Friday, November 17, 2023

সামাজিক গবেষণার ধারণা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং বৈশিষ্ট্য সমূহ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন


সামাজিক গবেষণার ধারণা

সামাজিক গবেষণা হল ব্যক্তি এবং সমাজের মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক প্রবণতা, গতিশীলতা এবং নীতিগুলোর অধ্যয়ন। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে সমাজের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।

সামাজিক গবেষণার সংজ্ঞায় K. D. Baily বলেন, “সামাজিক গবেষণা হচ্ছে তথ্য আহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রয়াস, যা সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানে আমাদেরকে সহায়তা করে এবং সমাজ সম্পর্কে আমাদেরকে জ্ঞাত হতে সক্ষম করে তোলে।”

Encyclopedia of Social Research (ভলিউম-১, ১৯৯৭) এর ভাষ্য অনুযায়ী, সামাজিক গবেষণা সামাজিক প্রপঞ্চ নিয়ে অনুসন্ধান করে। এটা সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের আচার-আচরণ, তাদের অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনযাপন প্রণালী ইত্যাদি বিভিন্ন আঙ্গিক জানার চেষ্টা করে।

P. V. Young এর মতে, “সামাজিক গবেষণাকে একটি বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে; যৌক্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে, যার লক্ষ্য হলো- ১. নতুন তথ্য উদঘাটন বা পুরাতন তথ্য যাচাই করা; ২. উপযুক্ত তাত্তি¡ক কাঠামো অনুসরণে এদের পারস্পরিক অনুক্রম, আত্মসম্পর্ক এবং কার্যকরণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা; ৩. নির্ভরযোগ্য ও যথার্থ মানব আচরণ অধ্যয়নের সুবিধার্থে নতুন বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার, প্রত্যয় ও তত্ত¡ উন্নয়ন করা।”

P. V. Young আরো বলেন, “Social research is a systematic method of exploring, analyzing and conceptualizing social life in order to extend, correct or verify knowledge, whether that knowledge aid in the constructing of a theory or in the practice of an art.”

উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণা হলো সমাজ বিষয়ক গবেষণা যেখানে সামাজিক জীবনের বিষয়গুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ, ধারণা ও তত্ত¡ গঠন করা হয় এবং এর মাধ্যমে জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধির সাথে সাথে জ্ঞানের নতুন শাখার সৃষ্টি হয়।

 

সামাজিক গবেষণার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য

সমাজ এবং সামাজিক ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান যোগ করার একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো সামাজিক গবেষণা। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এবং দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে এই গবেষণাকে অর্থপূর্ণ করা যায়। গবেষণার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং পদ্ধতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত অন্যান্য বিষয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের এই বৃদ্ধি করা যায়। তাই সামাজিক গবেষণা কতিপয় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত করা হয়ে থাকে। যেমন-

১. জ্ঞানের বিকাশঃ আমরা আগেই দেখেছি, গবেষণা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের একটি প্রক্রিয়া। একইভাবে সামাজিক গবেষণা হল একটি সংগঠিত এবং বৈজ্ঞানিক প্রয়াস যাতে প্রশ্নে থাকা সমস্যা সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করা যায়। এইভাবে সামাজিক বিজ্ঞান আমাদের সামাজিক ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান পেতে এবং যোগ করতে সাহায্য করে। এটি সামাজিক গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।

২. সামাজিক জীবনের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নঃ মানুষ সমাজের একটি অংশ। তাই সামাজিক গবেষণায় মানুষকে একজন ব্যক্তি হিসাবে, মানুষের আচরণ অধ্যয়ন করে এবং মানুষের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং এই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে। একবার আইন প্রণয়ন করা হলে, তারপর বৈজ্ঞানিক অধ্যয় এই তথ্যগুলির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে। সুতরাং, সামাজিক জীবনের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন হল সমাজতাত্তি¡ক বিকাশের ভিত্তি যা সামাজিক গবেষণার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হিসাবে বিবেচিত হয়।

৩. মানবতার কল্যাণঃ সামাজিক বিজ্ঞান অধ্যয়নের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য প্রায়শই মানবতার কল্যাণ বৃদ্ধি করা। কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুধুমাত্র অধ্যয়নের জন্য করে না। মানবতার কল্যাণ সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার সবচেয়ে সাধারণ উদ্দেশ্য।

৪. তথ্যের শ্রেণীবিভাগঃ P. V. Young -এর মতে, সামাজিক গবেষণার লক্ষ্য হল ঘটনাগুলোকে স্পষ্ট করা। যে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তথ্যের শ্রেণীবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং ভবিষ্যদ্বাণীঃ অনেক গবেষণা কার্যক্রমের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট অবস্থার অধীনে নির্দিষ্ট ধরণের ব্যক্তির আচরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা। সামাজিক গবেষণায় সাধারণত সামাজিক ঘটনা, ঘটনা এবং সেগুলোকে পরিচালনা করে এবং নির্দেশিত কারণগুলো অধ্যয়ন করা।

 

সামাজিক গবেষণার বৈশিষ্ট্য সমূহ

যে কোন গবেষণারই কিছু না কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। সামাজিক গবেষণাও এর ব্যতিক্রম নয়। সামাজিক গবেষণা প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে রয়েছে-

১. নির্ভুলতাঃ নির্ভুলতা একটি গবেষণার জন্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা। একজন গবেষকের গবেষণা সমস্যাযুক্ত পরিস্থিতিতে সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট হতে হবে। যেমন- কেউ বললো যে গ্রামীণ এলাকায় নিরক্ষরতা বা সাক্ষরতার হার ১০০%। এই বিবৃতিটি অবৈধ এবং গ্রামীণ এলাকার জন্য সঠিক নয়। এর পরিবর্তে তার বলা উচিত যে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ৫০%, ৬০% বা ৮০% নিরক্ষর। যা সকলের গ্রহণযোগ্য হবে।

২. যাচাইযোগ্যতাঃ গবেষণার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল গবেষককে অবশ্যই তথ্য যাচাই করতে হবে। গবেষণাটি অবশ্যই যাচাইযোগ্যতা এবং পরীক্ষাযোগ্যতার বিষয় হতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নিরক্ষরতার কারণে জনগণের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি। এই প্রস্তাবটি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবে বিবেচিত হবে কারণ এটি পর্যবেক্ষণ করে যাচাই করা যায় যে, অশিক্ষিতদের তুলনায় শিক্ষিতদের মধ্যে অপরাধীদের পরিমাণ কম।

৩. তথ্য প্রমাণঃ গবেষণার জ্ঞান সত্য তথ্য বা শ্রবণের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। গবেষণায় অবশ্যই সকল কিছুর তথ্য ও প্রমাণ থাকতে হবে।

৪. বস্তুনিষ্ঠতাঃ বস্তুনিষ্ঠতা মানে বাস্তবতাকে গবেষণায় দেখাতে হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অবশ্যই তার আসল জিনিস থাকতে হবে এবং এটি অবশ্যই নিজের বা ব্যক্তিগত পক্ষপাত, কুসংস্কার, পছন্দ এবং অপছন্দের অনুভূতি ইত্যাদি থেকে পরিষ্কার হতে হবে।

৫. নির্ভরযোগ্যতা এবং বৈধতাঃ গবেষণা অধ্যয়ন অনেকাংশে সত্য এবং বৈধ হতে হবে। কোন বাহ্যিক তথ্য বা স্ব-সৃষ্ট বস্তু একটি গবেষণা অধ্যয়নে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। নির্ভরযোগ্য এবং বৈধ তথ্য দিয়ে গবেষণা ত্রæটি মুক্ত করা দরকার।

৬. যোগ্যতাঃ যোগ্যতা একজন গবেষকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা। যখন গবেষক যোগ্য এবং বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে ভালভাবে জানেন তখনই একটি সমস্যাযুক্ত পরিস্থিতির সম্পূর্ণ অধ্যয়ন সম্ভব।

৭. রেকর্ডিং এবং রিপোর্টিংঃ গবেষণায় প্রতিটি শব্দ সংজ্ঞায়িত করা উচিত এবং স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত। পদ্ধতিটি অবশ্যই বিশদভাবে বর্ণনা করতে হবে এবং পরিস্থিতি স্পষ্ট করার জন্য গবেষক দ্বারা প্রতিবেদনটি লিখতে হবে।

৮. মূল কাজঃ সামাজিক গবেষণা ডুপ্লিকেট বা অনুলিপি করা তথ্য থেকে পরিষ্কার। এটির মূল কাজ থাকতে হবে অন্যের দ্বারা করা কাজের উপর নয়। প্রকৃতপক্ষে গবেষণা শুরু হয় বিন্দু থেকে যখন ইতিমধ্যে বিদ্যমান জ্ঞান শেষ হয়। গবেষণায় একটি পয়েন্টের উপর ফোকাস করা আবশ্যক, এর মানে হল যে গবেষণা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ এবং একটি নির্দিষ্ট সমস্যা বিদ্যমান।


সামাজিক গবেষণার ধারণা, সামাজিক গবেষণার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং সামাজিক গবেষণার বৈশিষ্ট্য সমূহ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:

Post a Comment