Wednesday, May 31, 2023

গবেষণায় নৈতিকতার ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

গবেষণায় নৈতিকতা

প্রতিটি কাজেই নৈতিকতার একটা দিক রয়েছে এই নৈতিকতা কোন আইন নয়, তবে মানুষ এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নৈতিকতা মানুষের সংস্কৃতির সাথে যুক্ত অনৈতিক কোন কিছুই সমাজ ভালো চোখে দেখে না গবেষণার ক্ষেত্রে নৈতিকতা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিকতা হলো ব্যক্তিগত কতিপয় আচারণ পদ্ধতি/বিধি যা নিজের, অন্যদের এবং সমাজের পারিপার্শিকতার প্রতি শ্রদ্ধা ভিত্তি করে গড়ে উঠে গবেষণায় নৈতিকতা গড়ে উঠে গবেষণা কার্যক্রমের কতিপয় মৌলিক নৈতিক নীতিমালার ভিত্তিতে, যার মধ্যে রয়েছে- গবেষণার নকশা এবং বাস্তবায়ন, সমাজ এবং অন্যদের প্রতি সম্মান, সম্পদের ব্যবহার এবং গবেষণার ফলাফল, বৈজ্ঞানিক অসদাচারণ এবং গবেষণার নিয়ন্ত্রণ

মোটকথা, নৈতিকতা হলো কোন কাজটি করা উচিত এবং কোনটি করা উচিত নয় তা খুঁজে বের করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা গবেষণায় কোন ভাবেই যেন উদারতার নীতি, উদারতার গোপনীয়তা ক্ষুন্ন না হয় তা রক্ষা করা হলো গবেষণার নৈতিকতা


গবেষণায় নৈতিকতার নীতি সমূহ

একটি গবেষণায় অনুসৃত নৈতিকতার নীতিমালার মধ্যে রয়েছে-

সততাঃ গবেষণা কর্মের জন্য গবেষক অবশ্যই সততার সাথে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই, ফলাফল বিশ্লেষণ করবেন

নৈর্ব্যক্তিকতাঃ গবেষককে তার গবেষণার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পিয়ার পর্যলোচনা, বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য দিকগুলোতে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবেন না

৩. অখন্ডতাঃ গবেষককে অবশ্যই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে এবং আন্তরিকতার সাথে চিন্তা, কাজ কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে

সাবধানতাঃ গবেষণা কর্মে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কোন ধরনের গাফলতি অবহেলা করবেন না

অকপটতাঃ গবেষককে অবশ্যই উদার মনের হতে হবে সংকীর্ণ মন নিয়ে সঠিক গবেষণা হয় না

৬. বুদ্ধিভিত্তিক সম্পত্তির প্রতি শ্রদ্ধাঃ কোন গবেষকের অনুমতি ব্যতীত তার কোন অপ্রকাশিত উপাত্ত, পদ্ধতি ফলাফল ব্যবহার করা যাবে না

৭. গোপনীয়তাঃ গবেষককে অবশ্যই নিজের এবং অপরের গোপনীয়তাকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে

দায়িত্বশীল প্রকাশনাঃ গবেষক শুধু নিজের নয়, অন্যের সঙ্গেও মিলে যায় এমন অংশ এড়িয়ে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে অন্যের গবেষণাকে সম্মান জানাবেন

সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধাশীলঃ গবেষককে তার অন্যান্য সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধশীল হতে হবে

১০দায়িত্বশীল রক্ষণাবেক্ষণঃ গবেষক কেবল নিজের প্রতি নয়, অন্যদের প্রতিও দায়িত্বশীল হবেন তাদের প্রতি পরামর্শ প্রদান, অন্যদের সমাজের কল্যাণে কাজ করবেন

১১. সামাজিক দায়িত্বশীলতাঃ সামাজিক মূল্যবৃদ্ধি, সামাজিক কল্যাণ সাধন করার জন্য কাজ করাও গবেষণার নৈতিকতার অর্ন্তভুক্ত

১২আইনের প্রতি শ্রদ্ধাঃ গবেষককে সরকারি, বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক আইন মেনে চলা কর্তব্য

১৩মানবিক বিষয় সংরক্ষণঃ মানবিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সময় গবেষক ব্যক্তির মর্যাদা, গোপনীয়তা এবং স্বকীয়তাকে সম্মান করবেন

১৪কর্মদক্ষতাঃ গবেষক তার কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণায় নীতি নৈতিকতা মান্য করে চলবেন

১৫. বৈষম্যহীনতাঃ গবেষণা করতে গিয়ে গবেষক কোন ভাবেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ দ্বারা পরিচালিত হবেন না এক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করবেন


গবেষণায় পালনীয় নীতিমালা

গবেষণা ক্ষেত্রে যে সকল নৈতিকতার কথা বলা হয়েছে তাছাড়াও আরো কতিপয় নীতিমালা অনুসরন করতে হয় কেননা, গবেষণায় সার্বজনীন বলে তেমন কিছু নেই গবেষণায় অনুসৃত নীতিমালা সম্পর্কে জড়মবৎ . ডরহসবৎ এবং ঔড়ংবঢ়য . উড়সরপশ তাদের ডযধঃ রং ঊঃযরপং রহ জবংবধৎপয ধহফ ডযু রং রঃ ওসঢ়ড়ৎঃধহঃ লেখায় তিন ধরনের নীতিমালার কথা বলেছেন-

স্ব-নির্ধারণঃ গবেষক কোন বিষয়ে কাউকে কোন কিছু করতে বাধ্য করতে পারে না ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কাজ করবেন ব্যক্তির অধিকার, মূল্যবোধ, সিদ্ধান্ত, সংস্কৃতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া গবেষকের কর্তব্য

প্রযুক্তিগত তত্ত্বের ভারসাম্যঃ তত্ত অনুযায়ী ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে নৈতিকতার বিষয়টি বিবেচ্য সর্বোচ্চ লাভের জন্য সর্বনিন্ম ক্ষতির বিষয়টি ছাড় দেয়া যেতে পারে

আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আসলে কোন ধরনের নৈতিকতার কোন আদর্শ রুপ নেই তাই একজনের কাছে যা নৈতিক, অপরের কাছে তা নৈতিক মনে নাও হতে পারে তাই কোন বিষয় বিবেচনার সময় তা আমাদের পরিবেশ সংস্কৃতির সাথে যায় কিনা তা বিবেচনা করতে হবে

এছাড়াও গবেষণার ক্ষেত্রে পালনীয় কতিপয় নীতিমালা হলো-

গবেষণায় ইচ্ছাকৃতভাবে কারো কোন ক্ষতি না করতে সচেষ্ট থাকা

যাদের নিয়ে গবেষণা করা হয় তাদের মঙ্গল সাধনে সচেষ্ট থাকতে হবে কোন ভাবেই তাদের বঞ্চিত করা যাবে না

ব্যক্তির সকল ধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করে তার প্রতি সঠিক আচরণ করতে হবে

৪. গবেষণার সর্বক্ষেত্রে সর্তক থাকতে হবে অসর্তকতার কারনে যেন কোন ধরনের ভুল না হয় সেদিকে খেয়ার রাখতে হবে

ব্যক্তির সম্মতিতে গবেষণা করতে হবে কোনভাবেই তাকে বাধ্য করা যাবে না

৬. গবেষণায় অংশগ্রহনকারীদের কাছে গবেষণার উদ্দেশ্য, প্রকৃতি বলতে হবে কোনভাবে সত্যকে লুকানো যাবে না


গবেষণায় অসদাচরণ

গবেষণায় অসদাচরণ হলো গবেষণার নৈতিকতা না মেনে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করা গবেষণায় অসদাচরণের মধ্যে রয়েছে-

১. জাল তথ্য উপস্থাপনঃ কোন গবেষণাকর্মে গবেষক যখন মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন বা মনগড়া ফলাফল তৈরি করে কিংবা ভুল প্রতিবেদন তৈরি করে উপস্থাপন করেন তা গবেষণায় অসদাচরণের মধ্যে ধরা হয়

. চৌর্যবৃত্তিঃ গবেষণাকর্মে যখন অন্যের ধারণা, পদ্ধতি বা ফলাফল হুবহু বা লাইলের পর লাইন তুলে দেয়া হয় কোন ধরনের তথ্যসূত্র দেয়া ছাড়া নিজের বলে জমা দেয় তখন গবেষক চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত হবেন এই ধরনের কার্য গবেষণার অসদাচরণ তাই থেকে বিরত থাকতে হবে

মিথ্যা বক্তব্যঃ গবেষণায় সংগৃহীত তথ্য কোন ধরনের যাচাই-বাছাই না করে কিংবা সংগৃহীত তথ্যের সঠিক ফলাফল উল্লেখ না করে, ফলাফল হেরফের করে বা পরিবর্তন করে গবেষণাটি উপস্থাপন করে তখন এটি মিথ্যা বক্তব্য বলে গণ্য হয় এবং এটি গবেষণায় একটি অসদাচরণ

মোটকথা, সামাজিক গবেষণায় গবেষকের নিজস্ব আদর্শ, চিন্তা-ভাবনা, মতামত থাকতে পারে তবে তা কখনোই সংগৃহীত তথ্যের ফলাফলের উপর প্রভাব বিস্তার করতে দেয়া যাবে না সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণে যে ফলাফল পাওয়া যাবে তাই প্রকাশ করতে গবেষককে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং এখানেই গবেষণার নৈতিকতা বিষয়টি দৃঢ়ভাবে মানতে হবে

 

সহায়ক গ্রন্থ

1.       www.researchethics.ca, Research Ethics in the Social Science and Humanities.

2.       www.libguides.library.cityu.edu.hk, Research Methods.

3.      www.stir.ac.uk, Understanding Ethics.

4.       www.nichs.nih.gov, What is Ethics in Research and Why is it Important.

5.      www.researchethics.ca, What is Research Ethics.

 

 

গবেষণায় নৈতিকতার ধারণা 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Friday, May 26, 2023

'নজরুলের পত্রাবলি' -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

লুকিয়ে লুকিয়ে কারো লেখা চিঠি পড়েছেন কি কেউ? কিংবা অন্যের চিঠি চুরি করে পড়ে দেখেছেন কি কেউ? উত্তর দেবার দরকার নেই, শুধু জানতে চেয়ে গেলাম। কারন এই চিঠিপত্র নিয়েই একটা বই "নজরুলের পত্রাবলি" নিয়ে কয়েকটা কথা বলার খাতিরে এই প্রশ্ন।

বিশ্ব-সাহিত্য ভুবনে পত্র-সাহিত্য বলে একটা কথা আছে। কিন্তু সকল পত্র সাহিত্য হয়, কোন কোন পত্র সাহিত্যের মর্যাদা পায়।যেমন পেয়েছে কিটস্ কিংবা রবীন্দ্রনাথ এর মতো লেখকদের পত্র সমূহ। পত্র সাহিত্যের মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের নাম অন্তর্ভুক্ত। তবে নজরুলের অন্যান্য সাহিত্য যতো বেশি জনপ্রিয় এবং পরিচিত, তার পত্র-সাহিত্য এতো বেশি পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। এটা হয়তো প্রকাশ এবং প্রচারের কারনে হতে পারে।

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস হিসাবে নজরুল 'বাঁধন-হারা' লিখেছেন, যা একটি পত্রোপন্যাস। তবে এই পত্রাবলি একটি পরিকল্পিত লেখা, যা সাধারণ পত্র থেকে আলাদা। বর্তমানে বই হিসাবে 'নজরুলের পত্রাবলি' হলো তার ব্যক্তি জীবনের সেই সকল পত্রের সমষ্টি যা তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাছের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, লেখালেখির জন্য যোগাযোগ করতে কিংবা অন্য কোন কারনে লিখেছিলেন। বইটিতে মোট চুরাশিটি পত্রের সংগ্রহ আছে, যা এখন পর্যন্ত পাওয়া সকল পত্রের সমষ্টি।

ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে পত্রের প্রচলন আর না থাকলেও পুরানো সেই দিনের পত্রগুলোর কদর এখনো সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে রয়েছে। এই পত্রগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তির একান্ত কথাগুলো প্রকাশ পায় যা তার অন্য লেখায় প্রকাশ পায় না। নজরুলের লেখা পত্রগুলোর মধ্যেও তার রস-বোধ, আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক ভাবনা, মানবতাবোধ ইত্যাদি অপূর্ব সুন্দর ও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এমনকি ভয়াবহ আর্থিক সংকটের বিষয়টিও সরস ভাবে উপস্থাপন করেছেন। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নজরুলে স্বাচ্ছন্দে বিচরণ ছিলো এবং সমান জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। তার লেখাপত্রগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
 
 

বইঃ নজরুলের পত্রাবলি
প্রকাশকঃ কবি নজরুল ইনস্টিটিউড
মূল্যঃ ১৭০ টাকা
 
'নজরুলের পত্রাবলি' -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Friday, May 19, 2023

আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' উপন্যাসের বয়ান -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম জাহিদ হাসান। জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের রিসার্চ এস্টিস্ট্যান্ট। থাকে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। তার একটা বর্তমান প্রেমিকা আছে। যার নাম আমরা জানতে পারি না কখনো। জাহিদ তার এক নতুন নাম দিয়েছে। সেটা হচ্ছে সোহিনী। সোহিনী রাগের নামে নাম। সোহিনী তার কাছে 'অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা, অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ, অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী'। সোহিনী কেনো সবকিছুতেই অর্ধেক সেই দর্শনের রহস্য সমাধান করা যায় পুরো বইয়ে। সমাধান আসলে সম্ভবও ছিলো না।

উপন্যাসের শুরুটা সোহিনীকে চিঠি দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হলেও, জাহিদ তার অতীত জীবনের দুইজন নারীর স্মৃতিচারণই করেছে। যারা প্রেয়সী হিসাবে এসেছিলো তার জীবনে। তবে, জাহিদকে কেন্দ্র করে তারা আবর্তিত হয়নি। বরং দুইজনই এতোই প্রখরা ছিলো যে, জাহিদই বরং আবর্তিত হয়েছে তাদেরকে কেন্দ্র করে। সেই দুই নারী তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। তাদের গল্পই জাহিদ চিঠির মাধ্যমে শুনিয়েছে তার বর্তমান প্রেমিকা সোহিনীকে।

প্রথম যে নারীর কথা জাহিদ শোনায়, তার নাম দুরদানা আফরাসিয়াব। লোকে তাকে দুরন্ত থান্ডার বলে ডাকতো। নাখালপাড়া থেকে সাইকেল চালিয়ে আর্ট ইনস্টিটিউটে আসতো। পরনে থাকতো শার্ট-প্যান্ট। সেটা ষাটের দশকের শেষের দিকের ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই রাস্তার পাশের লোকেরা তার দিকে অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ে দিতো, অশালীন মন্তব্য করতো। দুরদানাও কম যায় না। সাইকেল থেকে নেমে ওইসব ইতর বদমায়েশদের পেটাতোও সে। এক সময় নিজের নিরাপত্তার জন্য পকেটে চাকু রাখাও শুরু করে।


দুরদানার সাথে জাহিদের যখন প্রথম দেখা হয়, জাহিদ খেয়াল করে দেখে যে দুরদানার চুল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। শার্টটা প্যান্টের ভিতরে গোঁজা। গলায় মেশিনগানের গুলির খোসা দিয়ে তৈরি হার। দুরদানার এই বেশভূষা এবং চালচলন দেখে ভ্যাবচাকা খেয়ে যায় জাহিদ। একই সাথে এই নারীর পুরুষালী আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের প্রেমেও পড়ে সে। তীব্র এক আকর্ষণের জালে আটকা পড়ে যায় সে।

দুরদানার সাথে জাহিদের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহ্য করেও দুরদানার সাইকেলের পিছনে বসে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায় জাহিদ। দুরদানাও মাঝে মধ্যে জাহিদের হোস্টেলে আসে। দুরদানার ভাই ইউনুস জোয়ারদার চরমপন্থি রাজনীতি করে, সেটার জানার পরেও দুরদানার সঙ্গ ছাড়তে পারে না জাহিদ।

দুরদানার সাথে জাহিদের প্রেমের সম্পর্কে ফাটল ধরে হঠাৎ করে। খুবই অদ্ভুত একটা কারণে। উয়ারি থেকে একদিন দু'জনে রিকশায় করে ফিরছিলো। প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিলো। দুজনের কাপড়-চোপড়ই ভিজে একাকার। রিকশায় এক সাথে বসে থাকতে থাকতে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয় তারা। দুরদানার কাঁধে হাত রাখে জাহিদ, মাথার ভিজে চুলের ঘ্রাণ নেয়। এক সময় বুকেও হাত দেয়, দুরদানার স্তন নিয়ে খেলা করে সে। ওই রকম রোম্যান্টিক সময়ে দুরদানা জানায় যে তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে, ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে।

যে অ-মেয়েমানুষ এতদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো জাহিদকে, হঠাৎ করে তার মেয়েমানুষী পরিচয় বের হয়ে আসতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে জাহিদ। একেতো সে ভালবাসতে পারবে না কোনোদিন।

এই সম্পর্কের ইতি ঘটে ওইদিনই।

জাহিদের জীবনে এর পরে যে নারী আসে সে হচ্ছে কন্যা শামারোখ। অপূর্ব সুন্দরী এক বিদুষী নারী। করাচিতে লেখাপড়া করেছে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, কিন্তু কবিতা চর্চা করে বাংলাতে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসাবে কাজ করতো। সেই সময় এক সিএসপি অফিসারের সাথে বিয়ে হয়। সেই সংসারে এক পুত্র সন্তানও ছিলো। কিন্তু, সেই সংসার ভেঙে দিয়ে পুত্রকে স্বামীর কাছে রেখেই বের হয়ে আসে শামারোখ।

একাত্তর সালে লন্ডনে ছিলো শামারোখ। স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কার্যকলাপে নিজকে জড়িয়ে ফেলে সে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও তখন লন্ডনে ছিলেন। বাংলাদেশের হয়ে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হবার পরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিয়োগ পান।

রাষ্ট্রপতির সাথে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হবার চেষ্টা চালায় শামারোখ। রাষ্ট্রপতির সুপারিশে এসোসিয়েট প্রফেসরের পদে নিয়োগপত্রও পায় সে। সমস্যা তৈরি করে বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম চৌধুরী। শামারোখের মতো একজন নারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেলে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস হবে, এই বক্তব্য দিয়ে তিনি এর বিরোধিতা করেন। একই সাথে হুমকি দেন যে শামারোখ জয়েন করলে তিনিসহ বিভাগের সকল শিক্ষক পদত্যাগ করবেন।

শামারোখের হয়ে শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে সুপারিশ করতে গিয়েছিলো জাহিদ। সেই সূত্র ধরে শামারোখের সাথে তার পরিচয় ঘটে এবং অতি দ্রুতই তা ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। দুজনের মেলামেশাকে অবশ্য অনেকেই সহজভাবে নেয়নি। শামারোখের মতো একজন অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী জাহিদের মতো সাদামাটা একটা ছেলের সাথে ঘোরাফেরা করছে, এ নিয়ে অনেকেই ঈর্ষান্বিত ছিলো।

শামারোখ জাহিদকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও, জাহিদ শামারোখের ভালবাসার বিশ্বস্ততায় সবসময়ই সন্দিহান ছিলো। শুধু জাহিদ নয়, অসংখ্য পুরুষের সাথেই মেলামেশা করতো শামারোখ। তার আচার-আচরণ ছিলো রহস্যে ঘেরা এবং অ-অনুমেয়।

বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসা তরুণ কবি শাহরিয়ারের সাথেও সুগভীর এক প্রণয় সম্পর্ক গড়ে তোলে শামারোখ। শাহরিয়ার অবশ্য বেশিদিন বাঁচে না। শাহরিয়ারের মৃত্যুর পনেরো দিনের মাথাতেই শামারোখ আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলে। বিয়ের পরে সেই স্বামীকে নিয়ে আমেরিকাতে চলে যায় শামারোখ।

এ রকম একজন আনপ্রেডিক্টেবল নারী কাছে থেকে জাহিদ সরে আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে, এই উপাখ্যানেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো।

আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' কি উপন্যাস? নাকি বাস্তব জীবনের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আত্ম-জৈবনিক উপন্যাস? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটাই আসলে সঠিক। এই উপন্যাসে যে সমস্ত চরিত্রগুলো এসেছে, একটু খেয়াল করে দেখলেই দেখা যাবে সেগুলোর পিছনের বাস্তবের কেউ না কেউ রয়েছে। খুব সহজেই আসলে চরিত্রগুলোকে চিনে ফেলা যায়।

দুরদানার কথাই ধরা যাক। এই চরিত্রের সামান্য কিছু বর্ণনা শুনেই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় যে এই চরিত্রটা গড়ে উঠেছে ভাস্কর শামীম সিকদারকে কেন্দ্র করে। শামীম সিকদার স্বনামেই বহুল পরিচিত। তিনি সেই ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের দশকে খিলগাঁও থেকে সাইকেলে করে আর্ট ইনস্টিটিউটে যাতায়াত করতেন। পোশাক পরতেন পুরুষদের মতো করে। ওই সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীদের কেউ এই রকম সাহস দেখায়নি। এর উপরে তিনি সিরাজ সিকদারের বোন হিসাবেও আলোচনাতে থাকতেন সবসময়। প্রচলিত একটা গল্প আছে যে, সিরাজ সিকদার নিহত হবার পরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য শামীম সিকদার পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন। স্বাধীনচেতা একজন দুরন্ত দুঃসাহসী এবং দুর্দান্ত মেধাবী ভাস্কর হিসাবে তিনি জনমানসে পরিচিত ছিলেন।

শামীম সিকদারের সাথে আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো এটাও অনেকেই জানে। এমনকি ছফা তাঁর নিজের ডায়েরিতেও শামীম সিকদারের কথা লিখেছেন।

শামারোখ চরিত্রটাকে হয়তো সহজেই চিনবে না অনেকে। তবে, যারা বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন, কবি সুরাইয়া খানমকে চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই। অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসানের প্রেমিকা হিসাবেও অনেকেই তাঁকে জানেন।

আহমদ ছফা মারা যাবার পরে তাঁর ডায়েরিকে সংকলিত করে 'আহমদ ছফার ডায়েরি' নামে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে সুরাইয়া খানম সম্পর্কে আহমদ ছফা লিখেছেন,

“বেশ কদিন আগে শামীমের (শিকদার) মাধ্যমে সুরাইয়া খানমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। মহিলার নামে অজস্র অপবাদ। একশ' পুরুষের সঙ্গে নাকি তাঁর খাতির। এসব কথা এখন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এ জাতীয় খারাপ বলে কথিত মহিলাদের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ রয়েছে। হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারের চাঁদা তুলতে যেয়ে বাংলা একাডেমিতে এই অনুপম সুন্দর মহিলাকে দেখি। তাঁকে বোধহয় খোঁচা দিয়ে কথা বলেছিলাম। সে যাক, মহিলা দু' দু'বার শামীমসহ আমার এখানে এসেছিলেন।"

কবি সুরাইয়া খানম সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায় দু'টো বই থেকে। এর একটা হচ্ছে কবি নির্মলেন্দু গুণের 'রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫', আর অন্যটি হচ্ছে মোশতাক আহমদের লেখা 'ঝিনুক নীরবে সহো'। 'ঝিনুক নীরবে সহো' হচ্ছে কবি আবুল হাসানের জীবনীভিত্তিক ডকু-ফিকশন। ডকু-ফিকশন বলে, এর আসলে কতোটুকু সত্যি আর কতোটুকু কল্পনা সেটা বলা মুশকিল। লেখক নিজেও এ বিষয়ে সংশয় ছড়িয়েছেন এটা বলে যে, ‘লেখাটি কোনো বিশুদ্ধ গবেষণা নয়, মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখতে আনন্দ পেয়েছি। সে কারণে স্থান কাল পাত্রের কিছুটা বিচ্যুতি ঘটেছে।' এই বিচ্যুতি ঘটার পরেও আমি বলবো যে মোশতাক আহমদের বইটা যথেষ্ট ভালো একটা বই কবি আবুল হাসান বা সুরাইয়া খানমকে জানার জন্য। নির্মলেন্দু গুণের বইটার তো তুলনাই হয় না। কারণ, ওটা বিশুদ্ধ আত্মজীবনী। যদিও এটার মূল আলোচনা ছিলো ওই সময়কার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে তুলে আনা, কিন্তু একই সময়কালে অবস্থানের কারণে কবি আবুল হাসানের শেষ সময় এবং সেই সাথে সুরাইয়া খানম উঠে এসেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে।

‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' প্রেম-প্রণয় আর বিচ্ছেদের কাহিনি। কিন্তু, আহমদ ছফা রোমান্টিকতার মধ্যেও জুড়ে দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনকে। পাঠক শুধু তাই নিছক প্রেমের গল্পই শুনবে না, একই সাথে ডুব দেবে গভীর এক আত্মোপলব্ধির মাঝে। এখানেই লেখকের সার্থকতা।

বইঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
মূ্ল্যঃ ২৫০ টাকা।।

(রিভিউ করেছেন- ফরিদ আহমেদ। কানাডা প্রবাসী।)

Md. Helal Uddin