।

বাংলা ও বাঙালি সত্তা লালনই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় অংশ নির্জন কারাগারে কাটিয়েছেন। তখন দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় কথা না বলতে পারা, বাংলায় লেখা বই পড়তে না পারা, বেতারে বাংলা গান শুনতে না পারার মনোবেদনার কথা তাঁর লেখা 'কারাগারের রোজনামচা'য় আমরা দেখতে পাই। ১৯৬৬ সালে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় নুরু নামের এক কয়েদির গান শুনে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন,' গান গাও নুরু, বাংলার মাটির সাথে যার সম্বন্ধ আছে সেই গান গাও'। ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যখন পাকিস্থানী সেনা প্রহরায় ঢাকা কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয় তখন বঙ্গবন্ধুর মনে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয় সেটি 'কারাগারের রোজনামচা'য় বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন এভাবে, 'মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, তোমাকে আমি ভালোবাসি। মৃত্যুর পর তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা'। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, যখন মিথ্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর আয়োজন চলছিল তখন বঙ্গবন্ধু বলেই শত্রæর সামনে বলতে পেরেছিলেন, ' ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা'।

১৯৬৯ সালের ৫ ই ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু জনগণের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের নাম 'বাংলাদেশ' রাখেন। পৃথিবীতে এমন রাজনীতিক দ্বিতীয়টি নেই, যিনি একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন, নতুন সে রাষ্ট্র জন্মানোর আগেই তার নামকরণ করেছেন এবং একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু অনেক আক্ষেপ নিয়েই পূর্ব পাকিস্থানের নাম বাংলাদেশ রাখেন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যখন পূর্ব বাংলায় তথাকথিত ইসলামীকরণের নামে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির উপর একের পর এক আঘাত এনে সবকিছু পরিবর্তন করতে থাকে, তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আজ বঙ্গপোসাগর ছাড়া আর কোথাও বাংলা নামের অস্তিত্ব দেখিতে পাই না, জনগণের পক্ষ হইতে ঘোষণা করিতেছি, পাকিস্তানের পূর্ব অংশটি আজ   হইতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ।'

১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র পূর্ব বাংলায় যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছে, তখন ৩মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ঢাকার পল্টনে ঘোষিত হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। তাৎকালীন ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সেই ইশতেহারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার  ইশতেহার সমর্থন করে বক্তৃতা দেন।বস্তুত এভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা সংস্কৃতি অর্থাৎ বাংলা- বাঙালির বিকাশকে  সবসময়  মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে বাংলার কোন দিন বিকাশ হবে না।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের স্বশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহন করেই বাংলা বিকাশে তাঁর পূর্বের রাজনৈতিক অঙ্গিকার পূরণে হাত দেন। ১৯৭২ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু সরকার জারি করেন 'দি বাংলা একাডেমি অর্ডার, ১৯৭২'। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমির কলরব বৃদ্ধি করেন, বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা ও শ্রীবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন।

বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। সফলতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সরকার পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠতম সংবিধান এদেশের জনগণকে  উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রবর্তিত সেই সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ এ  বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ৪(১) অনুচ্ছেদ এ প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা'র প্রথম দশ চরণ এবং ৪(২) অনুচ্ছেদ এ প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা 'সবুজের ক্ষেত্রের উপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত' বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা স্বাধীনতার ইশতেহারে ছিল।

এছাড়া সংবিধানের ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদ এ বলা আছে এ সংবিধান পাঠের ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। এভাবে সংবিধানে মাতৃভাষা বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব রাখা হয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি- বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিঃ বঙ্গবন্ধু এ সময় আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য বিকাশে। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে ভারত থেকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কবিকে দেওয়া হয় নাগরিকত্ব ও জাতীয় কবির মর্যাদা। ঢাকার ধানমন্ডিতে জাতীয় কবিকে বরাদ্দ দেওয়া হয় সরকারি বাড়ি বাড়িটির নাম দেওয়া হয় 'কবি ভবন'। কবি ভবনে সরকারি নিয়মে জাতীয় পতাকা টানানো হতো। মূলত একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সে সময় বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশে সম্ভাব্য সব কিছু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ও পাকিস্তানের সাথে টানাপোড়েন এবং তা নিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতির নানা মেরুকরণ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম. নিক্সন কে অবহিত করেন। আশ্চার্যের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু এ বিশেষ বার্তা মার্কিন প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছেন চিঠির মাধ্যমে। আরো আশ্চার্যের ব্যাপার হলো বিশেষ দূত মাধ্যমে পাঠানো চিঠিটি ছিলো বাংলায় লেখা। বিশ্বনেতাদের কাছে মাতৃভাষা বাংলায় চিঠি লেখার এ ঘটনা বিশ্বে বিরল, যা বঙ্গবন্ধু বলেই সম্ভব ছিল। যে রিচার্ড নিক্সন ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী, সেই রিচার্ড নিক্সনকে সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাতৃভাষাতে চিঠি দিয়ে শুধু মাতৃভাষা বাংলার শ্রীবৃদ্ধি করেননি, বাঙালি ও বাংলাদেশকে করেছেন মহান।

বাংলা ভাষার মর্যাদা বিকাশে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিন বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা করেন। বাংলা ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠায় এমন ঘটনা তখন পর্যন্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি ঘটেনি। এর আগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করে বিশ্বমঞ্চে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করে তোলেন। যদিও তিনি নোবেল পেয়েছিলেন গীতবিতান এর ইংরেজি অনুবাদ এর উপর। কবিগুরু  তাঁর নোবেল বক্তৃতাটি বাংলাতে করলে সেটি হতো বাংলা ভাষার জন্য অহংকারের, কিন্তুু  তিনি তা করেছিলেন ইংরেজিতে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার লাভের পর দুনিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মশালায় যে বক্তৃতা করে বেড়িয়েছেন তাও সব ইংরেজিতে। এখানে বঙ্গবন্ধু অনন্য। জীবনে যখন যেখানে তিনি বাংলা ভাষা তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন,সেখানেই স্বগৌরবে তুলে ধরেছেন বাংলা ভাষাকে।

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই সত্যি, কিন্তুু তাঁর জীবনের অর্জনগুলো দিয়ে তিনি আজও বাংলা বিকাশে ভূমিকা রেখে চলেছেন।

ভাষা আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে কারাগারে অনশনে থাকা বঙ্গবন্ধুসহ ভাষাসৈনিকদের সেই আত্মত্যাগের দিনটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়ে এটি বর্তমানে 'ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার - এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কারাগারের বন্দী দিনগুলোতে বাংলা ভাষায় লেখা তাঁর ডায়রিগুলো এখন পর্যন্ত তিন তিনটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের এক অনন্য দলিলে পরিণত হয়েছে। বইটি তিনটি হলো 'অসমাপ্ত আতœজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা ' এবং 'আমার দেখা নয়াচীন'।  বর্তমানে বইগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনুদৃত হচ্ছে, যা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে আরো গভীরভাবে পৌছে দিবে বিশ্ববাসীর কাছে। বঙ্গবন্ধুর  লালন করা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বাউল সংগীত, জামদানি শাড়ি এবং মঙ্গল শোভাযাত্রাও আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এ জাতি সবসময় অন্যের দ্বারা শাসিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই জাতিকে বিশ্ব মানচিত্রে ঠিকানা করে দিয়েছেন স্বাধীন জাতি হিসেবে। প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি এ জাতির জাতিসত্তা গঠনের পেছনে মূল অনুরণন। বঙ্গবন্ধু আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন সেই বাংলা বিকাশে।

 

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন