Thursday, May 26, 2022

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ এবং কিছু কথা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ এবং কিছু কথা
 
একটা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। এখানে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোই হয় না, তাদেরকে জীবন ও জগতের সাথে পরিচিত করানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অধ্যাপনা করেন তাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং বিশ্বের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে এর যথার্থতা দেখতে পাই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৃষ্টি হয় দেশ প্রধান, আমলা, ব্যাংকার, বিচারক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাকুরীজীবী সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা আরো একটু বেশি দেখতে পাই তাহলো বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রধান ভুমিকা পালন করেছে।
 
বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হলো 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' যা ১৯২১ একুশ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে বাংলার মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা শিখা গোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানুষের ধ্যান-ধারণা পাল্টে দেবার মতো কতিয়প কাজ করেছেন। মুক্ত চিন্তার অধিকারি এই গোষ্ঠী যদিও বেশি সময় সক্রিয় ছিলো না তথাপি বাংলার জাগরণে তাদের ভূমিকা ছিলো অনন্য। এরপরে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের অধীনে চলে আসলো কিন্তু বাঙালীর স্বকীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা কোন ধরনের ছাড় দিলো না। যার প্রমাণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। পরবর্তীতে এই অঞ্চলের সকল আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও অনেক অবদান ছিলো। আর এ কারনেই ১৯৭১ সালে পাক সেনারা যখন বুঝতে পারলো তাদের পরাজয় নিশ্চিত তখন বাঙালীদের মেধাশূন্য করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেন।
 
বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমনই জায়গা, যেখানে একটা দেশের সকল বিষয়ে মেধার চর্চা হয়, দেশের উন্নয়নে কাজ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের দিকে তাকালে পুরানো সেই চিত্র আর পাওয়া যায় না। এখন এখানে মেধার চর্চার পরিবর্তে ক্ষমতা আর অর্থের চর্চা বেশি হতে দেখা যায়। গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খেয়াল নেই। তারা ব্যস্ত কনসালটেন্সি আর পার্ট টাইম ক্লাস কিংবা সন্ধ্যাকালীন ক্লাস নিয়ে। এমন অবস্থায় একটা জাতির উন্নয়ন তরান্বিত হওয়া অত্যন্ত কঠিন।
 
বহুদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বির্তক আছে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় তারাই নিয়োগ পায় যারা একাডেমিক জীবনে প্রথম শ্রেণিতে উত্তর্ণ হয়েছে। আর এই প্রথম শ্রেণি পাওয়া নিয়েও নানা ধরনের বির্তক ও লোবিং এর কথা প্রচলিত রয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ইচ্ছে মতো শর্ত জুড়ে দিচ্ছে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর এই শর্তগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পছন্দের প্রার্থী নিয়োগ দেয়াকে প্রাধান্য দিয়ে করা হচ্ছে।
 
অতি সম্প্রীত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এসএসসি ও এইচএসসি-তে জিপিএ ৪.২৫ পেতে হবে উল্লেখ করেছে আর অনার্স-মাস্টার্সে তো সিজিপিএ ৩.৫০ এর উপরে থাকতে হবেই। কিন্তু আমাদের দেশে জিপিএ পদ্ধতি চালু হয় ২০০১ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং অনার্স পর্যায়ে ২০১০ সালের পরে। এমতাবস্থায় যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ২০১০ সালের আগে এবং অনার্স-মাস্টার্স ২০১৫ সালের আগে পাশ করেছে তাদের এতো বেশি জিপিএ/সিজিপিএ পাওয়া সহজসাধ্য ছিলো না। তাই তারা বেশিরভাগ নিয়োগের ক্ষেত্রে আবেদনই করতে পারে না, তাদের পাঁচ দশ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকার পরেও আবেদন করার যোগ্যতা রাখে না। যা যুক্তিসংগত নয় বলেই আমার কাছে মনে হয়।
 
উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি সেখানে রেজাল্টের চেয়েও গবেষণা কর্মের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে তার কতো পয়েন্ট আছে কিংবা অনার্সে সে সর্বোচ্চ সিজিপিএ ধারী কিনা তা দেখার চেয়েও আগে দেখে তার কতোগুলো গবেষণা প্রকাশনা আছে, তার ক্লাসে পড়ানোর দক্ষতা কেমন সহ এমন কিছু বিষয় যার দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হতে পারে। সাথে সাথে রাষ্ট্রও লাভবান হতে পারে। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেকার নিয়োগ দেখি তাহলে দেখতে পারবো ড. শহিদুল্লার মতো শিক্ষক কতো কম রেজাল্ট নিয়ে শিক্ষক হয়েছিলেন কিন্তু তার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কতো সমৃদ্ধ হয়েছে। আবার কোটায় নিয়োগ পাবার কারনে কথা উঠায় আবুল হুসেনের মতো শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছিলো। অথচ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে রেজাল্ট আর নানাবিধ কোটার (এমপি, মন্ত্রী, সরকারি দল, মামা, খালু) সন্ধান করি। কিন্তু হবার কথা ছিলো ভিন্ন। সর্বোচ্চ ফলাফল হলেই যে সবচেয়ে মেধাবী এটা মনে করার কোন কারন নেই। সর্বোচ্চ ফলাফল আর ভালো গবেষক এক নয়। ভালো ফলাফলের একটা গুরুত্ব আছে, তাই বলে এটাকেই একমাত্র নির্ধারক করা উচিত নয়।
 
সবশেষে বলতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা অভিন্ন নীতিমালা এখন সময়ের দাবী। সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন গবেষণা প্রাধান্য পায় সেই পথ অবলম্বন করাও একান্ত প্রয়োজন। দেশের উন্নয়নে, সমাজের পরিবর্তনে গবেষণার বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত মেধাবীদেরকে নিয়োগ দিতে সঠিক ব্যবস্থা করাও একান্ত জরুরী। না হলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আলোকিত হতে পারবে না। একটা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে একটা দেশ সৃষ্টি করেছে, সেখানে আজ মুক্ত চিন্তা, উন্নত গবেষণা হুমকির মুখে। এসব থেকে বের হওয়ার মাধ্যমে আমাদেরকে করে স্বপ্ন দেখতে হবে নতুন সোনার বাংলাদেশ।
 
 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ এবং কিছু কথা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Saturday, May 21, 2022

বাংলা নববর্ষ এবং মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা

 

রাত পোহালেই বাংলা নববর্ষ ১৪২৯। সম্রাট আকবর খাজনার হিসাব নিকাষের জন্য হালখাতার চালু করতে গিয়ে এই প্রথার প্রচলন করেন। বছর শেষে খাজনাপাতি যাতে করে সহজে আদায় করে নতুন করে আবার শুরু করতে পারে এই ছিল উদ্দেশ্য। কালের পরিক্রমায় এটা বাঙালি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়। আর বর্তমান সময়ে এসে এটা প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের বির্তকে স্থান করে নিয়েছে।

বর্তমানে একপক্ষ নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা করছে, আরেক পক্ষ এর বিরোধীতা করে বাধা দেবার চেষ্টায় রত। কোন পক্ষ সঠিক কিংবা কোন পক্ষ বেঠিক এই বির্তকে যাওয়া কোন ইচ্ছা আমার নেই। বিভিন্ন পশু পাখির ছবি, মূর্তি কিংবা ভাস্কর্য যাই বলি না কেন তা নিয়ে শোভা যাত্রা করলেই মঙ্গল চলে আসবে অথবা এ সব বাদ দিয়ে মসজিদে, মন্দিরে বসে দোয়া দুরুদ পড়লে কিংবা পূজা অর্চনা করলে মঙ্গল হবে এই তর্ক করা আমার কাছে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় না।

আমি ভিন্ন কিছু কথা বলি। গত দুই দিন আগে কুমিল্লার বুড়িরচং এ এক দরিদ্র কৃষকের ৪০ শতক জমির লাউ, চাল কুমড়া এবং মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেতের সকল গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। দরিদ্র কৃষক জমি লিজ নিয়ে এই কাজটি করেছিল। ফলন ভালো হওয়ায় এবং বাজার মূল্য ভালো থাকায় তিনি আশা করেছিলেন প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা আর আয় হবে। কিন্তু কি হলো? তার মঙ্গল এখন কেমন করে হবে? তার মঙ্গলের জন্য আমাদের কি করা উচিত? সে কি মসজিদে যাবে না শোভাযাত্রায় যাবে? আমার কাছে বোধগম্য নয়। আর যে বা যারা এই কাজটি করেছে তারা কোথায় গিয়ে মঙ্গল কামনা করবে তাও ভেবে পাচ্ছি না।

সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে কিংবা আগে যে ব্যক্তি যারা অন্যের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে কিংবা অন্য কোন অবৈধ পথে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে নববর্ষের পান্তা ইলিশ খাবার আয়োজন করেছেন তারা নিজের মঙ্গল করলেও কোন একটা পরিবারের জন্য অমঙ্গলই তো করেছে নাকি? এরা যদি মঙ্গল শোভাযাত্রা করে ইলিশ পান্তা খেয়ে ঘরে ফিরবে কিংবা পাঞ্জাবি টুপি পড়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে, তসবিহ গুনে বা মন্দিরে গিয়ে পূজা অর্ঘ দিয়ে আবার নতুন বছর থেকে একই কাজ করেন তাতে কি সমাজের, দেশের মঙ্গল হবে? বিষয়টা আমার কাছে পরিস্কার না।

আমরা যদি নিজেদের, সমাজের এবং দেশের মঙ্গল চাই তাহলে প্রথমেই নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে বলেই আমি মনে করি। যদি নিজেকে অন্যের অমঙ্গল থেকে রক্ষা করতে না পারি তাহলে আমিও অন্যের অমঙ্গলের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে মঙ্গলশোভা কিংবা মসজিদ, মন্দিরে গিয়ে মঙ্গল কামনা করে লাভ হবে না বলেই আমার ধারনা। সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ যখন তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের ও অন্যের মঙ্গলে কাজ করবেন তখনই সমাজে, রাষ্ট্রে মঙ্গল প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যথায় অমঙ্গলেই ভরে যাবে আমাদের সোনার বাংলা। নতুন বছর আসবে, বছর চলে যাবে আর আমরা অমঙ্গলের মধ্যেই পড়ে থাকবো।

তাই আমি মনে করি কোনটা ভালো কোনটা খারাপ এই বির্তকে না গিয়ে এবং এর জন্য মানুষে মানুষে সমাজের, রাষ্ট্রের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে যার কাছে যেটা ভালো মনে হয় তার মাধ্যমেই মঙ্গল কামনা করা শ্রেয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের বিবেক দিয়েছেন। নিজের এই বিবেক যা রায় দেয় তাই করুন, তবে যাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তা অবশ্যই নয়। কেননা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা কোন ধর্মের কাজ নয় এবং সকল ধর্ম, সকল সংস্কৃতি শান্তির কথা বলে। তাই বির্তক না করে, বিশৃঙ্খলা না করে, অশান্তি না করে নিজের এবং অন্যের মঙ্গলের জন্য নিজেদের নিবেদিত করি। এটাই হোক নতুন বাংলা বছরের শপথ। শুভ নববর্ষ - ১৪২৯।


 বাংলা নববর্ষ এবং মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Md. Helal Uddin
      14/04/2022