Saturday, October 29, 2022
কল্লোল লাহিড়ী'র 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল' -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
Monday, October 24, 2022
গণতন্ত্র ঘাটতির বিশ্ববীক্ষণ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
“গণতন্ত্র-ঘাটতি বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে রাজনৈতিক আলাপচারিতার বই বরাবরই পছন্দের তালিকায় প্রথম। আর সেই আলোচনা যদি বর্তমান সময়ের রাজনীতি ও গণতন্ত্র কেন্দ্রিক তবে তার প্রতি আগ্রহ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। শান্তনু মজুমদার স্যারের লেখা বই 'গণতন্ত্র-ঘাটতি বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ' তেমনই একটা বই। বইটি মূলত স্যারের লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং কয়েকটি সাক্ষাতকারের সমষ্টি, যা বিগত দশকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। স্যারের লেখার এবং পড়ানোর একটা বৈশিষ্ট্য হলো যে কোন বিষয়ের আলোচনাকে প্রথমে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে, তারপরে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট, সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা করা, যা এই বইয়ের পাঠবিন্যাসেও ফুটে উঠেছে। বইটি প্রকাশ করেছে ‘সময় প্রকাশন’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ‘ধ্রুব এষ’। বইটির মূল্য ধার্য করা হয়েছে ৪০০ টাকা।
'গণতন্ত্র-ঘাটতি বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ' বইটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলতেই এই লেখার চেষ্টা। বইটি নিয়ে আলোচনার শুরুতে বইয়ের লেখক শান্তনু মজুমদার স্যার সম্পর্কে যা বলা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং তার গবেষণার আগ্রহের বিষয়ের মধ্য রয়েছে- গণতন্ত্র-ঘাটতি, রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ সম্পর্ক, রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা, আইডেনটিটি পলিটিক্স, ডিজিটাল ডিজইনফরমেশন এবং দক্ষিণ এশিয়া। তার গবেষণার এই বিষয়গুলোর আলোকেই বইয়ের প্রবন্ধগুলো। উল্লেখ্য, আমি বইয়ের লেখকের সরাসরি ছাত্র হওয়ায় লেখকের নামের পরে স্যার শব্দটি ব্যবহার করেছি।
'গণতন্ত্র-ঘাটতি বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ' বইটিতে মোট ৪৩টি প্রবন্ধ ও ৭টি সাক্ষাতকার রয়েছে যাকে চারটি অংশে ভাগ করে সাজানো হয়েছে। প্রথম অংশ ‘বিশ্ব’- এ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনীতি, ধর্মনীতি, আত্মপরিচয়, গণতন্ত্র, উগ্র জাতীয়তাবাদ এই রকম বিষয়গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছে। এর প্রতিটা লেখাই যেমন তথ্যবহুল, তেমনি নতুন চিন্তার খোরাক। এই অংশের ‘সর্বজনীন সবার্থে রাষ্ট্রের সামার্থ্য বাড়াতে হবে, 'সরকারপ্রধান ও দলীয়প্রধান পৃথককরণ প্রসঙ্গে', 'রক্ত দিয়ে চিন্তা ধুয়ে ফেলার মূর্খতা মিসরে', 'পার্পল স্টেটের গাড্ডায় ওবামা-রমনি', ‘জায়নবাদের বিরুদ্ধে কেন মুখ খুললেন গুন্টার গ্রাস’, ‘মোবারক থেকে মিলিটারি’ সহ অন্যান্য প্রবন্ধগুলোতে পশ্চিমা রাজনীতি, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনার সাথে সাথে আরব, মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলোর রাষ্ট্র, রাজনীতি, গণতন্ত্রের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে গত এক দশকের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সার্বিক একটা চিত্র পাওয়া যায়। যেমন- ‘ট্রাম্পবাজির দুনিয়া’ প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে ট্রাম্পের বিদ্বেষবাদ ও কর্তৃত্ববাদ এবং তিনি বিশ্বকে যেভাবে ‘আমরা’ এবং ‘অপর’ করে তুলে তা একটা শিল্পের রুপ দিয়েছে। প্রবন্ধটিতে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির ধরণ, আইডেনটিটি পলিটিক্স এর স্বরূপ ফুটে উঠেছে। গত দশকের মাঝামাঝি লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়ে জেরেমি করবিন লেবার পার্টি এবং ব্রিটেনের রাজনীতিতে একটা বড় পরিবির্তনের ধাক্কা দিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে ‘জেরিমি করবিনঃ মানবতার ফেরিওয়ালা’ প্রবন্ধটি লেখা। এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে ঐসময়ে ব্রিটেনের রাজনীতি, অভিবাসী প্রশ্নে তাদের অবস্থান, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু প্রভৃতি ফুটে উঠেছে। সিরিয়া সংকট দীর্ঘদিনের, কিন্তু কেন এই সংকট? এই সংকটের সুন্দর একটা নিরপেক্ষ কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে ‘সিরিয়াঃ স্বৈরাচার বনাম সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ’ প্রবন্ধে। সিরিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক বৃহত্ শক্তির মধ্যকার টানাপোড়ন, সিরিরায় শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বিষয়ের একটা স্বরূপ প্রবন্ধটিতে পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয় অংশ 'দক্ষিণ এশিয়া'- তে আঞ্চলিক পরিমণ্ডলের বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তানের রাষ্ট্র, রাজনীতি, গণতন্ত্র এই বিষয়গুলোর বর্ণনা সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে প্রবন্ধগুলোতে। দু'য়েকটা প্রবন্ধের নাম দেখেই কিছুটা অনুমান করা সহজ। 'কে এই ইমরান খান?', ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মোদি?', ‘ইন্ডিয়া, নাকি হিন্দুস্থান, নাকি ভারত', 'লালবিবি সমাচার' এগুলোর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের অবস্থা, ভারতে গণতন্ত্র, আত্মপরিচয়, রাষ্ট্র ও রাজনীতি, আফগানিস্তানের নারী অধিকার, রাষ্ট্র ও রাজনীতির মতো বিষয় বিশ্লেষণ সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। যেমন- ‘‘একাত্তর নিয়ে তিন ‘পাক’ ভাইয়ের ভাবনা’’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা প্রভৃতি নিয়ে পাকিস্তানি নতুন প্রজন্মের ভাবনার একটা রুপ দেখতে পাই। পাকিস্তানীদের চোখে বাংলাদেশে কোন গণহত্যা হয়নি, এটা ভারতের একটা ষড়যন্ত্র মাত্র। পাকিস্তানি নতুন প্রজন্ম মনে করে, একাত্তরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবী সেনারা আসলে গণহত্যা চালায়নি। গণহত্যা চালিয়েছে ভারতীয় পাঞ্জাবীরা। একাত্তরে ভারতের শিখ ধর্মাবলম্বী পাঞ্জাবীরাই আসলে চেহারা ও দৈহিক আকৃতির সুবিধা ব্যবহার করে গণহত্যা চালিয়েছে আর সব দোষ ফেলেছে পাক-পাঞ্জাবী সেনাদের ওপর। মোদির প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন এবং ভারতের ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে লেখক যে ধারণা এক দশক আগে তার ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মোদি?’ এবং ‘ইন্ডিয়া, নাকি হিন্দুস্থান, নাকি ভারত' প্রবন্ধে দিয়েছেন তার বাস্তবরুপ আমরা বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে দেখতে পাই। 'লালবিবি সমাচার'-এ আফগান নারীদের করুণ অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত, বঞ্চিত নারীরা কিভাবে এক সময় প্রতিবাদি হয় তা দেখতে পাই, সাথে সাথে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চিত্রও পাওয়া যাবে।
তৃতীয় অংশ ‘বাংলাদেশ’- এ বাংলাদেশের রাজনীতি, সুশীল সমাজ, গণতন্ত্র, ঢাকার পরিবর্তন এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। এই ভাগে 'তরুণেরা কেন রাজনীতিবিমুখ', 'সুশীল সমাজের ফয়সালার তালাশ', 'রাজনীতিতে রাজনীতি কোথায়', 'সামাজিক শক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষতা', 'গণজাগরণঃ শাহবাগ কি বলছে?', ‘ওদের গোপন কথা বলতে দিন’, ‘মুক্তিযুদ্ধের সবপ্ন ও ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট’, ‘রাজনীতির সুদিন দুর্দিন’ সহ অন্যান্য প্রবন্ধে ঢাকার আগের অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থার একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়। ঢাকার সুশীল সমাজের অবস্থান, তরুণ প্রজন্মের বাস্তবতা, রাজনৈতিক অবস্থা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের অবস্থান, গণতন্ত্রের সংকট, পরিচয়ের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রামের চিত্র সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। আর এই অবস্থার বর্ণনায় এক এগারোর পরবর্তিত নতুন করে গণতান্ত্রিক যাত্রার সময়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। বলা যায় গত এক দশকের স্মৃতিচারণ সাথে আছে সার্বিক বিশ্লেষণ। যেমন- 'স্মৃতির শহর ঢাকা' প্রবন্ধে মধ্যবিত্ত বলতে যে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও যাবতীয় টানাপোড়নের চিত্র তার পরিবর্তে ফাস্টফুড, শপিং, অযথা ইংরেজি কপচানো এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি যার শুরু হয়েছিলো নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তার একটা সুন্দর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ‘আমরা কেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চাই?’ প্রবন্ধে দেখতে পাই বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। যেখানে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে একধরনের জমিদার-রায়াত সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নয় তা যুক্তি সহকারে দেখিছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন নিয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন এই প্রবন্ধে। ‘কাঁটাবন থেকে ক্যাম্পাস’ প্রবন্ধে ঢাকার এই বিশেষ জায়গাটার মনোমুগ্ধকর বর্ণনা, নশ্বর পৃথিবীতে ধনী-গরীবের ব্যবধান, সাথে সাথে পুঁজিবাদ কিভাবে সর্বত্র গ্রাস করে চলছে তার একটা ধারণাও পাওয়া যাবে।
শেষভাগ ‘সাক্ষাতকার’- এ স্যারের কয়েকটা সাক্ষাতকার রয়েছে যেখানে সমাজনীতি, রাজনীতি, নির্বাচন, অর্থনীতি, ধর্ম, রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, মানবতা প্রভৃতি বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। প্রতিটি লেখায় কোন ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার সাহস দেখিয়েছেন। এখানে কয়েকটি প্রবন্ধের নাম ও কয়েকটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সামান্য আলোচনা করা হয়েছে, যা বইটি সম্পর্কে একটা ধারণা দেয় মাত্র। কিন্তু বইটি পড়লে গত দশকের বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের একটা বাস্তব চিত্র চোখের সামনে সুন্দর করে ফুটে উঠবে।
'গরিবের ঈশ্বর এবং মৌলবাদের ঈশ্বর এক নন' স্যারের এই কথা দিয়েই শেষ করতে চাই। ঈশ্বর সবাইকে সৃষ্টি করেছেন সমান ভাবে, কিন্তু পৃথিবীতে সবাই সমান হতে পারিনি। সবার কাছে ঈশ্বর সমান নয়, ঈশ্বরকে আমরা আমাদের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করি।
৩৩তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
helaluddin565@gmail.com
বইঃ গণতন্ত্র-ঘাটতি বিশ্ব, দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ
লেখকঃ শান্তনু মজুমদার
প্রকাশকঃ সময় প্রকাশন
মূল্যঃ ৪০০ টাকা।
Tuesday, October 18, 2022
আমাদের বন্ধু শেখ রাসেল -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
আমাদের বন্ধু শেখ রাসেল
বাঙালি
জাতির প্রধান নেতা বললেই যে মানুষটির নাম সর্বপ্রথম মাথায় আসে তিনি হলেন জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর
নির্মম ও করুণ পরিণতির কথা আমরা সকলেই জানি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয়
দিবসে স্মরণ করি বঙ্গবন্ধুর বীর পুত্র শেখ কামাল এবং শেখ জামালকে। কিন্তু প্রায়শই যাকে
আমরা ভুলে যাই তিনি হলেন ওই একই পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে। মাত্র ১১
বছর বয়সে নির্মম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া রাসেল হয়তো তার কর্মের দ্বারা বাঙালি জাতির
ইতিহাস ও উত্থানে দাগ কেটে রেখে যেতে পারেনি, তবে তার কয়েক বৎসরের জীবন বাঙালি জাতির
ইতিহাসকে এতই প্রভাবিত করেছে যে কখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের সিংহাসন
থেকে নেমে এসে আমাদের বন্ধু হয়ে উঠেছেন, তা আমরা বুঝতেই পারিনি।
শেখ রাসেলের জন্মের ইতিহাস বড়ই সুন্দর। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখ। দেশ তখন ভরা হেমন্তের গন্ধে আকুল হয়ে আছে। গ্রাম্য সভ্যতা ভিত্তিক আমাদের দেশের ঘরে ঘরে তখন নতুন ফসল তোলার আনন্দ। এমনই আনন্দের দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায় জন্ম গ্রহণ করলেন শেখ রাসেল। তার জন্ম হয়েছিল বড় বোন শেখ হাসিনার ঘরে। সমগ্র বাড়ি জুড়ি সেদিন আনন্দের জোয়ার। জন্মের কিছুক্ষন পর শেখ হাসিনা এসে ওড়না দিয়ে তার ভেজা মাথা পরিষ্কার করে দেন। জন্মের সময় শেখ রাসেল চেহারায় ছিলেন স্বাস্থ্যবান। শেখ রাসেলের জন্ম যেন শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারেরই আনন্দ নয়, সমগ্র জাতির আনন্দ।
শেখ রাসেলের নামকরণের পেছনেও এক সুন্দর কাহিনী রয়েছে। বঙ্গবন্ধু বরাবরই ছিলেন বিশ্বশান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষপাতী এবং যুদ্ধের ঘোর বিরোধী। এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় বার্ট্রান্ড রাসেল শুধুমাত্র নোবেলবিজয়ী দার্শনিক কিংবা সমাজবিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের নেতাও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমগ্র পৃথিবী যখন সম্ভাব্য একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে আছে, তখন যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বার্টান্ড রাসেল। এমনই মহান ব্যক্তির ব্যক্তিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধু তার কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন শেখ রাসেল।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট এর সেই অভিশপ্ত রাতের সঙ্গে পরিচিতি আমাদের সকলেরই। সেই রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্মম পরিণতির কথা আমরা সকলেই কম বেশি জানি। একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা সেই দিন রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন ট্যাংক দিয়ে গিলে ফেলেন। সেইদিন প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মচারী মহিতুল ইসলামের কথা অনুযায়ী, রাসেল দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেন, জানতে চান সেনারা তাকেও মারবে কিনা। এমতাবস্থায় একজন সেনা কর্মকর্তা মহিতুলকে এসে মারলে রাসেল তাকে ছেড়ে দেয়। সে কাঁদতে থাকে থাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই সময় একজন ঘাতক রাসেলকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফাইয়ারের মাধ্যমে হত্যা করে।
শেখ রাসেল কেন আমাদের বন্ধু, কীভাবেই বা তিনি আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলেন তা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে রাসেলের ছেলেবেলার দিনগুলিতে। তার ছেলেবেলার দিনগুলো সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তার অধিকাংশই শিশু বয়সের নিষ্পাপ আত্মভোলা কর্মকান্ডের ঘটনা। শোনা যায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় টমি নামে একটি কুকুর ছিল যার সাথে ছোট্ট রাসেল খেলে বেড়াতো। একদিন খেলার সময় কুকুরটি জোরে ডেকে উঠলে ছোট রাসেলের মনে হয় টমি তাকে বকেছে। তাই শিশু রাসেল তার আপা শেখ রেহানার কাছে এসে কাঁদতে থাকেন। আরো শোনা যায় শেখ রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিল।
মাছ ধরে আবার সেই মাছ সে পুকুরেই ছেড়ে দিত। এতেই ছিল তার আনন্দ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের জন্ম হলে শেখ রাসেল জয়কে নিয়ে সারাদিন খেলা করতো। তার স্বভাব ছিল অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির। আর তার এই দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল একটি বাইসাইকেল। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙে সেই বাইসাইকেলকে সঙ্গী করে রোজ স্কুলে যেত শেখ রাসেল। শেখ রাসেলের শৈশব আখ্যান যেন আমাদের সকলের শৈশবের গল্প বলে দেয়। তার এই অল্প সময়ের শৈশবের গল্প-কথাগুলোর মধ্যে আমরা যেন বারবার নিজেদেরই খুঁজে পাই। পড়াশুনা, খেলাধুলা, দুরন্তপনা এসব নিয়ে শেখ রাসেল আমাদের সকলের কাছেই হয়ে ওঠে শৈশবের এক মূর্ত প্রতিমূর্তি।
শেখ রাসেলের ছেলে বেলার কথার মাঝে আমরা খুঁজে পাই রূপকথার মতো আমাদের ছেলেবেলা। শেখ রাসেলের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে আপামর বাঙালির শৈশব। অন্যদিকে তার নির্মম মৃত্যুর কাহিনী বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশের করুন ইতিহাসের কথা। সেই সমস্ত নৃশংস ক্ষমতালোভী মানুষের কথা যারা কেবলমাত্র ক্ষমতার লোভে ১১ বছরের একটি ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি।
ছবিঃ শেখ রাসেল
প্রকাশিত পত্রিকার লিঙ্কঃ আমাদের বন্ধু শেখ রাসেল