Monday, March 25, 2024

অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা পদ্ধতি এবং জাতীয় গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি -- মোঃ হেলাল উদিন

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ সারা বাংলায় গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই সাংকেতিক নাম বা কোডনেম দিয়েছিল 'অপারেশন সার্চলাইট'। যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ই মার্চ।

গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ঢাকায় ইতিমধ্যে ডাক দেওয়া হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন, বাংলার আকাশে ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরই মধ্যে ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়ে বলেছেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

মধ্য মার্চে ঢাকায় তখন চলছে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। আলোচনায় অংশ নিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোও ছিলেন ঢাকা শহরে। সব মিলে ঢাকা শহরে খুবই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান ছিলো।

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বাইশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল এমএজি ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্’। তখন ওসমানী পুনরায় তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘কাল তো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কী কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যেকোন মুহূর্তে যেকোন কিছু করতে পারে। তার জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হয় না’। বঙ্গবন্ধু হিসাব করেই তিনি বলেছিলেন পঁচিশে মার্চেই পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করবে।

বঙ্গবন্ধুর অনুমান এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৮ মার্চে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করা ২৫ মার্চের গণহত্যার সেই ভয়াবহ সেনা অভিযানের পরিকল্পনা কীভাবে হয় তার ধারণা পাওয়া যায় সেসময় ঢাকায় দায়িত্বরত পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতিকথা থেকে।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ শিরোনামের একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি’।

পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট। অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা সম্পর্কে খাদিম হুসাইন রাজা তাঁর বইয়ে লিখেছেন, পরিকল্পনার মূল দিকগুলো ছিল এরকম---

* যে কোন ধরণের বিদ্রোহ বা বিরোধিতাকে কঠোরভাবে দমন করা হবে

* সফল হওয়ার জন্য আকস্মিক চমক এবং চাতুরীর গুরুত্ব আছে। সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেও চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে তাদের সাহায্য করার পরামর্শ দিয়েছিল

* বাঙ্গালি সেনা সদস্য ও পুলিশকে নিরস্ত্র করা হবে। বিশেষ করে পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অস্ত্রাগার, রাজারবাগের রিজার্ভ পুলিশ এবং চট্টগ্রামে কুড়ি হাজার রাইফেলের অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ আগেভাগে নিয়ে নেয়া,

* অপারেশন শুরুর সাথে সাথে সব রকমের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে নতুন করে যাচাই-বাছাই করে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হবে

* অস্ত্রশস্ত্র এবং অপরাধীদের খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ঘিরে ফেলতে হবে, এবং তল্লাশি চালাতে হবে

* শেখ মুজিবকে জীবিত অবস্থায় ধরতে হবে। এর বাইরে ১৫ জন আওয়ামী লীগ এবং কম্যুনিস্ট পার্টির নেতার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে হবে, তাদের কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করতে হবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন ব্যারাকে ঘুরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা তদারকি করলেও, অপারেশন সার্চলাইটে অংশ নেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর কারো কাছেই কোন লিখিত অর্ডার পাঠানো হয়নি।

২৫শে মার্চ সকাল ১১টায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান সময় জানিয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইনের কাছে ফোন করে সংক্ষেপে বলেন, ‘খাদিম, আজ রাতেই’। আর সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল রাত ১টা। হিসেব করা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ততক্ষণে নিরাপদে করাচি পৌঁছে যাবেন।

তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়: ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র। কিন্তু এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৭ সাল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫শে মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

 একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার দিনটি জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি দিতে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। অক্সফোর্ড ডিকশনারী অনুযায়ী গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন সংসদে বলেন, ‘জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ গ্রহণ করে। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বরকে ‘জেনোসাইড ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কাজেই আমাদের কাছে সেই সুযোগ রয়েছে, জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী আমরা ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসাবে গ্রহণ করতে পারি।

সংসদ কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) শিরীন আখতারের আনা প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষে সংসদে তা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করলে সংসদ তা পাস করে। পরে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় । দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত দিবস অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করা হয় ।

অন্তর্জাতিক ভাবে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তের ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে এই অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন। এছাড়া সংস্থা দুটি জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এই নৃশংস গণহত্যাকে আরও স্বীকৃতি দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারস (আইএজিএস)। আশাকরা যায়, অদূর ভবিষ্যতে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তের ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। 

 


পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের লিঙ্কঃ 

 অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা পদ্ধতি এবং জাতীয় গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি 

-- মোঃ হেলাল উদিন

Friday, March 22, 2024

এক নজরে বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীসমূহ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

প্রত্যেক দেশের সংবিধানে এর সংশোধনের বিধান থাকে। বাংলাদেম সংবিধানও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করার বিধান রেখেছে। সময়ের চাহিদা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সালে কার্যকর হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংক্ষেপে সংশোধনীসমূহ আলোচনা করা হলো-
 
প্রথম সংশোধনী: সংবিধানের প্রথম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭ অনুচ্ছেদে দুটি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর মূল কারণ ছিল গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য আইন তৈরি এবং তা কার্যকর করা। সংবিধান (প্রথম সংশোধনী) আইন ১৯৭৩ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১২ই জুলাই, ১৯৭৩ সালে।

দ্বিতীয় সংশোধনী: সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২ এ সংশোধন আনা হয়। নিবর্তনমূলক আটক, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও এ সময় মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিতকরণ সম্পর্কে প্রথমদিকে সংবিধানে কোনো বিধান ছিল না। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানগুলো সংযোজন করা হয়। সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধনী) আইন ১৯৭৩ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সালে।

তৃতীয় সংশোধনী: সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান করার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়। সংবিধান (তৃতীয় সংশোধনী) আইন ১৯৭৪ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ২১শে নভেম্বর, ১৯৭৪ সালে।

চতুর্থ সংশোধনী: সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা; একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা; রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রপতি অপসারণ পদ্ধতি জটিল করা; মৌলিক অধিকার বলবৎ করার অধিকার বাতিল করা; উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা এবং বাকশাল গঠন করা হয়। সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন ১৯৭৫ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে।

পঞ্চম সংশোধনী: সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল। পঞ্চম সংশোধনী সংবিধানে কোনো বিধান সংশোধন করেনি। এ সংশোধনী ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে সামরিক শাসন জারির পর থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় আদেশ, ঘোষণা ও দন্ডাদেশ বৈধ বলে অনুমোদন করে নেওয়া হয়। সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন ১৯৭৯ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে। ২০১০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে এ সংশোধনীটি উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়।

ষষ্ঠ সংশোধনী: সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই। ষষ্ঠ সংশোধনী কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে করা হয়নি। এ সংশোধনীর মাধ্যমে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিতকরণ করা হয়। এ সংশোধনীতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী পদকে প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদ বলে গণ্য করা হবে না। সংবিধান (ষষ্ঠ সংশোধনী) আইন ১৯৮১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ১ জুলাই ১৯৮১ সালে।

সপ্তম সংশোধনী: সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল ছিল। তাই এ সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক শাসনামলে জারি করা সব আদেশ, আইন ও নির্দেশকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং আদালতে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করার বিধান করা হয়। এছাড়াও এ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করা হয়। সংবিধান (সপ্তম সংশোধনী) আইন ১৯৮৬ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বিচারপতি কে এম নুরুল ইসলাম ১০ নভেম্বর ১৯৮৬ সালে। ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট এ সংশোধনী আদালতে কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়।

অষ্টম সংশোধনী: সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮৮ সালের ৯ জুন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২, ৩, ৫, ৩০ ও ১০০ এ পরিবর্তন আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতিদান, ঢাকার বাইরে হাই কোর্ট বিভাগের ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, উধপপধ-এর নাম উযধশধ এবং ইধহমধষর-এর নাম ইধহমষধ-তে পরিবর্তন করা হয়। সংবিধান (অষ্টম সংশোধনী) আইন ১৯৮৮ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১১ই মে ১৯৮৮ সালে। তবে হাই কোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করে।

নবম সংশোধনী:
সংবিধানের নবম সংশোধনী পাশ হয় ১৯৮৯ সালের ১০ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সাথে একই সময়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোন ব্যক্তিকে পর পর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ রাখার বিধান সংযোজন করা হয়। সংবিধান (নবম সংশোধনী) আইন ১৯৮৯ উপস্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ৬ জুলাই ১৯৮৯ সালে।

দশম সংশোধনী: সংবিধানের দশম সংশোধনী পাস হয় ১৯৯০ সালের ১২ জুন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরো ১০ বছরকালের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সংবিধান (দশম সংশোধনী) আইন ১৯৯০ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন ও বিচারমন্ত্রী হাবিবুল ইসলাম ১০ জুন ১৯৯০ সালে।

একাদশ সংশোধনী: সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। এ সংশোধনীর মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের স্বপদে ফিরে যাবার বিধান করা হয়। এতে আরো বলা হয়, নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করতে পারবেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কর্মকাল বিচারপতি হিসেবে হিসেবে গণ্য হবে। সংবিধান (একাদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন ও বিচারমন্ত্রী মীর্জা গোলাম হাফিজ ২ জুলাই ১৯৯১ সালে।

দ্বাদশ সংশোধনী: সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২রা জুলাই ১৯৯১ সালে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী: সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয় ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ। এ সংশোধনীর মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নিদর্লীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ২১ মার্চ ১৯৯৬ সালে।

চতুর্দশ সংশোধনী: সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস হয় ২০০৪ সালের ১৬ মে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং সরকারি ও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি বা ছবি প্রদর্শনের বিধান করা হয়। সংবিধান (চতুর্দশ সংশোধনী) আইন ২০০৪ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২৭ মার্চ ২০০৪, দ্বিতীয়বার ২৮ এপ্রিল ২০০৪ সালে।

পঞ্চদশ সংশোধনী: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পূনর্বহাল, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, ১/১১ পরবর্তী দ্বিতীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার নিয়ম বহির্ভুতভাবে ৯০ দিনের অধিক ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি প্রমার্জ্জনা, নারীদের জন্য সংসদে ৫০ টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা, অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দন্ডের বিধান রাখা ইত্যাদি যুক্ত করা হয়। সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন ২০১১ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ ২৫শে জুন ২০১১ সালে।

ষোড়শ সংশোধনী: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন পাস হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আইন প্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয়। সংবিধান (ষোড়শ সংশোধনী) আইন ২০১৪ উপস্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে।

সপ্তদশ সংশোধনী: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন পাস হয় ২০১৮ সালের ৮ জুলাই। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখা হয়। সংবিধান (ষোড়শ সংশোধনী) আইন ২০১৮ উপস্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ৮ জুলাই ২০১৮ সালে।

 


এক নজরে বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীসমূহ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Wednesday, March 20, 2024

বাংলাদেশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

সংবিধান দেশ ও শাসনভেদে ভিন্ন হয়। একটি দেশের সংবিধানের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য দেখে সহজে সেই দেশের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। বাংলাদেশ যেহেতু একটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ, সেই হিসেবে সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হবে মূলত জনগণের অনুকূলে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে রয়েছে-

লিখিত দলিল: বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত দলিল। এর ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এটি ১১টি ভাগে বিভক্ত। এর একটি প্রস্তাবনাসহ সাতটি তফসিল রয়েছে।

দুষ্পরিবর্তনীয়: বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। কারণ, এর কোনো নিয়ম পরিবর্তন বা সংশোধন করতে জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতির প্রয়োজন হয়।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব মূলনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

প্রজাতন্ত্র: সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ক্ষমতা পরিচালনা করবেন।

মৌলিক অধিকার: সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কী কী অধিকার ভোগ করতে পারব তা সংবিধানে উল্লেখ থাকায় এগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

মালিকানার নীতি: বাংলাদেশ সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানার কথা লিপিবদ্ধ আছে। যা বাংলাদেশ সংবিধানের বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে ক. রাষ্ট্রীয় মালিকানা, খ. সমবায় মালিকানা এবং গ. ব্যক্তিগত মালিকানা।

সার্বজনীন ভোটাধিকার: বাংলাদেশের সংবিধানের সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, পেশা নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়সের এ দেশের সকল নাগরিক ভোটাধিকার লাভ করেছে।

সংসদীয় সরকার: বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয়শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার হাতে শাসনকার্য পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। মন্ত্রি পরিষদ তার কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকে।

এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র: বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মতো কোনো অঙ্গরাজ্য বা প্রাদেশিক সরকার নেই। জাতীয় পর্যায়ে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সমগ্র দেশ পরিচালিত হয়।

আইনসভা: বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। এটি সার্বেেভৗম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। এর নাম জাতীয় সংসদ। বর্তমানের জাতীয় সংসদ ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। সংসদের মেয়াদ ৫ বছর।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বাংলাদেশের সংবিধানে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের বিধান রয়েছে।

সর্বোচ্চ আইন: বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে দেশের প্রচলিত কোনো আইনের সংঘাত সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে সংবিধান প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ যদি কোনো আইন সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন হয়, তাহলে ঐ আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততোখানি বাতিল হয়ে যাবে।


বাংলাদেশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Friday, March 8, 2024

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের কথা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 “বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি, চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”


জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘নারী’ কবিতার এই দুই লাইনের মাধ্যমে সহজেই বুঝা যায় বিশ্বের সার্বিক কল্যাণে নারীশক্তি কতোটা অপরিহার্য। বিশ্বে সুস্থ-নিরপেক্ষ সমাজ বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। নারীর এই কাজের স্বীকৃতি এবং সমাজে নারীদের সুস্পষ্ট অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে প্রতিবছর ৮ই মার্চ পালিত হয় “আন্তর্জাতিক নারী দিবস”। বিশ্বের বিভিন্ন দেশজুড়ে ১৯১৪ সাল থেকে এ দিবসটি পালিত হলেও জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো নারী ও পুরুষের সমঅধিকার আদায়।


নারীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অর্জনকে স্মরণ করার জন্য এবং তাঁদের উৎসাহিত করে তোলার জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। নারী দিবসের মাধ্যমে জেন্ডার সমতা, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা, নারী-পুরুষের একতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ ইত্যাদির উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কেননা নারীদের কৃতিত্ব ও অবদান পৃথিবীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো অংশেই কম নয়। বর্তমান বিশ্বে নারীরা গৃহিনী হতে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ নানান ক্ষেত্রে কর্মরত। কিন্তু ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা যায়। বিশেষ করে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তেমনভাবে এখনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না, অথচ নারীর সুস্থতায় পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সুস্থতা।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে মানসিক সমস্যার প্রাদুর্ভাব বেশি এবং নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন নারী কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। নারীদের সাধারনত একান্ত নিজস্ব যে মানসিক সমস্যাগুলো হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গর্ভকালীন বিষন্নতা, মাসিকের আগে ও পরে ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন হওয়া, মেনোপজের আগে ও পরে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়া ইত্যাদি। তবে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তা হল- হতাশা এবং উদ্বেগ। যা নারীদের বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা নারীদের এই মানসিক সমস্যাগুলোকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজ এড়িয়ে যেতে চায় এবং কম গুরুত্ব দেয়।


বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে বোঝা যায় যে একজন নারীর মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ্ (National Institute of Mental Health -NIMH) এর মতে, একজন নারীর মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে কিনা তা বুঝার , বিভিন্ন উপসর্গের মধ্যে রয়েছে-

১. প্রতিনিয়ত দুঃখ বা হতাশার অনুভূতি
২. মাদকাসক্তি
৩. অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যালকোহল পান করা
৪. খাওয়া ও ঘুমের অভ্যাসের আকস্মিক পরিবর্তন
৫. ক্ষুধা কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া
৬. প্রতিনিয়ত ক্লান্ত অনুভব করা
৭. হ্যালুসিনেশন হওয়া
৮. ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন
৯. শারীরিক কোনো সমস্যা ছাড়াই মাথাব্যাথা ও হজমের সমস্যা
১০. নিজেকে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে গুটিয়ে নেওয়া
১১. আত্মহত্যা করার প্রবনতা।
 
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় কিছুটা কঠিন কেননা আমাদের সমাজে নারীদের বরাবরই উপেক্ষিত, যদিও মানসিক স্বাস্থ্য প্রত্যেকের জন্যই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের এই মানসিক সমস্যাগুলো কিছুটা কমানোর জন্য বা রোধ করবার জন্য দৈনন্দিন কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করা প্রয়োজন। যেমন-
 
১. স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য গ্রহন,
২. নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস,
৩. মাদক ও এলকোহল আসক্তি থেকে দূরে থাকা,
৪. নিয়মিত শরীরের যত্ন নেওয়া,
৫. পরিমিত পরিমাণে ঘুমানো,
৬. পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে সুন্দর সময় কাটানো,
৭. যেকোনো মানসিক সমস্যা হলে চিকিৎসক বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া।
 
নারীদের যেকোনো মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে নিজেকে সবার আগে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং কুসংস্কার থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। বর্তমানে আমাদের সমাজের শিক্ষিতজনদের মাঝে অনেকেই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলোকে সবার মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন এবং এ বিষয়ে সবাইকে অবহিত করছেন। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে সবাই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন এবং সমাজে সমতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল নারীর প্রতি শুভেচ্ছা।
 
 

পত্রিকায় প্রকাশিত লিঙ্কঃ