তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা -- লে: কর্ণেল (অব.) এম.এ.হামিদ, পিএসসি, তিনি
ঢাকা স্টেশন কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭
নভেম্বর এই তিনটি ঐতিহাসিক সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই ঢাকার লগ এরিয়া
কমান্ডার পদে অধিষ্ঠিত হন, কিন্তু মাত্র তিন মাস পর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের
সাথে মতানৈক্য হওয়ায় তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে স্বেচ্ছায় অবসর
গ্রহণ করেন। লেখকের ভাষ্যে-
"জিয়া, যে আর্মি তে ইনসাফ
নেই , আইনের শাসন নেই, চক্রান্তের শেষ নেই , যে আর্মি চীফ অব স্টাফ অবিচার
করে, কাজের মর্যাদা দেয় না, যোগ্যতার মর্যাদা দেয় না, কান -কথায় চলে,
সে আর্মিতে আমি আর চাকরি করবো না।" (পৃষ্ঠা ১৭১)
বইয়ে
লেখক নিজে যা দেখেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন।একইসাথে ঘটনার হোতা ও
স্বাক্ষীদের সাথে কথা বলে যা জেনেছেন তা এবং তার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্তে
উপনীত হয়েছেন তাও এই বইয়ে উল্লেখ করেছেন।ফলে এটি একটি তুলনামূলক নিরপেক্ষ
প্রামাণ্য দলিলে রূপ নিয়েছে।
বইয়ে
অনেক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। বইটি পড়লে পাঠক নিশ্চয়ই সে স্বাদ গ্রহণ
করবেন। আমার কাছে ভিন্ন একটি ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যেখানে
লেখকের দায়িত্বশীল ভূমিকা পাঠক নিজেও অনুধাবন করতে পারবেন। যা জাতির
ইতিহাসের সাথে জড়িত। বঙ্গবন্ধুকে যারা ভালোবাসেন তাদের আবেগের সাথেও এর
নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ঘটনাটি ১৬ আগস্টের-
"আমার পৌঁছবার
আগেই শেখ সাহেবের পরিবারের সবকটি লাশ কফিন বন্দি করে সাপ্লাই
ব্যাটালিয়নের ট্রাকে তুলে আমার আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। শুধু শেখ
সাহেবের লাশ কফিন বন্দি করে বারান্দার এক কোণে একাকী ফেলে রাখা হয়েছিল।
আমি সুবেদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'এটা কী শেখ সাহেবের লাশ?' তিনি
স্মার্টলি জবাব দিলেন, জ্বি স্যার, ওটা শেখ সাহেবের। আমি নিজে চেক করে
রেখেছি। কেন জানি কৌতূহলবশতই বললাম, কফিনের ঢাকনাটা খুলুন, আমি চেক করবো।
তারা বড়ই অনিচ্ছায় হাতুড়ি বাটাল এনে আবার কফিনটি খুললেন। কি আশ্চর্য!
দেখা গেল ওটা শেখ সাহেবের লাশ নয়, শেখ নাসেরের । সুবেদার সাহেব খুব ঘাবড়ে
গেল। তাকে বকাঝকা করলাম। আসলে শেখ নাসেরকে দেখতে অনেকটা তার বড় ভাই শেখ
মুজিবের মতোই।আর এতেই সুবেদার সাহেবের ঘটে বিভ্রান্তি ।
আমি
এবার ট্রাকে উঠে সবকটি কফিনের ঢাকনা খুলে ম্যাচ বাক্সের কাঠি জ্বালিয়ে
শেখ সাহেবকে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে ট্রাকের এক অন্ধকার কোণে শেখ সাহেবকে
পাওয়া গেল। একটি কফিনের ঢাকনা খুলতেই বরফের স্তুপ এর ভেতর থেকে তার দীপ্ত,
অক্ষত, সুপরিচিত মুখখানি বেরিয়ে এলো। সাদা চাদরে ঢাকা বুকের সমস্ত অংশ
তখনো রক্তে রাঙ্গা । তাঁর কফিনের ঢাকনা বন্ধ করে সম্মানের সাথে তাঁকে নিচে
নামিয়ে বারান্দায় স্থাপন করা হলো। বারান্দা থেকে শেখ নাসেরের কফিন ট্রাকে
নিয়ে তুলে দেয়া হলো। আমি সবকটি কফিন নিজ হাতে কলম দিয়ে নাম লিখে মার্ক
করে দিলাম। লাশ বদল বিভ্রাটের দরুন বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়ে গেল। আমি
কফিনগুলোর ট্রাকটি বনানী রওয়ানা করিয়ে দিয়ে এবার আমার জিপ নিয়ে
ঊর্ধ্বশ্বাসে শেখ মনির বাসার দিকে ছুটলাম । মেজর আলাউদ্দিনকে পাঠালাম আবদুর
রব সেরনিয়াবাতের বাসায়। তখন ভোর ৪ -৪৫ মিনিট।" (পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭)
বইয়ের আরেকটি অংশও অনুরূপ সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ আর আবেগের সাথে জড়িত বলে মনে হয়েছে তা হলো-
"চারিদিকে
বিভৎস দৃশ্য দেখে দেখে আমার মাথায় বারবার গন্ডগোল বেঁধে যাচ্ছিল।
কয়েকবার বমি করার উপক্রম হলো। গভীর রাতে এরকম একটি অপ্রীতিকর কাজে জড়িয়ে
ফেলার জন্য বারবার মেজর মতিনকে অভিসম্পাত দিতে লাগলাম। সাপ্লাই
ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা একটানা কাজ করে ১৮ টি কবর খুঁড়ে রেখে ছিল। শেখ
সাহেবের পরিবারের লাশগুলো আগে দাফন করা হয়। তাদেরকে প্রথম সাতটি কবরে
সম্মানের সঙ্গে দাফন করা হয়। এ সময় ব্যাটালিয়নের একজন সিনিয়র সুবেদার
উপস্থিত ছিলেন তাদের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল রবও ছিলেন। তাদের আরো দু-তিন
অফিসার ছিল। আমি কাউকে ঠাহর করতে পারছিলাম না। অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ ও
টেনশনের মধ্যে তারা দাফন কার্য সমাধা করে।
শেখ পরিবারের
সাতজন সদস্যের কবর আছে বনানীতে। প্রথম কবরটা বেগম মুজিবের। দ্বিতীয়টা শেখ
নাসেরের। তৃতীয়টা শেখ কামালের। চতুর্থ কবর মিসেস কামালের। পঞ্চম কবর শেখ
জামালের। ষষ্ঠ কবরে মিসেস জামাল এবং সপ্তম কবরে শায়িত আছে মাস্টার রাসেল।
সব
মিলে ওখানে ১৮ টি কবর আছে। ১৩ নং কবরটি শেখ মনির। ১৪ নং বেগম মনি। ১৭ নং
কবরে শায়িত রয়েছেন জনাব রব সেরনিয়াবাত। বাকিগুলো শেখ মনি ও জনাব
সেরনিয়াবাতের বাসায় অন্যান্য যারা মারা যান তাদের।
লাশগুলো
দাফনের পর আমি আমার অফিসে ফিরে এসে এক এক করে নামগুলো আমার অফিস প্যাডে
লিপিবদ্ধ করি। রেকর্ডটি বহুদিন ধরে আমার কাছে রক্ষিত রয়েছে। কেউ কোনদিন
খোঁজও করেনি। এছাড়া আর কোথাও এই সমাধিগুলোর রেকর্ড নেই।" (পৃষ্ঠা ৬৭-৬৮)
সমকাল
আর মহাকাল অনুভূতিতে এক জায়গায় মিলিয়ে দেয়। ইতিহাসের যেমন পুনরাবৃত্তি ঘটে
তেমনি ঘটনার প্রেক্ষিতে অনুভূতিও মিলে যায়। ফলে বর্ণনা ধার নিয়ে নিজের
সাথে মিলিয়ে নেয় পাঠক।
"কঠোর
পরিশ্রম আর ভালো কাজ করলে কি-না এদেশে শুভাকাঙ্ক্ষী বদলে শত্রু সৃষ্টি হয়,
অনেকের চক্ষুশূল হতে হয়। আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হলো না।" (পৃ ১৬৯)
"দেখলাম,
অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করার চেয়ে এসব হজম করার ফায়দা অনেক বেশি।
ক্ষমতা, প্রমোশন, নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। ক্ষমতাধরদের চক্ষুশূল হয়ে থাকতে
হয় না। তাদের বন্ধু হয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস করা যায়। দরকার শুধু স্রোতের
অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেয়া।" (পৃষ্ঠা ১৭২)
বইটিতে যা যা আছে-
১.
১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ রক্তাক্ত সেনা অভ্যুত্থান
মেজর ডালিমের ঘটনা (পৃ১৫-১৬)
রাষ্ট্রদূত হিসেবে জিয়াউর রহমানের পদায়ন ও তা বাতিল (পৃ১৭)
রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ ও তা বাতিল( পৃ১৮)
সেনাবাহিনীতে বিভক্তি (পৃ২০)
কর্ণেল ফারুক ও ট্যাংক (পৃ২৩)
১২ই আগস্ট ১৯৭৫ (পৃ২৪-২৫)
অভ্যুত্থান প্ল্যান (২৫-২৭)
১৪ ই আগস্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট (২৭-২৮)
১৫ আগস্ট কালরাত্রি (২৮-৩৪)
মুজিব হত্যাকাণ্ড (৩৪-৪০ )
হত্যাকাণ্ডের ভিন্নভাষ্য (৪০ -৪৩)
মৃত্যুর সময় ও প্রকৃত হত্যাকারী কে (৪৫-৪৭) শাফায়েতের ঘরে মেজর রশিদ (৪৭ -৪৯)
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সকালবেলা (৪৯-৫৬)
চিফ অব স্টাফ হাইজ্যাক ( ৫৬-৫৮)
৪৬ ব্রিগেডে উল্লাস( ৫৯- ৬০)
মোশতাকের প্ল্যানই ছিল শপথ গ্রহণ( ৬১-৬২)
রক্তাক্ত বাড়ি (৬২- ৬৫)
রাতের অন্ধকারে (৬৫ -৬৮)
প্রয়াত রাষ্ট্রপতির দাফন (৬৮)
ভারতীয় হস্তক্ষেপ (৬৯-৭১)
চিফ অফ স্টাফের গদি দখল (৭১- ৭৩ )
১৫ ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় মুজিবুর রহমানকে কি বাঁচানো যেত? (৭৩-৭৫)
ক্যান্টনমেন্ট থেকে কেন সৈন্য মুভ করল না ?(৭৫- ৭৬)
শাফায়েতের এ্যাকশন (৭৬- ৭৯ )
সময় বিভ্রাট(৭৯-৮০)
তারা যেভাবে সংবাদ পেলেন (৮০-৮১)
১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থান একটি পর্যালোচনা (৮৩-৮৮)
২.
৩রা নভেম্বর, অভ্যুত্থান
খালেদের উত্থান পতন
আগস্ট পরবর্তী অবস্থা( ৯২ -৯৩ )
ভগ্নহৃদয় খালেদ(৯৩-৯৪)
নাখোশ জিয়া (৯৪-৯৬)
জিয়া বনাম মোশতাক- ওসমানী(৯৬-৯৮)
২/৩রা নভেম্বর রাত (৯৮)
মধ্যরাতের অভ্যুত্থানে জিয়া বন্দী (৯৮-১০০)
৩ রা নভেম্বর -পাল্টা অভ্যুত্থান (১০১-১০২)
বন্দী জিয়া:খালেদের 'টেলিফোন-ব্যাটেল' (১০২-১০৩,১০৬)
মেজরদের দেশত্যাগ(১০৬-১০৮)
কুখ্যাত জেলহত্যা (১০৮-১০৯)
নতজানু খালেদ(১১০-১১২)
সশস্ত্র শাফায়েতের অনুপ্রবেশ (১১২-১১৪)
৫ নভেম্বর (১১৪-১১৬)
৬ নভেম্বর (১১৬-১১৮)
বঙ্গভবন রাত ১০টা (১১৮)
ক্যান্টনমেন্ট রাত ১১টা(১১৮-১১৯)
বঙ্গভবন রাত ১২টা (১১৯-১২১)
খালেদের ব্যর্থ অভ্যুত্থান- একটি পর্যালোচনা(১২১-১২৪)
৩.
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ(১২৫-১২৭)
মুক্ত জিয়া (১২৭-১২৮)
বন্দী জিয়াকে যেভাবে উদ্ধার করা হলো (১২৮-১৩০)
মধ্যরাতে ক্ষমতার লড়াইয়ের চরম মুহূর্ত (১৩২-১৩৫)
খালেদ আসলেন (১৩৬)
খালেদ যেভাবে মারা গেলেন(১৩৬-১৩৯)
টু -ফিল্ড ব্যারাক (১৩৯-১৪২)
ঢাকা শহরের জনতার উল্লাস (১৪২-১৪৬)
৭/৮ ই নভেম্বর: রক্তাক্ত রাগ(১৪৬,১৫০-১৫১)
৮ই নভেম্বর (১৫১)
খালেদের দাফন(১৫৭)
১০ই নভেম্বর(১৫৮-১৫৯)
কমান্ডার লগ এরিয়া (১৬০)
এবার সেপাই -অফিসার ভাই ভাই (১৬১-১৬২)
এরশাদের আগমন (১৬২-১৬৫)
সংঘর্ষের পথে জিয়া (১৬৫-১৬৯)
আমার পদত্যাগ (১৬৯-১৭২)
ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বর পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন (১৭৩-১৭৮)
বগুড়ার বিদ্রোহ (১৮১-১৮৫)
ঢাকায় অক্টোবর সেনা বিদ্রোহ (১৮৩-১৮৫)
অভ্যুত্থানে যেসব অফিসার মারা গেলেন তারা হলেন(১৮৫)
জিয়ার শুদ্ধি অভিযান (১৮৫-১৮৬)
৪.
জিয়া হত্যাকাণ্ড চট্টগ্রাম সেনা অভ্যুত্থান (১৮৭-১৯০)
বন্দী জেনারেল(১৯০-১৯১)
বইঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা
লেখকঃ লে: কর্ণেল (অব.) এম.এ.হামিদ, পিএসসি
প্রকাশকঃ হাওলাদার প্রকাশনী
মূল্যঃ ২৫০ টাকা।
Md. Helal Uddin
09.08.2024
No comments:
Post a Comment