Monday, September 16, 2024

মুসলিম উম্মাহর অনুকরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মুহাম্মাদ (স) -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

‘অ্যাইয়ামে জাহিলি’ যুগ হিসাবে পরিচিত সময়ে সবাই ধর্মহীন জীবনে নিমজ্জিত ছিলো। যেখানে কোথাও শান্তি ছিলো না। সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করত। মানুষ ছিল হতাশাগ্রস্থ। তখন এই অন্ধকারাচ্ছন্ন, হতাশাগ্রস্থ মানুষ জাতির মুক্তির জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একজন আর্দশবান মানুষের। মহান আল্লাহ তাআলা আর্দশ মানুষ হিসাবে হযরত রাসুল (স) কে নির্বাচন করেন এবং কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭) এবং ‘তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে; যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে।' (সুরা আহজাব : আয়াত ২১) এই আর্দশ মানুষটির মাঝে অনেক গুনের সমাবেশ রয়েছে। চারিত্রিক বৈশিষ্টে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ মহামানব। আর্দশের দিক দিয়ে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায়, দেশ, কাল সর্বক্ষেত্রে ছিলেন আর্দশের প্রতীক। মোটকথা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব কথা ও কাজ ছিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। দুনিয়ার জীবনের উন্নত দিকনির্দেশনা। তাঁর অসংখ্য আদর্শের মধ্যে জীবনঘনিষ্ঠ কিছু আদর্শ তথা উপদেশের মধ্যে রয়েছে-

* সালাম দেয়া
প্রিয় নবী (স) সবাইকে আগে আগে সালাম দিতেন। সাধারণ কেউ তাকে আগে সালাম দিতে পারতেন না। এটি ছিল বিশ্বনবীর অন্যতম শিক্ষা। এ কারণেই তিনি বলেছেন- ‘কথা বলার আগে সালাম দাও।’

* আল্লাহকে বেশি স্মরণ করা

আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নই ছিল বিশ্বনবীর মিশন। তিনি সব সময় সব কাজে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতেন এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে বলতেন। আল্লাহর নির্দেশ- ‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো আর আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫২) - হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ কর।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৪১)

* নামাজ পড়া
নামাজ ছিল প্রিয় নবীর জীবনের শ্রেষ্ঠ ইবাদাত ও আদর্শ। এমনকি তিনি যখন কোনো বিপদে পড়তেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আবার কোনো কারণে কষ্ট বা হতাশা বা চিন্তাগ্রস্ত হলেও তিনি তাৎক্ষণিক নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামকে বিশেষভাবে (রাতে) তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘হে চাদর আবৃত, রাতের সালাতে দাঁড়াও; কিছু অংশ ছাড়া।’ (সুরা মুজাম্মিল : আয়াত ১-২)

* মুচকি হাসি
রাসুলুল্লাহ (স) কম হাসতেন এবং মুচকি হাসি হাসতেন। এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। হাদিসে এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, সৎ আমলের কোনো কিছুকেই তুচ্ছ মনে করো না, যদি তা (সৎ আমলটি) তোমার নিজের ভাইয়ের সঙ্গে মুচকি হাসি দিয়ে মিলিত হওয়ার দ্বারাও হয়। (মুসলিম শরীফ)

* প্রতিশোধ পরায়ন না হওয়া
কারো প্রতি প্রতিশোধ না নেয়া ছিল বিশ্বনবীর অন্যতম আদর্শ। কেউ অপরাধ করে থাকলে ধৈর্যধারণ করাও শ্রেয়। রাসুলুল্লাহ (স) নিজের জন্য কখনোই প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। এমন কি রাসুলুল্লাহ (স) কখনো কাউকে আঘাত করতেন না। শারীরিক আঘাত তো দূরের কথা তিনি কথা বা আচরণ দিয়েও কাউকে কষ্ট দিতেন না।

* শিশুদের স্নেহ করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমলমতি শিশুদের বেশি স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, এক ব্যক্তি একটি শিশু নিয়ে বিশ্বনবীর খিদমতে এসে শিশুটিকে চুমু দিতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (স) এ দৃশ্য দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, শিশুটির প্রতি কি তোমার দয়া জেগে উঠেছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ’, হে আল্লাহর রাসুল! তারপর রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়া করেন। কেননা তিনি দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (বুখারি)

* পরিবারের সঙ্গে কোমল আচরণ
রাসুলুল্লাহ (স) নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোমল আচরণ করতেন। এবং অন্যদেরকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোমল ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। খাবার-দাওয়া, কেনা-কাটা, সাংসারিক কাজে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ও উত্তম জিনিস দেয়াকে উত্তম ইবাদত ও খরচ বলে উল্লেখ করেছেন।

* মিথ্যা পরিহার করা
মিথ্যা সব পাপের মূল। রাসুলুল্লাহ (স) সব সময় মিথ্যা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। তিনি মিথ্যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন।

* সাদকা বা দান করা
রাসুলুল্লাহ (স) বেশি বেশি সাদকা করতেন। ইসলামের জন্য সাদকা করতে হজরত খাদিজা (রা) তার সমূদয় সম্পদ প্রিয় নবীকে দিয়েছিলেন। আর তিনি তা দ্বীনের পথে ব্যয় করেছেন। বেশি বেশি সাদকা বা দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (স) এর কাছে যখন কোনো সাদকা আসতো তিনি তা সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কেননা তিনি সাদকা খেতেন না।

* ক্ষমা করা
ক্ষমা মহান আল্লাহ তাআলার অন্যতম গুণ। রাসুলুল্লাহও (স) ক্ষমা করতে ভালোবাসতেন। হাদিসে প্রিয় নবী (স) ক্ষমার ব্যাপারে এভাবে দোয়া করতেন এবং তাঁর উম্মতেকে দোয়া করতে বলতেন- অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)

* কাউকে অবহেলা না করা
রাসুলুল্লাহ (স) কখনো কাউকে অবহেলা করতেন না। কারো মর্যাদা বিনষ্ট হোক এটা তিনি কামনা করতেন না। সবার প্রতি তিনি উদার ছিলেন। বিশেষ করে তার কাছে আসা সব ব্যক্তিকেই তিনি সমাদর করতেন, গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের কথা শুনতেন।

* সুস্পষ্ট কথা বলা
রাসুলুল্লাহ (স) ছিলেন সুস্পষ্টভাষী। তিনি ছিলেন সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। সত্যের মানদণ্ডে তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী। কথা বলার সময় তিনি সুস্পষ্টভাষায় কথা বলতেন। এমন কেউ ছিলেন না যিনি প্রিয় নবীর কথা বুঝতেন না।

* অনাড়ম্বরতা
সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়েও তিনি বিলাশসতামুক্ত অত্যন্ত সাদা-মাটা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স) গাছের লতা-পাতা দিয়ে তৈরি করা বিছানায় ঘুমাতেন। এতে তার শরীর মুবারকে দাগ হয়ে যেত। সাহাবারা ভালো কোনো বিছানার ব্যবস্থা করার আবদার জানালে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলতেন, ‘আমার দুনিয়ার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। আমি দুনিয়াতে একজন পথচারী ছাড়া আর কিছুই নই। যে পথচারী একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে একটু পরে সেটা ছেড়ে চলে যায়।’ (তিরমিজি)

সুতরাং বিশ্ববাসীর উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাঁর রেখে যাওয়া জীবনাচারে সবার জীবন সাজানো। আর তাতেই মিলবে মহান আল্লাহর ভালোবাসা, সন্তুষ্টি। থাকবে গোনাহ মাফের হাতছানি।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবীর এ গুণগুলো যথাযথভাবে মেনে চলার তাওফিক দান করুন। বিশ্বনবীর আদর্শে নিজেকে রাঙিয়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

মুসলিম উম্মাহর অনুকরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মুহাম্মাদ (স) 

(মোঃ হেলাল উদ্দিন– শিক্ষক, লেখক ও গবেষক)

 

Sunday, September 15, 2024

ক্রোধ বা রাগ মানুষের জন্য বহু অনিষ্টের কারণ -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

ক্রোধ বা রাগ মানুষের জন্য বহু অনিষ্টের কারণ। রাগের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয় আবার এ রাগই মানুষকে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত করে দেয়। রাগ এমন এক জিনিস; যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ জন্য রাগ বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণকারীকে হাদিসে বীর পুরুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি বীর পুরুষ নয় যে অন্যকে ধরাশায়ী করে; বরং সেই প্রকৃত বীর যে রাগ বা ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
এ রাগের ফলে মানুষ অনেক নির্দয় ও অত্যাচারমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে যার জন্য লজ্জিত হতে হয় আবার ক্ষেত্র বিশেষ অনেক কঠিন খেসারত দিতে হয়। তাই মানুষের উচিত কোনো অবস্থাতেই রাগ বা ক্রোধ প্রকাশ না করা।
মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় একজন আরেকজনকে ক্ষমা করে দেয়া সহজ ব্যাপার; কিন্তু রাগের সময় ক্ষমা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রকৃত মুমিন যারা তারা রাগের সময়ও অন্যকে ক্ষমা করে দেয়। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রশংসায় বলেন, ‘এবং যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখনও তারা ক্ষমা করে দেয়।’ (সুরা শুরা : আয়াত ৩৭)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে রাগ থেকে নিজেদের হিফাজত করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। বর্তমান সময়ে চিকিৎসক ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিগণ যে উপদেশগুলো মানুষকে দিয়ে থাকেন, তার মধ্যে রাগ থেকে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা অন্যতম। রাগের কারণে মানুষের দ্বারা অত্যাচার থেকে শুরু করে অধিক উত্তেজিত হওয়ার ফলে জীবনহানির সম্মুখীন হয়।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ওসিয়ত (উপদেশ) করুন। তিনি বললেন, রাগ করবে না। লোকটি বারবার তার কথাটি বলতে থাকলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও একই জবাব দিলেন এবং বললেন রাগ করবে না।’ (বুখারি, মিশকাত)
রাগ বা ক্রোধ থেকে বেঁচে থাকতে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাগ বা ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি দ্বারা ঠাণ্ডা বা নিভানো যায়। যদি কেউ রাগ বা ক্রোধান্বিত হয়; তবে তার উচিত অজু করে নেয়া। (আবু দাউদ, মিশকাত)
অন্য হাদিসে হজরত আবু যর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যদি দাঁড়ানো অবস্থায় কেউ রাগ বা ক্রোধান্বিত হয়, তবে সে যেন বসে যায়। এতেও যদি তা প্রশমিত না হয় তবে সে যেন শুয়ে পড়ে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)
পরিশেষে, সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনে দুনিয়া ও পরকালের শান্তি ও কল্যাণ লাভে সর্বাবস্থায় রাগ বা ক্রোধ থেকে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অযথা রাগের কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।
রাগের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বনবির ছোট্ট একটি হাদিসই যথেষ্ট। আর তা হলো- ‘রাগ মানুষের ঈমানকে নষ্ট করে দেয় যেমনিভাবে তিক্ত ফল মধুকে নষ্ট করে দেয়।’ (বাইহাকি, মিশকাত)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রাগ বা ক্রোধের অনিষ্ট থেকে হিফাজত করুন। সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন গঠন এবং ঈমান রক্ষায় আত্মনিয়োগ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।।

ক্রোধ বা রাগ মানুষের জন্য বহু অনিষ্টের কারণ 

-- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Tuesday, August 27, 2024

বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ – মোঃ হেলাল উদ্দিন

বিশ্ব ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন সব সময় সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে। বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তাদের সংগ্রাম এবং ত্যাগের মাধ্যমে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাঠামতে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে এবং এর প্রভাব বর্তমান সময়েও বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসের এবং বাংলাদেশে পরিবর্তন নিয়ে আসা সেই সকল আন্দোলনের কথা নিয়েই আজকের এই লেখা।

প্রথম ছাত্র আন্দোলন

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয় চীনে। ১৬০ খ্রিস্টাব্দে চীনের ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এমন কয়েকজন ছাত্রনেতা, যারা মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং ইমপেরিয়ালে পড়তে এসেছেন তুলনামূলক গরিব পরিবার থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেই আন্দোলন সেদিন ছুঁয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষকেও। ছাত্রদের দেখাদেখি সেদিন সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে স্লোগান দেয় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। সরকার এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে এবং ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সরকারি কারাগারে তাদের ভোগ করতে হয় অমানুষিক নির্যাতন আর নিগ্রহ।

ফরাসি বিপ্লব ও বোহেমিয়ান বিদ্রোহ

ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা রাজা ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং তারা নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। এছাড়া তারা তাদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে।

হোয়াইট রোজ আন্দোলন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ গ্রুপ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন, যার নাম রাখা হয়েছিল হোয়াইট রোজ বা শ্বেত গোলাপ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় হিটলার ও নাৎসি বিরোধী বিভিন্ন  স্লোগান। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে হোয়াইট রোজ আন্দোলন ৬টি লিফলেট প্রকাশ করে। এর মধ্যে চতুর্থ লিফলেটটিতে লেখা হয়েছিল- ‘আমরা চুপ করে বসে থাকব না। আমরা তোমার মন্দ বিবেক। হোয়াইট রোজ তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।’ এই লিফলেটগুলো তারা অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক এবং ফোনবুকের ঠিকানা ধরে ধরে ডাকে পাঠাতেন। এছাড়া ফোনের বুথে বুথে রেখে আসতেন, যেন এগুলো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়। ১৯৪৩ সালে এই গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচার শেষে ছয়জন প্রধান সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নাৎসি শাসনে এই আন্দোলন বড় কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও ছাত্রদের এই সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিনে কিছুটা হলেও ফাটল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

গ্রিনসবোরোর অবস্থান ধর্মঘট

১৯৬০ সালে ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার উলওর্থ লাঞ্চ কাউন্টারে সাদা-কালো ভেদাভেদের প্রতিবাদে নর্থ ক্যারোলিনার এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্টে ইউনিভার্সিটির চারজন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। অবস্থান ধর্মঘটে অংশ নেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ ওই চার হলেন- ১৮ বছর বয়সী ইজেল ব্লেয়ার জুনিয়র, ১৯ বছরের ফ্রাঙ্কলিন ম্যাককেইন, ১৭ বছরের জোসেফ ম্যাকনেইল এবং ১৮ বছরের ডেভিড রিচমন্ড। ধর্মঘট শুরু করার মাত্র তিন দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে আরও অন্তত ৩০০ শিক্ষার্থী এসে যোগ দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরও ৫০-এর অধিক শহরে এ ধরনের অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয় । যার ফলস্বরূপ খুব শিগগিরই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাঞ্চ কাউন্টারগুলোতে বর্ণপ্রথা রহিত করা হয়। এক পর্যায়ে ওই চার শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে আন্দোলনের এক অহিংস ছাত্র সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয় এবং এই কমিটি পরবর্তী সময়ে যানবাহনে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণসহ এবং দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত করায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন পাস হয়, যা মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একটি মাইলফলক ছিল। ২০০৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করা চার শিক্ষার্থীর একজন ম্যাককেইন বলেন, “অনিবার্যভাবেই লোকজন প্রায়ই আমাকে বলে- ‘আমি এখন কী করব’?’’- আমি বলে উঠি, ‘এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তোমার চারপাশে তাকাও। একসময় তুমিই দেখতে পাবে- তুমি কী করতে চাও। সাধারণ মানুষের কাছে কখনো প্রত্যাশা কোরো না। কারণ, তারা আসবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয় জাগরণ

১৯৬৮ সালে একাধিক মহাদেশে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার সবগুলো সফল না হলেও এসব আন্দোলন পরবর্তী অনেক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। এ বছরের মার্চ মাসে ওয়াশিংটনের কৃষ্ণাঙ্গ হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। তাদের প্রথম দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ারম্যানের পদত্যাগ, দ্বিতীয়ত- পাঠ্যক্রমে আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসে জোর দেওয়া, তৃতীয়ত- ছাত্রদের অংশগ্রহণে একটি বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা তৈরি এবং চতুর্থত- ইতিপূর্বের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ তৃতীয় এবং চতুর্থ দাবিটি মেনে নেয়। এর এক মাস পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও হারলেমের মর্নিংসাইড পার্কে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমে স্থানীয় বাসিন্দাদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অস্ত্র গবেষণা থিংকট্যাংকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিয়েতনাম যুগের একটি চুক্তি বাতিল করতে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ভবন দখলে নেয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রায় হাজার খানেক পুলিশ তাদের উচ্ছেদ করার জন্য নির্মম হামলা চালালেও শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সেমিস্টারজুড়েই তাদের আন্দোলন চালিয়ে যান এবং বিভিন্ন ভবন দখলমুক্ত করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডে ছাত্র অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৩০০ শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করেন। মার্চ মাস নাগাদ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার। তবে, দেশটির সরকার এই আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত দমন করতে সক্ষম হয় । একই বছরের মে মাসে ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সরবোনে এই দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। ফ্রান্সের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোসহ শিক্ষকরাও ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন করে ২৪ ঘণ্টার এক ধর্মঘট আহ্বান করেন। টানা কয়েকদিনের আন্দোলনে দেশবাসী নাকাল হলেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের গদি টলাতে ব্যর্থ হন আন্দোলনকারীরা। তবে এই আন্দোলন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন

১৯৭০ এবং ১৯৮০’র দশক জুড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েতোর পাবলিক স্কুলগুলোতে বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন জোহানেসবার্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দেশটির তৎকালীন সরকারের একটি শিক্ষানীতির পরিবর্তন। যে শিক্ষানীতিতে বলা হয়, শুধু শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি শিখতে পারবে। আর কালোদের পড়ানো হবে আফ্রিকান ভাষায়। এই বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরা উন্নততর শিক্ষা পাবে, পৃথিবী তাদের সামনে খুলে  যাবে, আর কালো শিক্ষার্থীরা বন্দি থাকবে আফ্রিকান ভাষার শেকলে, তা হতে পারে না। ঠিক করা হলো- এক মৌন মিছিল হবে সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকবে– ‘অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’, ‘আমরাও ইংরেজি পড়তে চাই’ ইত্যাদি  স্লোগান। মিছিল চলাকালে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়। কিন্তু শিক্ষর্থীরা নির্ভয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এ অবস্থায় গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলি খেয়ে প্রথমেই লুটিয়ে পড়েন হেক্টর পিটারসন নামে ১১ বছরের এক কিশোর। শোভাযাত্রা সেদিনের মতো পন্ড হয়ে গেলেও এটি এক দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে রূপ নেয়। আফ্রিকায় শুরু হয়ে যায় ভাষা বিপ্লব। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ১৯৯৪ পর্যন্ত চলেছিল। দীর্ঘ ১৮ বছরের এই আন্দোলনই দেশটির বর্ণবিদ্বেষী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সুদীর্ঘ এই আন্দোলনে দেশটির অন্তত ৫৭৫ জন নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর প্রাণ দিয়েছিল।

তিয়েন আনমেন স্কোয়ার আন্দোলন

১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল চীনের সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শোভাযাত্রা নিয়ে তিয়েন আনমেন স্কয়ারে একত্রিত হয়ে সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের অধিকারের বিষয়ে দাবি তোলেন। পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে প্রায় ১০ লাখ লোক সমবেত হন। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন, চীনা সেনাবাহিনী তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে সমবেত মানুষের ওপর গুলি চালায় এবং এতে কয়েকশো মানুষ নিহত হন। ঠিক কতজন সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তার সংখ্যা কখনও প্রকাশিত হয়নি। এই আন্দোলনের পর চীনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না এলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় কিছুটা উদারনীতি গ্রহণ করা হয়।

ভেলভেট রিভল্যুশন

১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়ার ৮ দিন পর, চেকোস্লোভাকিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রাগ শহরে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী দিয়ে প্রাগ শহরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ৫ লাখ মানুষের বিশাল এক গণসমুদ্রে পরিণত হয়। দাঙ্গা পুলিশ বারবার আক্রমণ চালাতে উদ্যত হলেও আন্দোলনকারীরা তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এই আন্দোলনের ফলে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল ইতিহাসের এক ব্যতিক্রম আন্দোলন। লেখক টিমোথি গার্টেন অ্যাশ-এর ভাষ্যে আন্দোলনটি ছিল ‘দ্রুততম, কোনো মারামারি কাটাকাটি ছাড়া, আনন্দময় এবং হাস্যরসপূর্ণ।’ আধুনিক সময়ের কোনো ছাত্র আন্দোলনই এমন সফল এবং সুকোমল হতে পারেনি।

ইরানের ছাত্র বিক্ষোভ

১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর ৮ জুলাই মাঝ রাতের পর ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে পুলিশের অভিযান এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলার পর ইরানের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভে অংশ নেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়া ১২৫ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে সরকারি বাহিনী। কিন্তু তারপরও অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী ইরানের রাজপথে নেমে আসেন। এই আন্দোলনে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পুলিশি অভিযানের সমালোচনা করে এবং সংযমের আহ্বান জানান। ইরানের রাজনীতিতে এই আন্দোলনের ফলে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসে। ইরানের সাধারণ মানুষ সরকারি নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে নীরবে জীবন অতিবাহিত করলেও দেশটির শিক্ষার্থীরা এখনো যে কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদী অবস্থান নেন।

 

যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে ছাত্ররাই অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নানান গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসহ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বাংলাদেশের ছাত্ররা। যার মধ্যে অন্যতম আন্দোলনগুলো হলো-

ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ এর দেশভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে আন্দোলনের শুরু হলেও চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নামলে ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে শাসকরা। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা।

শিক্ষা আন্দোলন

আইয়ুব খান সরকারের গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকট হয়। এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ১৯৬২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে ফেব্রুয়ারি জুড়ে আন্দোলন চাঙা হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আগস্টে ছাত্র ধর্মঘট ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সেপ্টেম্বর আন্দোলন পরিণতির দিকে যায়। এতে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। হরতালের মিছিলে পেছন থেকে পুলিশ ও ইপিআর আক্রমণ করে এতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত, অনেক আহত এবং শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়।

গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

স্বাধীন দেশের ছাত্ররা ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ঘটান। নূর হোসেন শহীদ হলে এই আন্দোলন চূড়ান্তরুপ পায়। যার বুকে-পিঠে লেখা ছিলো ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এই আন্দোলনে ছাত্ররা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন নিশ্চিত করে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন

সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ২০১৮-এর এপ্রিলের পূর্বে এবং বিগত কয়েক বছর বিচ্ছিন্নভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন চললেও, তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে এসে সারা দেশব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে। ৮ই এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে কোটা সংস্কারের পক্ষে বিক্ষোভ শুরু হয়ে আস্তে আস্তে সেটি বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই ২০১৮ রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় এবং ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চলে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের দমনপীড়নমূলক ব্যবস্থা দেশে ও বহির্বিশ্বে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়। পরবর্তীতে ৬ আগস্ট শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়; যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদন্ড দাবি করেছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয় যা "বাংলা ব্লকেড" কর্মসূচি নামে পরিচিত। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দেয়। ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। আন্দোলনকারীরা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে। ২১ জুলাই ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি পালন করে। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে ঘিরে ৪ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ৯৮ জনের বেশি সাধারন মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন এবং এরই সাথে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময় শাসনের অবসান হয়।


(মোঃহেলাল উদ্দিন – শিক্ষক, লেখক ও গবেষক)

  পত্রিকার লিঙ্কঃ বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ (ভোলার খবর)

পত্রিকার লিঙ্কঃ বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশ (বাহান্ন নিউজ)

 

Sunday, June 23, 2024

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী: প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্ত এবং পর্যালোচনা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন


 Kushtia College Journal Vol.1, Issue 1&2 
ISSN 3006 -1741 
Pp.39-45 

'সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী: প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্ত এবং পর্যালোচনা' প্রবন্ধটি পড়তে

Click Here

Monday, May 6, 2024

নৈতিকতার ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Morality। ইংরেজি Morality শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Moralitas থেকে, যার অর্থ ‘সঠিক আচরণ বা চরিত্র’। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল সর্বপ্রথম নৈতিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। সক্রেটিস বলেছেন, “সৎ গুণই জ্ঞান” (Virtue is knowledge)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বোধের উৎস, হচ্ছে ‘জ্ঞান’ (knowledge) এবং অন্যায়বোধের উৎস হচ্ছে ‘অজ্ঞতা’ (ignorance)। পরবর্তীতে রোমান দার্শনিকরা প্রথাগত আচরণের অর্থে mas কথাটি ব্যবহার করেন। ল্যাটিন এই mas শব্দ থেকেই Morals Morality শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।

নীতিবিদ ম্যুর বলেছেন, ‘শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।’

জোনাথান হেইট (Jonathan Haidt) মনে করেন, ‘ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ- এই তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।’

নৈতিকতার সংজ্ঞায় Collins English Dictionary - তে বলা  হয়েছে, Morality is concerned with on negating to, human behavior, esp. the distinction between good and bad and right and wrong behavior.

নৈতিকতা সম্পর্কে অধ্যাপক নিউনার ও কিলিং বলেন, ‘নৈতিকতা হলো বিজ্ঞান ও দর্শনের সেই সকল কাজ যা মানুষের নৈতিক আচরণ, কর্তব্য এবং বিচার বিবেচনা বিশ্লেষণ করে।’

Cambridge International Dictionary of English - তে বলা হয়েছে, নৈতিকতা হলো ‘ভালো-মন্দ আচরণ, স্বচ্ছতা, সততা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি গুণ, যা প্রত্যেক ব্যক্তিই আইন কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।’

মানুষের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বা অনুভূতি থেকে নৈতিকতা বা নীতিবোধের বিকাশ ঘটে। শুধুমাত্র আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানই নাগরিক জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্যই আর. এম. ম্যাকাইভার বলেছেন, ‘Law, does not and can not cover all grounds of morality’।

নৈতিকতার পিছনে সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সমর্থন বা কর্তৃত্ব থাকে না। নৈতিকতা মূলত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাপার। নৈতিকতা বা ন্যায়নীতিবোধের ধারণা বা এর প্রতি যে দেশের জনগণের শ্রদ্ধাবোধ বেশি এবং যে রাষ্ট্রের মানুষের নৈতিক মান সুউচ্চ, সেদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ।

 

নৈতিকতার ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

মূল্যবোধের ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

মূল্যবোধের ধারণা

যে চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি। সমাজবিজ্ঞানীরা মূল্যবোধকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেনÑ
এম. ডবিøউ. পামফ্রে বলেন, ‘মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি বা সামাজিক দলের অভিপ্রেত ব্যবহারের সুবিন্যস্ত প্রকাশ।’
স্টুয়ার্ট সি. ডড এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হলো সে সব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং সমাজ ব্যক্তির নিকট থেকে লাভ করে।’
সমাজবিজ্ঞানী স্কেফার বলেন, ‘ভালো বা মন্দ, ঠিক বা বেঠিক এবং কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের বিদ্যমান ধারণার নাম হলো মূল্যবোধ।’
ক্লাইড ক্লুখোন এর মেত, সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব প্রকাশ্য ও অনুমেয় আচার-আচরণের ধারা যা ব্যক্তি ও সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত।’
নিকোলাস রেসার বলেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধ সেসব গুণাবলির, যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি
মোটকথা, মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি মানবিক গুণাবলীর সমষ্টি।

মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য

সামাজিক মূল্যবোধের কতিপয় বৈশিষ্ট্য হলো-
    মূল্যবোধ হচ্ছে সামাজিক মাপকাঠি। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মকান্ডের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।
    মূল্যবোধ সমাজের মানুষের মধ্যে যোগসূত্র ও সেতুবন্ধন স্থাপন করে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে।
    মূল্যবোধ এক প্রকার সামাজিক নৈতিকতা। এটা আইন নয়, এর বিরোধিতাও বেআইনি নয়।
    দেশ, জাতি, সমাজ ও প্রকৃতিভেদে মূল্যবোধ পরিবর্তন হয়।
    মূল্যবোধ নৈর্ব্যক্তিক। বর্তমানের অনেক মূল্যবোধ ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। যেমন অতীতে অনেক কিছু বর্তমানে নেই।
    মূল্যবোধ বৈচিত্রময় ও আপেক্ষিক।

মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগ

সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যার মধ্যে অন্যতম হলো-
 

সামাজিক মূল্যবোধ 

সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা গুণাবলির সমষ্টি।
নিকোলাস রেসার-এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব গুণাবলি যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে মূল্যবান মনে করে খুশি হয়।’
ক্লাইড ক্লখোন- এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব প্রকাশ্য ও অনুমেয় আচার-আচরণের ধারা যা ব্যক্তি ও সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত।’
স্টুয়ার্ট সি. ডড- এর মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হলো সে সব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে।’
সুতরাং বলা যায়, যে সকল চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামাজিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তার সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে।

রাজনৈতিক মূল্যবোধ 

রাজনৈতিক সততা, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ, রাজনৈতিক সহনশীলতা, রাজনৈতিক জবাবদিহিতার মানসিকতা, দায়িত্বশীলতার নীতি কার্যকর করা, পরমতসহিষ্ণুতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রতি সংখ্যালঘিষ্ঠের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান, সংখ্যালঘিষ্ঠের মতের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সহিষ্ণু আচরণ, বিরোধী মতকে প্রচার ও প্রসারের সুযোগ প্রদান, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বাধা প্রদান না করা, নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে মেনে নেয়া, আইনসভাকে কার্যকর হতে সাহায্য করা ইত্যাদি হলো রাজনৈতিক মূল্যবোধ।
মোটকথা হলো, যে চিন্তাভাবনা লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের রাজনৈতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে রাজনৈতিক মূল্যবোধ বলে।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ 

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেসব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার ও দৈনন্দিন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে অন্যের মতামত ও মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। গঠনমূলক সমালোচনা করার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা ও সংযম গড়ে তুলতে হবে। শৃঙ্খলাবোধে বিশ্বাসী হতে হবে। দায়িত্ব, অধিকার ও কর্তব্য সচেতন হতে হবে। সরকারকে তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ বা মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও নয়, বরং আইনসভায় বসে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

ধর্মীয় মূল্যবোধ 

সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, অপরের ধর্মমতকে সহ্য করা, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মকর্মে বাধা না দেয়া, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ধর্মকে বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করাই হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ। মোটকথা, যে সব ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-আচরণ ধর্মীয় কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ 

যে সব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বলে। সমাজে বসবাসকারী মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার, কর্মকান্ড ও সংগঠন থাকতে পারে। সেগুলোর প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি চর্চা, আকাশ-সংস্কৃতির মন্দ দিকগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে। তবে দেশীয় সংস্কৃতির লালন-পালনে রাষ্ট্রের কোন ধরনের বাধা দেয়া উচিত নয়।

নৈতিক মূল্যবোধ 

সত্যকে সত্য বলা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা, অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং অন্যকে বিরত রাখতে পরামর্শ প্রদান করা, দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অসহায় ও ঋণগ্রস্ত মানুষকে ঋণমুক্ত হতে সাহায্য করাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলা যেতে পারে।
মোটকথা, নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব মনোভাব এবং আচরণ যা মানুষ সবসময় ভালো, কল্যাণকর ও অপরিহার্য বিবেচনা করে মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করে। নীতি ও উচিত-অনুচিত বোধ হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস। শিশু তার পরিবারেই সর্বপ্রথম নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা পায়।

অর্থনৈতিক মূল্যবোধ 

মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো রয়েছে অর্থনৈতিক জীবন। অর্থনৈতিক জীবনে তাকে কিছু কাজ-কর্ম করতে হয়, বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হয়, যার সমষ্টিই হলো অর্থনৈতিক মূল্যবোধ।
আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ (ঝঢ়রৎরঃঁধষ ঠধষঁবং)
মানুষের কিছু আধ্যাত্মিক বা আত্মিক মূল্যবোধ রয়েছে। আত্মিক মূল্যবোধ সহজাত। এজন্যই মানুষ ভালোভাবে, সৎভাবে বাঁচতে চায়, সৎ থাকতে চায় এবং সৎ মানুষকে পছন্দ করে, মিথ্যেবাদী ও অসৎ মানুষকে ঘৃণা করে, ভালো কাজ করতে পারলে মনে স্বস্তি ও তৃপ্তিবোধ করে।

আধুনিক মূল্যবোধ

পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। এজন্যই অতীতের অনেক মূল্যবোধ এখন অর্থহীন। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। এগুলো বর্তমান সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। এভাবেই সময়ের সাথে মূল্যবোধও পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

 

মূল্যবোধের ধারণা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন


সুশাসনের ধারণা - মোঃ হেলাল উদ্দিন

সুশাসনের ধারণা

মানব সভ্যতার বিবর্তনের ফসল হলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। এই সংগঠনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এক সময় গড়ে উঠে শাসন ব্যবস্থা। শুরুতে সমাজ ও রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমানে জনকল্যাণই রাষ্ট্রের মূখ্য উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হয়। তাই শাসনের পরিবর্তে সুশাসনের প্রয়োজন হয়।


‘সুশাসন’ বা ‘
Good Governance’ সম্পর্কে জানতে প্রথমেই জানা প্রয়োজন ‘শাসন’ বা ‘Governance’ বলতে কী বুঝায়। ‘গভর্নেন্সকে’ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘শাসনের ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ল্যান্ডেল মিলস এবং সেরাজেল্ডিন (Landell Mills and Serageldin)-এর মতে, “জনগণ কীভাবে শাসিত হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পরিচালিত হয়, কীভাবে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় এবং একই সাথে এ সকল প্রক্রিয়া কীভাবে লোকপ্রশাসন ও আইনের সাথে সম্পর্কিত সে বিষয়কেই ‘গভর্নেন্স’ বা শাসন বলে।” 


বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯৪ সালে শাসনের সংজ্ঞায় বলে, ‘সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো শাসন বা গভর্নেন্স।’


হালফ্যানি (
Halfani) ও অন্যান্য গবেষকগণ সহমত পোষণ করে বলেন, ‘গভর্নেন্স বা শাসন হলো সরকারের এমন এক ব্যবস্থা যার লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত থাকে রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের মধ্যে বৈধ সম্পর্ক ও উন্মুক্ত যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং সেই সাথে কার্যকরী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, নির্বাচনি প্রক্রিয়া স্থাপন এবং প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল সরকারি কাঠামোকে ক্রিয়াশীলকরণ।’


‘গভর্নেন্স বা শাসনের সংজ্ঞায় ডি. কউফম্যান ও অন্যরা (
D. Kaufmann & others) বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় শাসকবর্গ নির্বাচিত হন, জবাবদিহি করেন, নিরীক্ষিত ও পরিবর্তিত হন; সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সরকারি দক্ষতা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ধারিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা বিবেচিত হয় তাকেই গভর্নেন্স বা শাসন বলে।’


অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান-এর মতে,     শাসন হলো এমন একটি ধারণা যেখানে কর্তৃপক্ষ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করে।’


শাসনের সাথে ‘সু’ প্রত্যয় যোগে ‘সুশাসন’ শব্দটির প্রকাশ করা হয়েছে। যার ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। ‘সুশাসন’ বিশ্বব্যাংকের উদ্ভাবিত একটি ধারণা। ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম ‘সুশাসন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় এবং বলা হয় উন্নয়নশীল দেশসমূহে সুশাসনের অভাবেই অনুন্নেয়ন ঘটেছে। তাই বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ঋণ সাহায্য ও প্রকল্প সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিতকরণের জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তা পূরণের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। বিশ^ব্যাংক ২০০০ সালে সুশাসনের প্রধান চারটি স্তম্ভ হিসাবে ১. দায়িত্বশীলতা, ২. স্বচ্ছতা, ৩. আইনি কাঠামো ও ৪. অংশগ্রহণ কে প্রকাশ করে।


বিশ্বব্যাংক (
World bank)-এর মতে, ‘সুশাসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয় যেখানে উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়’ (Good Governance is a manner in which power is exercised in the management of a country's economic and social resources for development.)।


UNDP- এর মতে, ‘একটি দেশের সার্বিক স্তরের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চর্চার বা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন’ (Good Governance is the exercise of economic, Political and administrative authority to manage a country's affairs at all levels.)।


জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান (
Kofi Annan) বলেছেন, ‘সুশাসন মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতাকে প্রবর্তন করে।’
 

ভি. কে. চোপড়া (V. K. Chopra) বলেন, ‘সুশাসন হলো শাসনের একটি পদ্ধতি যা সমাজের মৌলিক মূল্যবোধগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করতে সমর্থ, সেখানে মূল্যবোধগুলো হচ্ছে মানবাধিকারসহ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ক এবং একটি দায়বদ্ধ ও সৎ প্রশাসনের মাধ্যমে এই মূল্যবোধগুলো অন্বেষণ করা’ (Good governance is a system of governance that is able to Unambiguously identify the basic values of the society where values are economic, political and socio-culture issues including human rights and pursue these values through and accountable and honest administration.)। 


জি. বিলনে (
G. Bilney)- সুশাসনের সংজ্ঞায় বলেন, ‘Good Governance is the effective management of a country's Social and economic resources in a manner that is open, transparent, accountable and equitable.


অধ্যাপক ড. মহব্বত খান-এর মতে, ‘সুশাসন হলো একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা। তবে ব্যবস্থাটি হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায্য সমতাপূর্ণ।


ম্যাককরনী (
MacCorney) ‘সুশাসন’ সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান কওে বলেন, ‘সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়’ (Good governance is the relationship between civil society and the state, between government an governed, the ruler and ruled)।


পশ্চিমা বিশ্বের মতামত
‘সুশাসন’ বিষয়টি একটি বহুমাত্রিক এবং একটি আন্তর্জাতিক ধারণা। পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ সুশাসনের চারটি দিকের কথা উল্লখ করেছে। যথা-
    সুশাসন অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনাকে বুঝায়
    সুশাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
    রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ যাতে উত্তম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
    প্রশাসনিক দক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক।
 

দাতা সংস্থার মতামত
সুশাসন ধারণাটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উদ্ভাবিত হলেও এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছে বিভিন্ন দাতা ও সহযোগী সংস্থা। দাতা সংস্থাগুলো সুশাসনের কয়েকটি নির্দেশনা প্রদান করেছে। যথা-
    রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং একটি অবাধ নির্বাচিত আইনসভা।
    ব্যক্তি সত্তার অধিকার সংরক্ষণে সংবিধান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।
    স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ।
    শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন।
    একটি স্বাধীন নির্বাচিত আইনসভার নিকট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি প্রভৃতি।
 

মোটকথা, প্রশাসনের যদি জবাবদিহিতা (Accountability), বৈধতা (Legitimacy), স্বচ্ছতা (Transparency) থাকে, এতে যদি অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে, বাক স্বাধীনতাসহ সকল রাজনৈতিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের অনুশাসন থাকে তাহলে সে শাসনকে সুশাসন বলে।

 

সুশাসনের ধারণা - মোঃ হেলাল উদ্দিন