Sunday, October 13, 2024

কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার উপন্যাস 'আরণ্যক' -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 ❝ জ্যোৎস্না আরো ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালোবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে নাই, তাদের কাছে এই পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো কালেই ❞

আরণ্যক বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত চতুর্থ উপন্যাস। ১৯৩৯ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারে তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাসটি রচনা করেণ।

"আরণ্যক" উপন্যাসের মূল উপপাদ্য প্রকৃতি। উপন্যাসটি রচনা করা হয়েছে উত্তমপুরুষে। গল্পের কথক সত্যচরণ। পূর্ণিয়া জেলায় প্রায় ত্রিশ হাজার বিঘা জঙ্গল- মহালের জমি দেখাশোনার জন্য এবং প্রজা বিলি করার জন্য 'ম্যানেজার' পদে চাকুরি নিয়ে গভীর অরণ্যভূমি লবটুলিয়া, নাঢ়া- বইহারে পা রাখে সত্যচরণ। কলিকাতার জনসমাগম ও লোকারণ্যে অভস্ত্য সত্যাচরণ এমনি এক দূর্গম জনমানবহীন প্রান্তরে এসে প্রথমে বেশ হতাশ হয়ে পড়ে ঠিকই কিন্তু ধিরে ধিরে জঙ্গল তাকে পেয়ে বসে। দেখতে দেখতে অরণ্যের প্রতি তার নিদারুণ ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
প্রকৃতির নানা রূপ ধিরে ধিরে তার চোখে ধরা দিতে থাকে।

মধ্য দুপুরে রৌদ্র তপ্ত ঝাউবন, রাতের জোছনায় প্লাবিত অরণ্যভূমি, বর্ষায় বৃষ্টির ফোটা সবুজ পল্লবে পড়ে টিপ টিপ ছন্দের যে মোহনিয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তাতেই বিভোর, বিমোহিত, মগ্ন হয়েছেন গল্পের কথক। লেখক তারই বর্ণনা করে গেছেন শৈল্পিক ভাষায়। উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রের সাথে জঙ্গল ও প্রকৃতি যে অসাধারণ মেলবন্ধন তা লেখক তার লেখায় প্রতিটি পঙক্তিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এই লেখা উপভোগের জন্য লাগবে একটা প্রকৃতিপ্রেমী পাঠক মন। প্রকৃতিপ্রেমী পাঠক মাত্রই এই উপন্যাসের প্রতি পাতায় কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ইট পাথরের চার দেয়ালের মাঝে বসেও এই বই পড়ে আপনিও হারিয়ে যেতে পারেন সূদুর লবটুলিয়া, নাড়া-বইহারের আরণ্য ভূমিতে।

❝ এই অরণ্যপ্রকৃতিকে ধ্বংস করিতে আসিয়া এই অপূর্বসুন্দরী বন্য নায়িকার প্রেমে পড়িয়া গিয়াছি। যখন ঘোড়ায় চড়িয়া ছায়াগহন বৈকালে কিংবা মুক্তাশুভ্র জ্যোৎস্নারাতে একা একা বাহির হই, তখন চারিদিকে চাহিয়া মনে মনে ভাবি, আমার হাতেই ইহা নষ্ট হইবে? জ্যোৎস্নালোকে উদাস আত্মহারা, শিলাস্তৃত ধূ ধূ নির্জন বন্য প্রান্তর! কি করিয়াই আমার মন ভুলাইয়াছে চতুরা সুন্দরী! ❞

বইটি পড়িতে গিয়া যতটা আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত হইয়াছি তারচেয়ে বেশী ব্যাতিত হইয়াছি আমি। একজন প্রকৃতি প্রেমিকের হাতে নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতির রূপরেখা ধ্বংসের চিত্র দেখিয়া আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হইয়াছে। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য্য সভ্যতার বিকাশের দোহাই দিয়া মানুষের হাতেই ধ্বংস হচ্ছে। প্রয়োজনে অপ্রোয়জনে ধ্বংস হচ্ছে।

সত্যচরনের মতো আমি মধ্যদুপুরে স্বরস্বতীকুন্ডীর ধারে গাছের ছায়ায় বসিয়া কখনো পাখিদের কলকাকলি শুনি নাই। ফুলের সুবাস নিঃশ্বাসে মিশাইয়া কখনো নিদ্রা যাই নাই। অথচ সময়ের আবর্তনে স্বরস্বতীকুন্ডীর সৌন্দর্য বিলুপ্ত হইবে সেইখানে প্রজারা গাছপালা, লতাপাতা কাটিয়া সাফ করিয়া বসবাস শুরু করিবে। দূর দুরান্ত হইতে আনিয়া যেসকল ফুলের আবাস গড়িয়াছিলেন সেসকলি বিলুপ্ত হইয়া যাইবে এইসব ভাবিতে ভাবিতে আমার নিজেরই মন কেমন করিয়া উঠিতো।

এই উপন্যাসের বর্ণনা আমায় যতটা ভাবুক বানিয়েছে তারচেয়ে বেশি প্রভাবিত করিয়াছে বন্য মানুষের সহজ সরল জীন প্রণালি। তাহারা ভাত খাইতে পায় না কলাই ও চাতু সেদ্ধ করিয়া খায় তারপরও এই প্রকৃতি তাদের সকলকে এক অদৃশ্য সুতোয় বাধিয়া একে অপরের আপন করিয়া তুলিয়াছে।এত দারিদ্র্য, এত অশিক্ষা, এত বৈষম্য সত্ত্বেও মানুষ বাঁচে, নির্লোভ-সদাচঞ্চল-সদানন্দ জীবনে সতেজভাবে বাঁচে প্রকৃতির সঙ্গে।

❝ ইহাদের দারিদ্র্য, ইহাদের সারল্য, কঠোর জীবনসংগ্রামে ইহাদের যুঝিবার ক্ষমতা, এই অন্ধকার অরণ্যভূমি ও হিমবর্ষী মুক্তাকাশ বিলাসিতার কোমল পুষ্পাস্তৃত পথে ইহাদের যাইতে দেয় নাই, কিন্তু ইহাদিগকে সত্য পুরুষমানুষ করিয়া গড়িয়াছে। ❞

লবটুলিয়া বইহারের অরণ্য—ভূভাগ, ফুলকিয়া বইহারের শেফালীপুষ্পের জ্যোৎস্নামাখানো সুবাস, মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট, কুশী নদীর স্রোত, স্বরস্বতীকুন্ডীর বন, নাড়া বইহারের অরণ্য, ধু-ধু বন্যপ্রান্তর, ঝাউবন—কাশবনের চর, ধূসর শৈলশ্রেণি, ফুটন্ত রক্তপলাশের ঘন অরণ্যর অপার্থিব সৌন্দর্যের নিখুঁত বর্ণনায় আমি বার বার মুগ্ধ, বিস্মিত, উৎফুল্ল, উচ্ছ্বসিত ভাবাবেগপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছি।

আপনি যদি প্রকৃতি ভালোবাসেন। জঙ্গলের ভয়ংকর সৌন্দর্য যদি আপনাকে মোহিত করে। পাহাড়ের ধার বেয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনা তার পাশে ঝুলে পড়া শিমুল, আকন্দ কিংবা শিউলি ফুলের মুগ্ধ করা সুবাস। অন্ধকার প্রান্তর কিংবা ধূ-ধূ ছায়াহীন জ্যোৎস্না ভরা প্রান্তর, মধ্যদুপুরে দুরের পর্বতশ্রেণী, বনঝাউ ,কাশবন কিংবা নির্জন সন্ধ্যায় পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দিকচক্রবালে শৈলমালার আড়ালে ঢলে পড়া লাল সূর্য এইসবকিছু যদি আপনার মনে আন্দোলন সৃষ্টি করে তবে এই বইটি নিঃসন্দেহে আপনার জন্য।


বইঃ আরণ্যক
লেখকঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ উৎকর্ষ
মূল্যঃ ৩০০ টাকা মাত্র।


'নর্তকী ও পুঁজিপতি শাসিত এই ব্রোথেল পৃথিবীতে' মানুষ চেনার উপায় -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

পৃথিবীর প্রাচীনতম এক ঋষিমানব বলেছেন,
ইতর শ্রেণির মানুষেরা আশপাশের মানুষ নিয়ে কথা বলে, মধ্য শ্রেণির মানুষেরা ঘটনা নিয়ে কথা বলে, আর উচ্চশ্রেণির মানুষেরা আইডিয়া বা ফিলোসফি নিয়ে কথা বলে।

ঋষিমানবের বক্তব্যের সূত্র দিয়ে এই গল্পের যুবক-যুবতীদের সভ্যদের শ্রেণিকরণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এরা একই সঙ্গে ইতর, মধ্য এবং উচ্চশ্রেণির প্রাণ।

আপনি শুধু বুদ্ধিবেশ্যা চিনেন, এই গল্পটা আপনাকে বুদ্ধি-গেলমান বিষয়েও ধারণা দিবে।

খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন করা একদল তরুণ-তরুণীর গল্প এটা। এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ রাজনীতির নেকড়ে, কেউ বিত্তবান ঘরের বখে যাওয়া সন্তান, কেউ বেকার, কেউ ধার্মিক। কেউ আবার স্বপ্ন দেখে (নব্বইয়ের দশকের সামাজিক সিনেমার মতো) একটা শান্ত-সৌম্য ইউটোপিয়ার। একটা নন্দিন জীবনের। কেউ যাচ্ছে গোপনে, নানান এজেন্সির মাধ্যমে বিত্তবান ড্যাডি আর মাম্মিদের সঙ্গ দিতে অভিজাত হোটেল। রিসোর্টে। প্রোগ্রামে। এরাই এখানে প্রোগ্রামার।
এদের প্রত্যেকের কিছু ডাকনাম আছে, যেমন- রাষ্ট্রপতি, হযরত, পুরোহিত, প্রোগ্রামার, জোড়াখোর, ফাকরানী, শোভাখানকি, উচ্চাখানকি... ইত্যাদি, ইত্যাদি!

এদের একটা আড্ডাখানা আছে। নাম শুঁড়িখানা। শুঁড়িখানা ভয়ংকর। দুর্বলচিত্তের মানুষদের জায়গা এইটা নয়। ওরা এখানে যারা বসে (ওদের ভাষ্যে), একেকটা জাত বে-জন্মা। বিদ্যা-বুদ্ধি-সাহসে বিকট। শিল্পে ও শিষ্টজ্ঞানে শাণিত। আড্ডায় এবং আলাপে প্রবলভাবে যৌনায়িত। ওরা একই সাথে শ্রমিক এবং পুঁজিপতি। আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মঘাতী। ওরা বিশ্বাস করে, পৃথিবী এখনও পৃথিবীর সকল বুড়ো-বুড়িদের পাপেই ভারগ্রস্থ হয়ে আছে, সেইখানে নতুন করে পাপ বাড়ানোর কোনো সুযোগ ওদের হাতে নেই। ওরা তাই ভারহীন। পালকের মতো। উড়ে-উড়ে, উড়ছে; যৌবনে, মৌবনে—

এক বসার পড়ে উঠার মতো একটা বই। তবে যাদের শব্দের ব্যবহার নিয়ে এলার্জি আছে তাদের কাছে বইটি অশ্লীল লাগবে। অশালীন শব্দের ব্যবহারে বাস্তবতার বর্ণনাটা বেশ জমে উঠেছে। বর্তমান বাংলার সার্বিক অবস্থার একটা চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে, যা সবাই ভাবে কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনা। বইটি পড়ার মাধ্যমে এই না বলতে পারার কষ্টটাও লাঘব হবে অনেকটা।




বইয়ের নাম: নর্তকী ও পুঁজিপতি শাসিত এই ব্রোথেল পৃথিবীতে
লেখক: মুহম্মদ নিজাম
প্রকাশনী: উপকথা প্রকাশন
মূল্য: ৩০০ টাকা

Md. Helal Uddin
01.07.2024