Friday, January 6, 2023

বিনাশ না হওয়া উপন্যাস 'ন হন্যতে' -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'ন হন্যতে'। হন্যতে অর্থ শরীর। ন হন্যতে অর্থ যার বিনাশ হয় না, যা অমর। এই উপন্যাসটি ছিল 'লা নুই বেঙ্গলী' উপন্যাসের প্রতিক্রিয়া থেকে লেখা।

অনেকেই বলেন, দুই যুগল প্রেমের উপন্যাসের মধ্যে কারো মির্চা এলিয়াদের 'লা নুই বেঙ্গলী' বেশি ভালো লেগেছে, আবার  কারো হয়তো মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' বেশি ভালো লেগেছে। আমি বলবো, ভিন্ন কথা। 

আমার দুটো উপন্যাসকেই ভালো লেগেছে। কারণ দুটি উপন্যাসই হলো একটি গল্পের এপিঠ আর ওপিঠ। আমি গল্পের সম্পুর্ণ অংশই দেখতে চাই, ভালো লাগার দৃষ্টিতেই শুধু নয়,জানার উপলব্ধি থেকে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, দু'জন লেখকই দুইভাবে পাঠকের সামনে এসেছেন দুই রকম ভালো লাগার পশরা সাজিয়ে।

যখন 'লা নুই বেঙ্গলী' পড়েছি, তখন মনে হয়েছে, লেখক একটা ছোট্ট শিশুর মতো করেই তার পাওয়া, না পাওয়ার আনন্দ- বেদনা ভরা আকুতির গল্প লিখে চলেছেন দ্বিধাহীনভাবে, কোন রাখঢাক না করে। এটিই ছিল 'লা নুই বেঙ্গলীর' সারল্য। এই সারল্যই আকৃষ্ট করেছে পাঠককে। আমার নিজস্ব উপলব্ধি হলো, মির্চা এলিয়াদের 'লা নুই বেঙ্গলী' বিদেশ বিভুঁইয়ে মাত্র তেইশ বছরের এক যুবকের অপরিপক্ক আবেগে লেখা,সদ্য ভেঙে পড়া প্রেমের কষ্ট, সাথে ভিন্ন দেশ আর ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির দেয়ালে মাথা খুঁটে একা একা কষ্ট বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা। সাথে আছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং ভারতীয়দের প্রতি তাদের অবহেলিত দৃষ্টিভঙ্গি।তবে মির্চা নিজেকে ভারতীয় বলেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।

অপরদিকে মৈত্রেয়ীর 'ন হন্যতে' সেদিক থেকে বেশ পরিণত। এই বইটি মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন তার জীবনের ষাটতম বসন্তে, হাতে ছিল পর্যাপ্ত রসদ,সেই সাথে মির্চার বইটি। মির্চার বইয়ে ফুটে উঠেছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি আর মৈত্রেয়ীর বইয়ে ফুটে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আর তার কাব্যিক আবহ। মৈত্রেয়ী বইয়ের একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তার কাব্যলাইন,যা উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। 

তবে 'লা নুই বেঙ্গলী' আর 'ন হন্যতে' এর মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। মির্চা তার বইটিতে ২৩ বছর বয়সে ঘটে যাওয়া ঘটনা লিখেছেন ২৬ বছর বয়সে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অপরদিকে মৈত্রেয়ী তার ১৬ বছরের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া একই ঘটনা বর্ণনা করেছেন ৬০ বছর বয়সে। এই বার্ধক্য বয়সে মৈত্রেয়ী দেবী 'ন হন্যতে' উপন্যাসে নিজেকে তার কৈশোরের চপলতায় হারিয়ে ফেলেছেন। একই সঙ্গে পাঠকও ১৬ বছরের মৈত্রেয়ী আর ২৩ বছরের যুবক মির্চা এলিয়াদের মাঝে  ডুব দিয়ে নিজেদের ফেলে আসা জীবনকেই যেন হাতড়ে ফেরেন। 

বলা যায়, মির্চার বইয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার এই বইটি লেখা। মৈত্রেয়ী বইটি লেখেছেন পরিপক্ক হাতে। বইটি লেখার পিছনে মির্চার প্রতি তার আবেগ যতটা কাজ করেছে, তার চেয়েও বেশি কাজ করেছে, মির্চা কেন তাকে মিথ্য কলঙ্ক দিল এই বিষম কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে।

এই বইটিতে মৈত্রেয়ী সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা, নারীর সামাজিক দুরবস্থা, বাঙালি সংস্কৃতি, ব্রিটিশ শাসনের নানা চিত্র কলমের ছোঁয়ায় তুলে এনেছেন।

মৈত্রেয়ী দেবী তার লেখায় আবহ, শব্দবুনন এবং কবিতার কারুকাজ দিয়ে বইটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। তিনি বইটিতে প্রাসঙ্গিক ঘটনায় রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার লাইন কোটেশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মূলত মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনে আলোকবর্তিকা ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল শ্রদ্ধা আর প্রেমপূর্ণ। মৈত্রেয়ী দেবীর লেখকসত্তা প্রস্ফুটিত করার অন্তরালের কুশীলব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 

১৯৩০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সকল কবিতা তার মুখস্থ ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল যার ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একই সাথে মৈত্রেয়ী গানও শিখত। আর এসবই সম্ভব হয়েছে মৈত্রেয়ীর বাবার সংস্কৃতিমনা মনোভাবের কারণে।

তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার একটি মফস্বল শহরের অধ্যাপক। এরপর কলকাতায় এসে মাত্র ছয় বছরে কলেজের দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে  কলকাতার পন্ডিত সমাজে বিশেষ জায়গা করে নেন স্বীয় পান্ডিত্যে। সংস্কৃতে পারদর্শী, প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী, শ্রুতিধর এবং দ্রুত বই পড়তে পারতেন।

তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির সাত-আট হাজার বই তিনি পড়ে ফেলেছেন। তিনি বেশ কিছু বইও লিখেছেন। দর্শন বিষয়ে পড়ার জন্য মৈত্রেয়ী পেয়েছেন একজন লিবারেল বাবার যুগোতীর্ণ সুচিন্তিত চিন্তা, তাইতো মৈত্রেয়ী সমকালীন দশটা নারীর তুলনায় ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে মাঠের সবুজে ধুয়েছেন পা।

মির্চাকে যেদিন তাদের বাসায় থাকার জন্য আনা হলো সেদিন মৈত্রেয়ী আপত্তি করেছিল, একজন ইংরেজকে তাদের বাড়িতে রাখার জন্য। যদিও মির্চা ইংরেজ নয়, বরং ইউরোপের একটি ছোট দেশ থেকে এসেছে। মেয়ের এমন মানসিকতার জন্য বাবা তাকে 'ন্যাশনালিজম' নামে একটি প্রবন্ধের বই পড়তে দেন এবং বলেন, "এমন একদিন আসবে যেদিন 'প্যাট্রিয়িটিজম' মানেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। মৈত্রেয়ীর বাবার এই কথার সাথে সাদাত হোসেন মান্টোর সীমানা প্রাচীরহীন পৃথিবীর স্বপ্নের মিল রয়েছে।  

তিনি বাবা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তার মেয়ে চেষ্টা করলে একদিন 'সরোজিনী নাইডু' হবে। কতটা স্বপ্নচারী হলে মানুষ মেয়েকে নিয়ে এমন দুর্লভ স্বপ্ন দেখতে পারেন, মৈত্রেয়ীর বাবার প্রতি অপার মুগ্ধতা কাজ করেছে আমার।  যদিও শেষের দিকে এই বাবার পরিবর্তন হয়েছিল একটি বিশেষ দোষে।

মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা তৎকালীন সমাজকে উপেক্ষা করে বাসায় রেখেছিলেন তার ভীষণ প্রিয় একজন ছাত্রকে যার নাম মির্চা এলিয়াদ। মির্চা ছিল একজন বিদেশী শেতাঙ্গ। মৈত্রেয়ীর বাবা ভেবেছিলেন, মির্চার সংস্পর্শে মৈত্রেয়ী ইউরোপিয়ান কালচার এবং ভাষা শিখতে পারবে। কারণ তত দিনে মৈত্রেয়ীদের বাড়িতে প্রায়ই বিদেশিরা আসত। তাদের পুরনো সংস্কার ছেড়ে তারা যেন ক্রমশ আরো সংস্কারমুক্ত হয়ে উঠছিল। কারণ মৈত্রেয়ীর বাবা এসব সংস্কার মানতেন না। 

মৈত্রেীর মা সংস্কার না মানলেও চিরায়ত স্বামীভক্ত বাঙালি নারী ছিলেন। স্বামীর এমন বিদ্বান হয়ে ওঠার পিছনে তার সেবা-যত্নের বিশেষ অবদান ছিল। 

বইটির মূলবক্তব্য হলো,মির্চার সাথে মৈত্রেয়ীর প্রেম। দুই দেশের, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির,দু'জন শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ অল্পবয়সী নর-নারীর ব্যর্থ প্রেমের পরিণতি হলো দুটি বিখ্যাত উপন্যাস লা নুই বেঙ্গলী এবং ন হন্যতে। এই উপন্যাসে মৈত্রেয়ীর নাম 'অমৃতা' এবং মির্চার নাম 'মির্চা ইউক্লিড'।

যদিও মৈত্রেয়ীর পরিবার আধুনিক এবং সংস্কারমুক্ত, তারপরও তারা এই সম্পর্ক মেনে নেননি। কারণ মির্চার সংস্কৃতি আর মৈত্রেয়ীর সংস্কৃতি আলাদা। মির্চার সংস্কৃতিতে বৈবাহিক জীবনের পরও একাধিক অবৈধ সম্পর্কে জড়ানোর সুযোগ আছে। যা ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে বড্ড বেমানান। বলা যায় এই একটি কারণেই মির্চা পরিত্যক্ত হয়। অথচ মৈত্রেয়ীর বাবা মা কিন্তু বিদেশির সাথে মেয়ে বিয়ে দিলে সমাজ নিন্দা করবে এমন ভয়ে ভীত নয়। ব্যাপারটা হয়তো এমন, তখনও তারা এতটা আধুনিক হতে পারেনি। অথবা মেয়েকে তারা এমন সংস্কৃতির লোকের সাথে বিয়ে দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। যেখানে ব্যক্তি মির্চার গুণে তারা মুগ্ধ ছিল।

মেত্রেয়ীর একটি কথা মনে পড়লো, বইয়ের একটা জায়গায় তিনি লিখেছেন, "আমরা হলাম পর্দাছাড়া পর্দানশীন।" অর্থাৎ বাবার  বিদেশি ছাত্রের সাথে মেশার সুযোগ পেলেও দেশি ছাত্রদের সাথে তেমন কথা বলা হতো না। তবে মৈত্রেয়ী যত সহজে বিদেশি হওয়ায় মির্চার সাথে মিশত পারত, নিজ দেশের ছেলেদের বেলায় সে ছিল ততটাই আড়ষ্ট।

উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ একটি বিশাল জায়গা জুড়ে আছেন। তার কৈশোরের আবেগ, শ্রদ্ধার সবটুকু জায়গা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। তাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। তারমধ্যে কয়েকটি স্মৃতি জেনে আমার ভালো লেগেছে। সেই সময়ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিন্দা-মন্দ হতো। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন দিয়েছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে।

ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত সমাজে নাচ ছিল অকল্পনীয়।  রবীন্দ্রনাথ এই অচলায়তন ভাঙলেন, ' নটীর পূজা '

মঞ্চস্থ করে। তিনি দেখালেন, 'একজন নটী তার নাচের মাধ্যমে তার পূজা নিবেদন করতে পারেন।' সমাজ তোলপাড় হলো, রবীন্দ্রনাথকে কিছুদিন খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হলো। এভাবে সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজকে বদলে দেবার প্রবল ইচ্ছে বাস্তবায়নে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসম সাহসী।

রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তি নিকেতনে আলো জ্বালাচ্ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছিল মৈত্রেয়ী। সে প্রায়ই শান্তি নিকেতনে যেত। রবীন্দ্রনাথ তার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হতেন। মৈত্রেয়ী দেবীর মনে তখন একটি সূর্য,আর সে সূর্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একটি ষোল বছরের মেয়ে তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল, সে তাঁর আলোয় নিজের জগতে পথ চলে। এমনকি তার বাবা যখন রবীন্দ্রনাথের নতুন প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সমালোচনা করতেন, তখনও কষ্ট পেত সে। আর তাই মির্চা এই বৃদ্ধ লোকটাকে ঈর্ষা করত খুব। দু'জনের মধ্যে এ নিয়ে বেশ রাগ-অনুরাগ চলত। যদিও একটি মজার তথ্য আছে বইয়ে,মৈত্রেয়ীর প্রথম প্রেম ছিল একটি ছাতিম গাছ। 

তবে মৈত্রেয়ী সময় ভালোই কাটছিল। মির্চা তাকে ভালোবাসে, এটা মৈত্রেয়ীর বোন ১১ বছর বয়সী ছোট্ট সাবি বুঝতে পারে। তার অভিযোগ, সবাই মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসে কিন্তু কেউ তাকে ভালোবাসে না। এমন ভাবনা থেকে একসময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, পাগলের মত আচরণ করে। তবে মির্চাকে ভীষণ পছন্দ করে। এরই মধ্যে মৈত্রেয়ীর বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

মৈত্রেয়ীর বাবা একটু সুস্থ হলেও তার বোন সাবি আর সুস্থ হয়ে ওঠে না। তবুও এই অবস্থায়ও  মৈত্রেয়ীর ষোলতম জন্মদিন বেশ ঘটা করে পালন করে বাবা। কলকাতার সব গণ্যমান্য গুণীজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। সেদিন সাবি দো'তলার বারান্দা থেকে লাফ দিতে ধরেছিল। মির্চা ওকে নিরস্ত করে। এভাবেই চলছিল। এরপর প্রায়ই তারা সাবিকে সাথে নিয়ে ওদের শেভরলে গাড়িতে করে বেড়াতে যেত আশপাশের  লেকের ধারে। একদিন মির্চা আর মৈত্রেয়ীর চুম্বন করা দেখে সাবি তার মাকে  বলে দেয়। 

ঐ দিনই তাদের প্রেমের আনুষ্ঠানিক যবনিকা শুরু। পরের দিন মির্চাকে এক ঘন্টার নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। মৈত্রেয়ীর মা একটা অজুহাত খুঁজছিলেন তাদের একত্র করার জন্য। সেজন্য তিনি বার বার বলছিলেন, তোমরা গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেছো কিনা। গান্ধর্ব মতে বিয়ে মানে হলো কন্যা স্বেচ্ছায় কোন বর পছন্দ করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেয়। মির্চার চলে যাবার দিন মৈত্রেয়ী অজ্ঞান হয়ে যায়। সেদিন তার বাবা মির্চার উপহার দেয়া তিনটি বইয়ের শুভেচ্ছাবার্তা লেখা পাতাগুলো ছিড়ে ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, তার বাবা বইপ্রেমী হবার কারণে বইগুলো ছিড়েন না। এই বিষয়টি তার বইয়ের প্রতি অনুরাগের প্রকাশ।

এরপর মির্চাকে চিঠি লিখে মৈত্রেয়ীর বাবা যোগাযোগ করতে বন্ধ করে। মৈত্রেয়ী বিভিন্নভাবে তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু মির্চা নিজেই আর যোগাযোগ করে না। হয়তো মৈত্রেয়ীর বাবার কঠোর নিষেধ এর কারণ হতে পারে। তারপরও খোকার কাছে লেখা কিছু চিঠি ৪৫ বছর পর মৈত্রেয়ী সংগ্রহ করে যেগুলো মির্চা মৈত্রেয়ীকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিল। খোকা হলো মৈত্রেয়ীর বাসার কাজের ছেলে।

আর ওদিকে মৈত্রেয়ী তখনও আইনে বাধা। সে মির্চার কাছে চলে এলেও প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তাকে জোর করে নিয়ে যাবার আইনগত অধিকার তার বাবার আছে। এই কারণে মৈত্রেয়ী আর বাসা থেকে চলে যাবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। তবে তারা তাদের এই বাড়িটা ছেড়ে দেয়,কারণ প্রতিবেশীরা এই ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করছিল। 

সে খুব চেয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকে বলে এই সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু কবিগুরুকে তার বাবা কোনোভাবে কষ্ট দিক, অপমান করুক তা মৈত্রেয়ী চায়নি। তবে কবিগুরুর দেয়া মূল্যবান উপদেশে মৈত্রেয়ী সান্ত্বনা খোঁজে। পরবর্তীতে মৈত্রেয়ী পড়াশোনা শুরু করে আবার। 

এরই মধ্যে মৈত্রেয়ীর মায়ের সংসারে ভাঙন ধরে। তার বাবা এক নারীকে দ্বিতীয় বিয়ে করে। কন্যা মৈত্রেয়ীকে নিয়ে সরোজিনী নাইডু হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাবা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। মৈত্রেয়ী লেখাপড়ায় তার কোন আগ্রহ নেই। মৈত্রেয়ী এই বন্দীখানা থেকে মুক্তি পেতে যেন বিয়ের পথ বেছে নেয়। মুক্তি সে পায়। তার স্বামী ছিলেন আপাদমস্তক একজন নিপাট ভদ্রলোক । তিনি মৈত্রেয়ীর লেখালেখির জগতে কোন হস্তক্ষেপ করেননি। বরং সাপোর্ট দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমার বেগম রোকেয়ার কথা মনে হয়েছে, যদি তিনি সাখাওয়াত হোসেনের মত একজন সাপোর্টিভ লিবারেল জীবনসঙ্গী না পেতেন, তাহলে রোকেয়ার এমন লেখা হয়তো আমরা পেতাম না।

বিয়ের রাতে মৈত্রেয়ী মির্চাকে কল্পনা করে যে আবহ এঁকেছে, পাঠক মাত্রই বুকজুড়ে বিশাল শূণ্যতা অনুভব করবেন, মনে হবে কালের স্রোতে আপনি ১৯৩৩ সালে চলে গেছেন, আপনার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়বে দিখাদ অশ্রু, বুকের ভিতর চিনচিন করবে ব্যথা, হাহাকার করবে অতৃপ্ত হৃদয়, মুহুর্তের মধ্যে মিশে যাবেন মির্চা আর মৈত্রেয়ী অনুভূতিতে।

বিয়ের পর তিন বছর মৈত্রেয়ী স্বামীর কর্মস্থল পাহাড়ি এলাকায় ছিল। সেই সময় তিন বার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে গিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই তার লেখালেখির প্রতি আরো ভালোভাবে জড়িয়ে যাওয়া।

মৈত্রেয়ী এসময় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনটি প্রবন্ধ অনুবাদ করেন।

কবিগুরু মৈত্রেয়ীকে মানুষের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে বলেন। মৈত্রেয়ী পাঁচ বছর ধরে মহাভারত, দুই বছর ধরে উপনিষদ, ছয় বছর ধরে মানব সভ্যতার ইতিহাস পড়াশোনা করেন। এরপর লিখতে শুরু করেন। রবীন্দরনাথকে নিয়েই তার পাঁচটি বই আছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শরনার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মৈত্রেয়ী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শরনার্থীদের সেবা করে আমাদের তিনি ঋনের বাঁধনে বেঁধেছেন। আটান্ন বছর বয়সে জানতে পারেন মির্চা তাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন যেখানে তিনি তার চরিত্রে কালিমা লেপন করেছেন। ষাট বছর বয়সে লিখতে বসেন 'ন হন্যতে'। সত্যিই তাদের এই বিরহে পাঠক পেয়েছে দুই বিখ্যাত যুগল উপন্যাস। এটা না ঘটলে হয়তো ভিন্নভাবে তাদের আমরা পেতে পারতাম।

জীবনের এই কঠিন সময়ে স্বামীকে পাশে পেয়েছেন, স্বামী তাকে উৎসাহ দিয়েছেন মির্চার সাথে দেখা করতে। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে মৈত্রেয়ী এবং তার জন্য ভালো কিছুই ঘটবে। এই জায়গায় মৈত্রেয়ীকে চিরাচরিত আবহমান বাঙালি নারী মনে হয়েছে। চরিত্রে কলঙ্কের দাগ যদি আসে সেটা প্রাণপণ মুছে পেলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। এই সমাজ হয়তো তাই চায়।

মৈত্রেয়ী মির্চার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কাজের সূত্রে তার ইউরোপ ভ্রমণের ডাক আসে। জীবনের এতটা বছর পর মৈত্রেয়ী দেখা করে মির্চার সাথে। সেই দেখা হবার দৃশ্য পাঠক হিসেবে আমার কল্পনায় ভেসে ওঠে। মৈত্রেয়ী বইয়ের সমুদ্র পার হয়ে মির্চার পড়ার ঘরে। আগে থেকেই জানতে পারা মির্চা পিছন ফিরে থাকে। মৈত্রেয়ীর মুখোমুখি হবার শক্তি তার নেই।

মৈত্রেয়ী জানতে চায়, "তোমার বইতে ও কী চরিত্র একেঁছ আমার, ওখানে তো আমাকে পেলাম না আমি।"

মির্চা বলে, "ফ্যান্টাসী,ফ্যান্টাসী, তোমাকে আমি রহস্যময়ী এক দেবী করতে চেয়েছিলাম যার কাজের কোন ব্যাখ্যা নেই। অঘনঘটনপটিয়সী দেবী কালির মতোই।"

মৈত্রেয়ী বাচ্চা মেয়ের মতো বলে ওঠে, "খবরদার আমাকে কালীর সঙ্গে তুলনা করবে না। চিরকাল তোমার এই,,,, আমি এত কি কালো?"

মির্চা তৎক্ষণাৎ। বলে, "আচ্ছা, আচ্ছা, দূর্গার মতো,যে অসম্ভব কাজ করতে পারে; এক হাতে অস্ত্র, অন্যহাতে বরাভয়।" 

জবাবে মৈত্রেয়ী বলে,"ফ্যান্টা‌সির সৌন্দর্য আছে,সত্যের সৌন্দর্য উজ্জ্বলতর, কিন্তু অর্ধসত্য ভয়ঙ্কর। তোমার বইটা তাই আমার কাছে বিভীষিকা।"

তাইতো 'লা নুই বেঙ্গলী' নিয়ে করা বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র 'The Bengali Nights' বন্ধের জন্য মৈত্রেয়ী মির্চা স্ত্রীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ঐ চলচ্চিত্র পরিচালকের নামে এক পর্যায়ে মামলা করেন। বন্ধ হয় চলচ্চিত্রটির প্রকাশ্য প্রদর্শনী। তবে সেটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।

এছাড়াও উপন্যাসটিতে তৎকালীন নারীদের দুরবস্থা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে,যা না বললেই নয়। এছাড়া ব্রিটিশ শাসনের নানান চিত্র এবং বৈষম্যও ফুটে  উঠেছে তার লেখায়। সত্যি বলতে, তাদের এই বিরহকাতর প্রেমে সাহিত্যের লাভ হয়েছে। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যে এই যুগল প্রেমের উপন্যাস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তাদের শেষ দেখার দৃশ্যটি একটি শোকার্ত আবহে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পাঠককে বহুকাল। ঘোর কাটবে না কিছুতেই। মনে হবে সমাজ সভ্যতার এই বৈষ্যমের নিচে যুগ যুগ ধরে চাপা পড়ে আছে কত কান্না, চাপা পরে আছেন হয়তো আপনিও।  মির্চা এবং মৈত্রেয়ী কেবলই তাদের প্রতিনিধিমাত্র। 

পারলৌকিক আশাবাদীরা এটুকু আশা করতেই পারে, কোন এক ছায়াপথে আবার তাদের দেখা হবে, ঘুচবে যুগান্তরের অচলায়তন, জাগবে ফের অনন্ত হৃদয়।


উপন্যাস: ন হন্যতে

লেখক: মৈত্রেয়ী দেবী

প্রাপ্তিস্থান : Uttara Book House, Dhaka.


Review by Jesmin Aktar 

                     18.07.2021

বিনাশ না হওয়া উপন্যাস 'ন হন্যতে'

মোঃ হেলাল উদ্দিন

No comments:

Post a Comment