Friday, May 19, 2023

আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' উপন্যাসের বয়ান -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম জাহিদ হাসান। জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের রিসার্চ এস্টিস্ট্যান্ট। থাকে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। তার একটা বর্তমান প্রেমিকা আছে। যার নাম আমরা জানতে পারি না কখনো। জাহিদ তার এক নতুন নাম দিয়েছে। সেটা হচ্ছে সোহিনী। সোহিনী রাগের নামে নাম। সোহিনী তার কাছে 'অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা, অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ, অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী'। সোহিনী কেনো সবকিছুতেই অর্ধেক সেই দর্শনের রহস্য সমাধান করা যায় পুরো বইয়ে। সমাধান আসলে সম্ভবও ছিলো না।

উপন্যাসের শুরুটা সোহিনীকে চিঠি দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হলেও, জাহিদ তার অতীত জীবনের দুইজন নারীর স্মৃতিচারণই করেছে। যারা প্রেয়সী হিসাবে এসেছিলো তার জীবনে। তবে, জাহিদকে কেন্দ্র করে তারা আবর্তিত হয়নি। বরং দুইজনই এতোই প্রখরা ছিলো যে, জাহিদই বরং আবর্তিত হয়েছে তাদেরকে কেন্দ্র করে। সেই দুই নারী তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। তাদের গল্পই জাহিদ চিঠির মাধ্যমে শুনিয়েছে তার বর্তমান প্রেমিকা সোহিনীকে।

প্রথম যে নারীর কথা জাহিদ শোনায়, তার নাম দুরদানা আফরাসিয়াব। লোকে তাকে দুরন্ত থান্ডার বলে ডাকতো। নাখালপাড়া থেকে সাইকেল চালিয়ে আর্ট ইনস্টিটিউটে আসতো। পরনে থাকতো শার্ট-প্যান্ট। সেটা ষাটের দশকের শেষের দিকের ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই রাস্তার পাশের লোকেরা তার দিকে অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ে দিতো, অশালীন মন্তব্য করতো। দুরদানাও কম যায় না। সাইকেল থেকে নেমে ওইসব ইতর বদমায়েশদের পেটাতোও সে। এক সময় নিজের নিরাপত্তার জন্য পকেটে চাকু রাখাও শুরু করে।


দুরদানার সাথে জাহিদের যখন প্রথম দেখা হয়, জাহিদ খেয়াল করে দেখে যে দুরদানার চুল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। শার্টটা প্যান্টের ভিতরে গোঁজা। গলায় মেশিনগানের গুলির খোসা দিয়ে তৈরি হার। দুরদানার এই বেশভূষা এবং চালচলন দেখে ভ্যাবচাকা খেয়ে যায় জাহিদ। একই সাথে এই নারীর পুরুষালী আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের প্রেমেও পড়ে সে। তীব্র এক আকর্ষণের জালে আটকা পড়ে যায় সে।

দুরদানার সাথে জাহিদের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহ্য করেও দুরদানার সাইকেলের পিছনে বসে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায় জাহিদ। দুরদানাও মাঝে মধ্যে জাহিদের হোস্টেলে আসে। দুরদানার ভাই ইউনুস জোয়ারদার চরমপন্থি রাজনীতি করে, সেটার জানার পরেও দুরদানার সঙ্গ ছাড়তে পারে না জাহিদ।

দুরদানার সাথে জাহিদের প্রেমের সম্পর্কে ফাটল ধরে হঠাৎ করে। খুবই অদ্ভুত একটা কারণে। উয়ারি থেকে একদিন দু'জনে রিকশায় করে ফিরছিলো। প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিলো। দুজনের কাপড়-চোপড়ই ভিজে একাকার। রিকশায় এক সাথে বসে থাকতে থাকতে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয় তারা। দুরদানার কাঁধে হাত রাখে জাহিদ, মাথার ভিজে চুলের ঘ্রাণ নেয়। এক সময় বুকেও হাত দেয়, দুরদানার স্তন নিয়ে খেলা করে সে। ওই রকম রোম্যান্টিক সময়ে দুরদানা জানায় যে তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে, ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে।

যে অ-মেয়েমানুষ এতদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো জাহিদকে, হঠাৎ করে তার মেয়েমানুষী পরিচয় বের হয়ে আসতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে জাহিদ। একেতো সে ভালবাসতে পারবে না কোনোদিন।

এই সম্পর্কের ইতি ঘটে ওইদিনই।

জাহিদের জীবনে এর পরে যে নারী আসে সে হচ্ছে কন্যা শামারোখ। অপূর্ব সুন্দরী এক বিদুষী নারী। করাচিতে লেখাপড়া করেছে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, কিন্তু কবিতা চর্চা করে বাংলাতে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসাবে কাজ করতো। সেই সময় এক সিএসপি অফিসারের সাথে বিয়ে হয়। সেই সংসারে এক পুত্র সন্তানও ছিলো। কিন্তু, সেই সংসার ভেঙে দিয়ে পুত্রকে স্বামীর কাছে রেখেই বের হয়ে আসে শামারোখ।

একাত্তর সালে লন্ডনে ছিলো শামারোখ। স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কার্যকলাপে নিজকে জড়িয়ে ফেলে সে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও তখন লন্ডনে ছিলেন। বাংলাদেশের হয়ে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হবার পরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিয়োগ পান।

রাষ্ট্রপতির সাথে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হবার চেষ্টা চালায় শামারোখ। রাষ্ট্রপতির সুপারিশে এসোসিয়েট প্রফেসরের পদে নিয়োগপত্রও পায় সে। সমস্যা তৈরি করে বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম চৌধুরী। শামারোখের মতো একজন নারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেলে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস হবে, এই বক্তব্য দিয়ে তিনি এর বিরোধিতা করেন। একই সাথে হুমকি দেন যে শামারোখ জয়েন করলে তিনিসহ বিভাগের সকল শিক্ষক পদত্যাগ করবেন।

শামারোখের হয়ে শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে সুপারিশ করতে গিয়েছিলো জাহিদ। সেই সূত্র ধরে শামারোখের সাথে তার পরিচয় ঘটে এবং অতি দ্রুতই তা ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। দুজনের মেলামেশাকে অবশ্য অনেকেই সহজভাবে নেয়নি। শামারোখের মতো একজন অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী জাহিদের মতো সাদামাটা একটা ছেলের সাথে ঘোরাফেরা করছে, এ নিয়ে অনেকেই ঈর্ষান্বিত ছিলো।

শামারোখ জাহিদকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও, জাহিদ শামারোখের ভালবাসার বিশ্বস্ততায় সবসময়ই সন্দিহান ছিলো। শুধু জাহিদ নয়, অসংখ্য পুরুষের সাথেই মেলামেশা করতো শামারোখ। তার আচার-আচরণ ছিলো রহস্যে ঘেরা এবং অ-অনুমেয়।

বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসা তরুণ কবি শাহরিয়ারের সাথেও সুগভীর এক প্রণয় সম্পর্ক গড়ে তোলে শামারোখ। শাহরিয়ার অবশ্য বেশিদিন বাঁচে না। শাহরিয়ারের মৃত্যুর পনেরো দিনের মাথাতেই শামারোখ আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলে। বিয়ের পরে সেই স্বামীকে নিয়ে আমেরিকাতে চলে যায় শামারোখ।

এ রকম একজন আনপ্রেডিক্টেবল নারী কাছে থেকে জাহিদ সরে আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে, এই উপাখ্যানেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো।

আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' কি উপন্যাস? নাকি বাস্তব জীবনের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আত্ম-জৈবনিক উপন্যাস? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটাই আসলে সঠিক। এই উপন্যাসে যে সমস্ত চরিত্রগুলো এসেছে, একটু খেয়াল করে দেখলেই দেখা যাবে সেগুলোর পিছনের বাস্তবের কেউ না কেউ রয়েছে। খুব সহজেই আসলে চরিত্রগুলোকে চিনে ফেলা যায়।

দুরদানার কথাই ধরা যাক। এই চরিত্রের সামান্য কিছু বর্ণনা শুনেই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় যে এই চরিত্রটা গড়ে উঠেছে ভাস্কর শামীম সিকদারকে কেন্দ্র করে। শামীম সিকদার স্বনামেই বহুল পরিচিত। তিনি সেই ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের দশকে খিলগাঁও থেকে সাইকেলে করে আর্ট ইনস্টিটিউটে যাতায়াত করতেন। পোশাক পরতেন পুরুষদের মতো করে। ওই সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীদের কেউ এই রকম সাহস দেখায়নি। এর উপরে তিনি সিরাজ সিকদারের বোন হিসাবেও আলোচনাতে থাকতেন সবসময়। প্রচলিত একটা গল্প আছে যে, সিরাজ সিকদার নিহত হবার পরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য শামীম সিকদার পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন। স্বাধীনচেতা একজন দুরন্ত দুঃসাহসী এবং দুর্দান্ত মেধাবী ভাস্কর হিসাবে তিনি জনমানসে পরিচিত ছিলেন।

শামীম সিকদারের সাথে আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো এটাও অনেকেই জানে। এমনকি ছফা তাঁর নিজের ডায়েরিতেও শামীম সিকদারের কথা লিখেছেন।

শামারোখ চরিত্রটাকে হয়তো সহজেই চিনবে না অনেকে। তবে, যারা বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন, কবি সুরাইয়া খানমকে চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই। অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসানের প্রেমিকা হিসাবেও অনেকেই তাঁকে জানেন।

আহমদ ছফা মারা যাবার পরে তাঁর ডায়েরিকে সংকলিত করে 'আহমদ ছফার ডায়েরি' নামে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে সুরাইয়া খানম সম্পর্কে আহমদ ছফা লিখেছেন,

“বেশ কদিন আগে শামীমের (শিকদার) মাধ্যমে সুরাইয়া খানমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। মহিলার নামে অজস্র অপবাদ। একশ' পুরুষের সঙ্গে নাকি তাঁর খাতির। এসব কথা এখন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এ জাতীয় খারাপ বলে কথিত মহিলাদের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ রয়েছে। হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারের চাঁদা তুলতে যেয়ে বাংলা একাডেমিতে এই অনুপম সুন্দর মহিলাকে দেখি। তাঁকে বোধহয় খোঁচা দিয়ে কথা বলেছিলাম। সে যাক, মহিলা দু' দু'বার শামীমসহ আমার এখানে এসেছিলেন।"

কবি সুরাইয়া খানম সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায় দু'টো বই থেকে। এর একটা হচ্ছে কবি নির্মলেন্দু গুণের 'রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫', আর অন্যটি হচ্ছে মোশতাক আহমদের লেখা 'ঝিনুক নীরবে সহো'। 'ঝিনুক নীরবে সহো' হচ্ছে কবি আবুল হাসানের জীবনীভিত্তিক ডকু-ফিকশন। ডকু-ফিকশন বলে, এর আসলে কতোটুকু সত্যি আর কতোটুকু কল্পনা সেটা বলা মুশকিল। লেখক নিজেও এ বিষয়ে সংশয় ছড়িয়েছেন এটা বলে যে, ‘লেখাটি কোনো বিশুদ্ধ গবেষণা নয়, মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখতে আনন্দ পেয়েছি। সে কারণে স্থান কাল পাত্রের কিছুটা বিচ্যুতি ঘটেছে।' এই বিচ্যুতি ঘটার পরেও আমি বলবো যে মোশতাক আহমদের বইটা যথেষ্ট ভালো একটা বই কবি আবুল হাসান বা সুরাইয়া খানমকে জানার জন্য। নির্মলেন্দু গুণের বইটার তো তুলনাই হয় না। কারণ, ওটা বিশুদ্ধ আত্মজীবনী। যদিও এটার মূল আলোচনা ছিলো ওই সময়কার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে তুলে আনা, কিন্তু একই সময়কালে অবস্থানের কারণে কবি আবুল হাসানের শেষ সময় এবং সেই সাথে সুরাইয়া খানম উঠে এসেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে।

‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' প্রেম-প্রণয় আর বিচ্ছেদের কাহিনি। কিন্তু, আহমদ ছফা রোমান্টিকতার মধ্যেও জুড়ে দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনকে। পাঠক শুধু তাই নিছক প্রেমের গল্পই শুনবে না, একই সাথে ডুব দেবে গভীর এক আত্মোপলব্ধির মাঝে। এখানেই লেখকের সার্থকতা।

বইঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
মূ্ল্যঃ ২৫০ টাকা।।

(রিভিউ করেছেন- ফরিদ আহমেদ। কানাডা প্রবাসী।)

Md. Helal Uddin

No comments:

Post a Comment